E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৯ এপ্রিল, ২০২১ / ২৬ চৈত্র, ১৪২৭

বিজেমূলের দুষ্কৃতী দাপট এবং হিংসা সত্ত্বেও তৃতীয় দফার ভোটেও ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ

কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয়তা সব জায়গায় সমান ছিল না


ঢাকুরিয়া থেকে গড়িয়া পদযাত্রায় বিমান বসু, অধীর চৌধুরী, সুজন চক্রবর্তী, দেবদূত ঘোষ, শতরূপ ঘোষ।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নির্বাচন কমিশনের অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের আশ্বাসকে কার্যত নস্যাৎ করে দুষ্কৃতীর দাপট, হিংসায় কলঙ্কিত হয়েছে রাজ্যের তৃতীয় দফার নির্বাচন। ৬ এপ্রিল হাওড়া, হুগলি ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মোট ৩১টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলির বিভিন্ন জায়গায় কোথাও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস, আবার কোথাও বিজেপি’র দুষ্কৃতীরা নানাভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি ও হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ চালিয়েছে। এই সমস্ত জায়গাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তাদের উপ‍‌যুক্ত ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বেশ কিছু জায়গায় সংযুক্ত মোর্চার এজেন্টদের গায়ের জোরে বের করে দেওয়া, রাস্তায় ভোটারদের আটকে হুমকি-মারধর করা সত্ত্বেও মানুষ দৃঢ় মনোভাব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। এমনই প্রতিরোধের মেজাজ এদিন বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এদিন তিন জেলার ৩১টি কেন্দ্রে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ৭৭.৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এরমধ্যে হাওড়ায় ৭টি কেন্দ্রে ৭৭.৯৩ শতাংশ, হুগলির ৮টি কেন্দ্রে ৭৯.৩৬ শতাংশ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ১৬টি কেন্দ্রে ৭৬.৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

এদিকে ভোটারদের পরিচিতিপত্র পরীক্ষার কাজ তৃতীয় দফা থেকে কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো এনিয়ে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ৬ এপ্রিল সংযুক্ত মোর্চার এক প্রতিনিধিদল রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় দফা পর্যন্ত এই পরিচিতিপত্র দেখার কাজ করছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। তৃণমূলের আপত্তিতে তৃতীয় দফা থেকে তা বন্ধ ক‍‌রে দেওয়া হয়। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে পুনরায় পরিচিতিপত্র দেখার কাজ চালু করার দাবি জানানো হয়েছে।

এছাড়াও নির্বাচনের দিন রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি নিয়ে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। আগের দু’টি পর্বের মতো এদিনও প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা ছিল, যা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে রবীন দেব এ নিয়ে বলেছেন, আমরা প্রথম দফা থেকে বলে আসছি, ভোটের দিন প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি বন্ধ রাখা উচিত। কারণ যেখানে তাঁরা জনসভা করছেন, সেখান থেকে মাইকের আওয়াজ এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে তাঁদের বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে। যার ফলে ভোটাররা প্রভাবিত হচ্ছেন।

তৃতীয় দফার ভোটের আগের দিন রাতে হাওড়ার উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রের তুলসীবেড়িয়া গ্রামে এক তৃণমূল নেতার বাড়ি থেকে ৪টি ইভিএম এবং ‍‌ভিভিপ্যাট উদ্ধার করা হয়েছে। এদিন সেই তৃণমূল নেতা ও সেক্টর অফিসারকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন গ্রামবাসীরা। তাদের ঘিরে রেখে গ্রামবাসীরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান।

