৫৮ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৯ এপ্রিল, ২০২১ / ২৬ চৈত্র, ১৪২৭
পূর্ব বর্ধমান জেলায় মানুষের স্বার্থে বামপন্থীদের ধারাবাহিক লড়াই আন্দোলনই নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে
সন্দীপ দে
বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী পৃথা তা।
“আমরা খেলতে আসিনি, লড়াই করতে নেমেছি। গরিবের পেটের ভাত, বেকারের কাজ, মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করছি আমরা। মেয়েদের সম্মান, শিশুর জীবনহানি অথবা বেকারদের কাজ নিয়ে খেলা চলেনা। যারা আপনার-আমার অধিকার নিয়ে খেলতে চাইছে তাদের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে এই নির্বাচনে”।
বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী পৃথা তা যখন বাড়ি বাড়ি প্রচারে এলাকা পরিক্রমায়, পথসভা বা জনসভায় এই কথাগুলো বলছেন, তখন তা যেন গোটা জেলার সংবেদনশীল মানুষের ভাষ্য হয়ে উঠছে। পূর্ব বর্ধমান জেলায় সিপিআই(এম), বামফ্রন্ট এবং অন্যান্য গণসংগঠন বিগত সময়কালে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা, রুটি-রুজি, বেকারদের কাজের দাবিতে, রাজ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এই কর্মসূচিগুলোর মধ্যদিয়ে একদিকে যেমন গরিব সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ, বঞ্চনা, তাদের উপর শাসকদলের ক্রমাগত অত্যাচার-নিপীড়ন এবং তাদের ন্যায্য দাবিদাওয়া, অধিকারের বিষয়গুলি উঠে এসেছে, তেমনি বামপন্থীদের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনও যে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে তা স্পষ্ট হচ্ছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি নিয়ে লাগাতার লড়াই-আন্দোলনে নিয়ত থাকার ফলে ২৬ নভেম্বর ও ৮ ডিসেম্বরের দু’টি সাধারণ ধর্মঘটে এই জেলায় ব্যাপক সাড়া মিলেছে।
২০১১ সালে এ রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য জেলার মতো এই জেলাতেও প্রতিটি নির্বাচনে শাসকদল মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে, সেইসঙ্গে পঞ্চায়েত পৌরসভা সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখল করে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছে। কিন্তু মানুষের স্বার্থে কোনো কাজ করেনি, উলটে জনগণের জন্য বরাদ্দ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা দেদার লুট করেছে। এসব জেলার মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রয়েছে।
করোনার মারণ সংক্রমণের অভিঘাতে রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো এই জেলাও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছেন অগণ্য গরিব শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু তখন কোনো মানবিক উদ্যোগের চেয়ে সরকার ও শাসকদলের নিদারুণ অবহেলা ও অপদার্থতাই শুধুমাত্র প্রকট হয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মানবিক সংকটের মুহূর্তে একমাত্র বামপন্থীরাই সাধ্যমতো বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তখন উপার্জনহীন ও সঙ্গতিবিহীন ও দুঃস্থ মানুষদের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, অতিমারীর মোকাবিলায় এলাকায় এলাকায় জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রচার, বাড়িতে বাড়িতে সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়ার মতো বিভিন্ন মানবিক উদ্যোগ নিয়েছেন একমাত্র বামপন্থীরাই। জেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় খোলা হয়েছে শ্রমজীবী ক্যান্টিন।
সেই সংকটকালে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে কর্মরত এই জেলার প্রায় ১৫ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই অসহায় শ্রমিকদের প্রতি কোনো সাহায্যে এগিয়ে আসেনি রাজ্য সরকার বা শাসকদল। তখন সিআইটিইউ সহ অন্যান্য গণসংগঠন নানাভাবে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করেছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অবিশ্বাস্য হলেও এখন ফসলের দাম না পেয়ে এবং ঋণের জালে ফেঁসে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমান্বয়ে ঘটছে। গোটা রাজ্যে এপর্যন্ত ২২৪ জন কৃষক ও খেতমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন। তার মধ্যে এই জেলায় ২০১১ সালের পর এই সংখ্যা পৌঁছেছে ১৫৪-তে। রাজ্য সরকার ৬০ কেজি ধানের ক্রয়মূল্য ১৯২৪ টাকায় বেঁধে দিলেও সেই মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে খুবই কম। জেলায় এই ধান কেনার বরাত দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মিল মালিকদের উপর। তারা কৃষকদের মাত্র ১০০০ টাকা দিয়ে প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) থেকে ৮০০ টাকা লাভ করছে। এতে হস্তক্ষেপ করছে স্থানীয় তৃণমূলীরা এবং বিপুল অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। এই অপকীর্তির বিরুদ্ধে কৃষক সভার পক্ষ থেকে বিডিও এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এরফলে ভাতার ব্লকে ধান কেনা বন্ধ রাখা হয়। এছাড়াও লক্ষ করা গেছে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা বাবদ যে চেক দিয়েছে তা ভাঙাতে দু’মাসেরও বেশি সময় গড়িয়ে গেছে। যারফলে প্রয়োজনের সময় টাকা হাতে না পেয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে কৃষকদের।
জেলায় এবারে আলুর ফলন ভালো হলেও উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। তাঁরা প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কো-অপারেটিভ থেকে ঋণ নিয়ে অথবা সোনা বন্ধক দিয়ে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাষ করে চরম বিপাকে পড়ছেন তাঁরা। বিঘাপ্রতি তাঁদের ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। এদিকে আড়তদাররা কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে জমা করে রাখছে। সব মিলিয়ে গরিব ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি থেকে মাঝারি কৃষককে ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অথচ সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এসব নিয়ে জেলার গ্রামাঞ্চলে কৃষক সভার উদ্যোগে লাগাতার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে জেলার গ্রাম-শহর জুড়ে অসংখ্য পদযাত্রা,জাঠা ইত্যাদি হয়েছে, যাতে অংশ নিয়েছেন অগণিত মানুষ।
এই সময়কালে শিক্ষা ও কাজের দাবিতে, শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পঠনপাঠন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই জেলায় ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেছে। বিশেষকরে জেলার অন্যতম প্রস্তাবিত শিল্পপ্রকল্প কাটোয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপায়ণের দাবিতে জেলাজুড়ে ২০১৫ সাল থেকে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে আসছে যুবরা। এই দাবিতে সমগ্র জেলায় স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দু’বার জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি এই প্রকল্পটি অবিলম্বে রূপায়ণের দাবিতে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর জেলার চারটি প্রান্ত থেকে চারটি পদযাত্রা কাটোয়ায় প্রকল্পের জন্য অধিগৃহীত এলাকার গেট পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছে। এই কর্মসূচিতে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-যুব অংশ নেন। বাইক মিছিলে অংশ নেন দেড় হাজারের বেশি যুবক।
শহরাঞ্চলে পৌর নির্বাচন, সুষ্ঠু পৌরপরিষেবা প্রদান সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়েও বামপন্থীদের আন্দোলন জনমানসে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো এখানেও পৌরসভাগুলিকে ঘিরে দুর্নীতি, অনৈতিক কাজকর্ম, বেআইনি নির্মাণ,কাটমানি ও তোলাবাজির দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে পৌরসভাগুলির নির্বাচন না করে প্রশাসক বসিয়ে শাসকদলের সীমাহীন লুটের কারবার চলছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের পাশাপাশি ডিজিটাল রেশন কার্ড, নিকাশি ব্যবস্থা, পানীয় জল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানীয় দাবি নিয়ে জেলার ৬টি পৌর এলাকাতেই সরব হয়েছেন বামপন্থীরা, সেইসঙ্গে এসব দাবি নিয়ে এসডিও’র কাছে স্মারকলিপিও পেশ করা হয়েছে।
রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো এখানেও কিছু কিছু অঞ্চলে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মানুষের জীবন-জীবিকা ও দাবিদাওয়ার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম ১, রায়না, খণ্ডঘোষ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে সেই সন্ত্রাসের আবহকে দূর করে এখন লাল পতাকার সমারোহ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
জনজীবনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও দাবিদাওয়া তুলে ধরে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের আন্দোলনের প্রবহমানতার মধ্য দিয়ে জেলায় যে জনসমর্থন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তার সাক্ষ্য মেলে নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত কয়েকটি জনসভায়। এগুলির মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি পার্টির ডাকে জামালপুরের সমাবেশ, ২২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহর সংলগ্ন দেওয়ানদিঘিতে শহিদ কমরেড কমল গায়েন এবং কমরেড প্রদীপ তা স্মরণে সমাবেশ এবং ২১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী লোকশিল্পী সঙ্ঘ এবং পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতির পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির ডাকে বর্ধমান শহরে আদিবাসী ও জনজাতিদের বিশাল সমাবেশে হাজারো মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়েছে লালঝান্ডার প্রতি জনমানুষের ক্রমবর্ধমান আস্থা ও সমর্থন।
এছাড়াও সাম্প্রতিক অতীতে জেলা জুড়ে পার্টির ডাকে গণ অর্থসংগ্রহ অভিযান সংগঠিত হয়েছে। এতে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে এবং একমাসব্যাপী এই কর্মসূচিতে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা সংগৃহীত হয়েছে। এই সমস্ত কর্মসূচির মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হয়েছে বিগত নির্বাচনগুলিতে পার্টির যে জনবিচ্ছিন্নতা হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে জনসমর্থনের ভিত ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। যা বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে সংযুক্ত মোর্চাকে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার মোট আসন ১৬টি। তারমধ্যে সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে সিপিআই(এম) ১২, ফরোয়ার্ড ব্লক ১টি, মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক ১টি এবং কংগ্রেস ২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রতিটি কেন্দ্রেই সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা বাড়ি বাড়ি প্রচার, বৈঠক সভা, পথসভা এবং প্রার্থীর এলাকা পরিক্রমায় মানুষের কাছে বামফ্রন্ট ও সংযুক্ত মোর্চার বিকল্প কর্মসূচির কথা তুলে ধরছেন।
এই জেলার মধ্যে অন্যতম কেন্দ্র বর্ধমান দক্ষিণ। বর্ধমান পৌরসভা এলাকার ৩৫টি ওয়ার্ড পরিবেষ্টিত এই কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৫৭ হাজার। এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী পৃথা তা। এসএফআই নেত্রী পৃথা শহিদ কমরেড প্রদীপ তা-র কন্যা। এই জেলা তথা গোটা রাজ্যের মানুষ জানেন, ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানদিঘিতে দুই পার্টিনেতা কমরেড প্রদীপ তা এবং কমরেড কমল গায়েনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তৃণমূলের খুনে বাহিনী। বাবার মৃত্যুশোক পৃথার জীবনপ্রবাহকে কোনোভাবে মন্থর করতে পারেনি। বরং প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনের দুর্বার প্রবাহে নিজেকে সম্পৃক্ত কারার মধ্য দিয়ে পৃথা বৃহত্তর গণ আন্দোলনের একজন নির্ভীক অভিযাত্রী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছেন। তাঁর এই পরিচয় নির্বাচনের প্রচারে নিঃসন্দেহে বাড়তি মাত্রা সংযোজন করেছে।
তৃণমূলের অপশাসন,দুর্নীতি ইত্যাদিতে ব্যাপক ক্ষুব্ধ মধ্যবিত্ত অংশের মানুষ। ছাত্র-শিক্ষকরা প্রত্যক্ষ করেছেন তৃণমূলের দৌরাত্ম্য। এই কেন্দ্রের মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে তৃণমূল-বিজেপি কপট ঝগড়ার আড়ালে কীভাবে মেহেদিবাগান এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চেয়েছিল। বস্তিবাসী মুসলিমরা এনআরসি-সিএএ নিয়ে আতঙ্কিত। শাসকদল তৃণমূলের তোলাবাজি-কাটমানির অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আজ পরিত্রাণের পথ খুঁজছেন। প্রশাসনের ফতোয়ায় সরকারি বাস শহরের অভ্যন্তরে ঢুকতে না দেওয়ায় সাধারণ মানুষ নানাভাবে সমস্যার কবলে পড়ছেন। তৃণমূলের ফড়েরা টোটো চালকদের কাছ থেকেও তোলা আদায় করছে। পৃথার প্রতিদিনের এলাকা পরিক্রমার সময়ে এই সমস্ত বিষয় উঠে আসছে। তাই প্রার্থীকে কাছে পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের পাশাপাশি ছোটো ব্যবসায়ী থেকে টোটো চালকরা পর্যন্ত তাঁদের জীবনযন্ত্রণার কথা বলে সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। যা এবারের নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
বর্ধমান শহরের একপ্রান্তে কাঞ্চন নগর, পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ড থেকে জিতেছেন তৃণমূলের খোকন দাস। এবারে তাঁকেই এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এখানেও এলাকা পরিক্রমায় এসে অগণিত মানুষের সমর্থন কুড়িয়ে নিলেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী পৃথা তা। মোড়ে মোড়ে মহিলাদের ফুল-মালায় তাঁকে অভিনন্দিত করতে দেখা গেল। প্রতিটি জায়গাতেই পৃথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন, নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রামকে শাসক দল যেভাবে খেলার পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাইছে, তার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ - ‘বেকারদের কাজ, গরিব মানুষের পেটের ভাত, মেয়েদের সম্মান এবং বাচ্চা শিশুর বোমা ফেটে মৃত্যু নিয়ে খেলা চলেনা।’ সে পাড়ায় জড়ো হওয়া মহিলা-পুরুষদের কাছে গিয়ে বলছেন, ‘পাড়ার যে ছেলেটা তৃণমূলের ঝান্ডা ধরছে,সে আমার শত্রু না। আপনারা ভেবে দেখবেন, যে শাসক দলের ঝান্ডা ধরে অথবা দেওয়ালে চুন লাগায় সে না পায় কাজ, না হয় নেতা। বড়োজোর তার একটা সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ হয়তো জুটতে পারে। আমরা সবার জন্যই চাই কাজ ও শিক্ষা। বিজেপি’র প্রার্থী তালিকাটা একবার দেখবেন, সেখানে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে দু’জন তৃণমূল। কাজেই আপনারা তৃণমূল-বিজেপি’র গটআপ গেমে ভুলবেন না।’
এই এলাকা পরিক্রমার সময়কালে লবণগোলা অঞ্চলে দেখা গেল বালি দিয়ে একটা পুকুর বোজানো চলছে। স্থানীয় মানুষরাই জানালেন, স্বয়ং কাউন্সিলরের উদ্যোগে দিন দুপুরে পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। এই কীর্তিমান কাউন্সিলরই একটা সময়ে সারদার টাকায় এখানে ‘কাঞ্চন উৎসব’-এর নামে মোচ্ছব করেছেন। তার নেতৃত্বেই এখানে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাস চলেছে। তিনিই আজ বিধান সভায় শাসকদলের প্রার্থী। এলাকার মানুষ এতদিন তাঁর কার্যকলাপ নীরবে সহ্য করে আজ প্রতিবাদ জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানুষের এই নীরব প্রতিবাদ ক্রমশ বাঙ্ময় হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে পৃথার এলাকা পরিক্রমার সময়ে। সে আবেগমথিত কন্ঠে বলছে, ‘তৃণমূলের বোমায় রসিকপুরের বাচ্চা শিশুটির অকালে প্রাণ চলে গেল। ওদের এলাকা দখলের জন্য আরও কত শিশুর প্রাণ বিসর্জন দেখব আমরা? আমরা চাই এই নৈরাজ্য ও ধর্মের নামে বিভাজন-হানাহানি বন্ধ করতে। এই নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাদের। আপনারা সংযুক্ত মোর্চার পাশে দাঁড়ান।’
পৃথার এই বাস্তব অনুভূতি, অমোঘ রাজনৈতিক উচ্চারণ যেন সবার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এই কেন্দ্রের প্রতিটি প্রচার কর্মসূচিতে। সেইসঙ্গে জেলা জুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা ও যন্ত্রণার অবসানে বামপন্থীদের ধারাবাহিক লড়াই -আন্দোলন মানুষকে যেমন আকৃষ্ট করেছে এবং প্রকৃত বন্ধু চেনাতে সাহায্য করেছে, তেমনি সংযুক্ত মোর্চার বিকল্প কর্মসূচিও জেলায় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।