তৃতীয় দফায় বিভিন্ন জায়গায় হিংসাত্মক আক্রমণ ও অবাধ ভোটগ্রহণে বাধা সৃষ্টির জন্য তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ জানিয়েছেন সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দ। বিশেষ করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু বুথে ভোটার ও সংযুক্ত মোর্চার পোলিং এজেন্টদের ওপরে আক্রমণ করা হয়েছে বলে লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হয়েছে। ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রজুড়ে সংযুক্ত মোর্চার কর্মী, সমর্থকরা তৃণমূলের ভোটলুটেরা বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন যে, গত নির্বাচনে প্রায় দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জেতা তৃণমূল বিধায়ক তথা এবারের তৃণমূল প্রার্থী সওকত মোল্লা রাস্তায় বসে অবস্থান শুরু করেন। বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রের পানাকুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ১২৩ নম্বর বুথের অন্তর্গত এক গৃহবধূ রীতা পাঁজা গত ১০ বছর ভোট দিতে পারেননি। তাঁকে ভোট দিতে যাবার সময় স্থানীয় এক তৃণমূল দুষ্কৃতী বাধা দেয়। তার বাধা ও হুমকিকে প্রতিহত করেই সেই মহিলা ভোট দিতে যান। পরে পুলিশ সেই দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করে।

এদিন তৃতীয় দফার ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতেই নজিরবিহীনভাবে আক্রান্ত হন আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা মণ্ডল, উলুবেড়িয়া দক্ষিণে বি‍জেপি প্রার্থী পাপিয়া অধিকারী, খানাকুলে তৃণমূল প্রার্থী নজিবুল করিম এবং উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী নির্মল মাজি। বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে রেষারেষির জেরে এই সমস্ত ঘটনা ঘটে।

এছাড়া মগরাহাট পশ্চিম কেন্দ্রের নেওড়া হাই মাদ্রাসার বুথে আইএসএফ প্রার্থী মইদুল ইসলামকে ঢুকতে বাধা দিলে তিনি বুথের সামনে ধরনায় বসেন। এদিন তৃণমূলের হুমকি, বাধাকে উপেক্ষা করেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ১৬টি কেন্দ্রে ভোট দেন সাধারণ মানুষ।

এদিকে ভোটের আবহে উত্তেজনা তৈরি করতে ৫ এপ্রিল গোঘাটে এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অপপ্রচার করতে থাকে বিজেপি। আবার ভোটের দিন গোঘাটে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে ঘিরে পালটা অপপ্রচার করে তৃণমূল।

হাওড়া জেলায়ও বিভিন্ন কেন্দ্রে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংযুক্ত মোর্চার এজেন্টদের মারধর, বুথ জ্যাম ও ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠে। এই সমস্ত কিছুকেই প্রতিহত করে মানুষ অভূতপূর্ব জেদে ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক বিপ্লব মজুমদার।

এদিন কেরালার ১৪০টি বিধানসভা কেন্দ্রে, তামিলনাডুর ২৩৪টি কেন্দ্রে, পুদুচেরি বিধানসভায় ৩৪ টি কেন্দ্রেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া অসমে তৃতীয় তথা শেষ দফায় ১২টি জেলার ৪০টি কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এদিকে গত ৭ এপ্রিল নির্বাচনী প্রচারে সাম্প্রদায়িক বক্তৃতার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে নোটিশ পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ৩ এপ্রিল তারকেশ্বরে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে এক নির্বাচনী সভায় সাম্প্রদায়িক প্রচার করেন মমতা ব্যানার্জি। তার জন্য নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়ে। তার ভিত্তিতে মমতার কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বক্তব্য তলব করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া তৃতীয় দফা ভোটের আগে দক্ষিণ দিনাজপুর এবং পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের জেলা শাসকদের অপসারণ করেছে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার কর্মসূচিতে ক্রমশ জনসমর্থন বৃদ্ধির ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে। সংযুক্ত মোর্চাই তৃণমূল এবং বিজেপি-কে পিছনে ফেলে প্রথম শক্তি হিসেবে উঠে আসছে। ৭ এপ্রিল যাদবপুর, কসবা, টালিগঞ্জ এবং রাসবিহারী কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীদের সমর্থনে ঢাকুরিয়া থেকে গড়িয়া পর্যন্ত মিছিলে জনপ্লাবন সৃষ্টি হয়েছে। এই মি‍ছি‍‌লে অংশ নেন বামফ্রন্ট চে‌য়ারম্যান বিমান বসু, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী সহ টালিগঞ্জ, কসবা, রাসবিহারী কেন্দ্রের প্রার্থী যথাক্রমে দেবদূত ঘোষ, শতরূপ ঘোষ, আশুতোষ চ্যাটার্জি সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ।