E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৯ এপ্রিল, ২০২১ / ২৬ চৈত্র, ১৪২৭

জলপাইগুড়ি জেলায় সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে উৎসাহী মানুষের ভিড় ক্রমশ বেড়ে চলেছে

সঞ্জিত দে


ধূপগুড়ি মিলনী ময়দানে সংযুক্ত মোর্চার নির্বাচনী সভায় বলছেন মানিক সরকার।

কুমির তাড়িয়ে হাঙরকে আসার সুযোগ দেবেন না। কুমিরকেও তাড়াতে হবে হাঙরকেও আসতে দেওয়া যাবেনা - এই আহ্বান জানিয়েছেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য ও ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। তিনি গত ৩ এপ্রিল জলপাইগুড়ি জেলার চালসায় মালবাজার কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী মনু ওঁরাও এবং নাগরাকাটা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী সুখবীর সুব্বার সমর্থনে এবং ধূপগুড়িতে সিপিআই(এম) প্রার্থী অধ্যাপক প্রদীপকুমার রায়ের সমর্থনে দু’টি জনসভায় ভাষণ দেন। মানিক সরকার বলেন, মোদীর সরকার নোটবন্দি করে, শ্রম আইন সংশোধনী এনে এবং কৃষি আইন করে একের পর এক দেশের শ্রমিক কৃষক সহ সর্বসাধারণ মানুষের চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে। একদিকে ট্রাম্পকে খুশি করতে, আরেকদিকে আদানি-আম্বানি সহ কর্পোরেট মালিকদের সুবিধা দিতে এই সব করছে। দেশের সম্পদ বিক্রি করে সব শেষ করছে। মানিক সরকার বলেন, এরাজ্যে তৃণমুল দশ বছর ধরে গণতন্ত্র হত্যা করে চুরি লুটের বহর বৃদ্ধি করছে। নীতির দিক থেকে দুই সরকারের রাস্তা এক, তাই দুই দলকেই ঠেকাতে হবে। সংযুক্ত মোর্চাই একমাত্র বিকল্প। তিনি বলেন, আমাদের ত্রিপুরা দেখে শিক্ষা নিন। সোনার বাংলা গড়ার স্লোগান সবটাই মিথ্যা। আসাম ও ত্রিপুরার মানুষ বিজেপি সরকার তাড়াতে উদগ্রীব হয়ে আছে। তাই নতুন করে এরাজ্যে তাদের সুযোগ করে দেবেন না। বাংলাকে রক্ষা করতে তৃণমুল- বিজেপি উভয়কেই হারাতে হবে।

জলপাইগুড়ি জেলায় ভোট আগামী ১৭ এপ্রিল। এখানে প্রচার চলছে জোর কদমে। এই প্রচারপর্বে প্রচুর নতুন মানুষ এসে শামিল হচ্ছেন লাল পতাকার নিচে। এই জেলায় মোট সাতটি বিধান সভা কেন্দ্র। জলপাইগুড়ি জেলায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীরা হলেন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী দিলীপ সিং, রাজগঞ্জ কেন্দ্রে সিপিআই(এম)’র রতনকুমার রায়, জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসের সুখবিলাস বর্মা, ময়নাগুড়ি কেন্দ্রে আর এস পি দলের নরেশ চন্দ্র রায়, মালবাজার কেন্দ্রে সিপিআই(এম)’র মনু ওঁরাও, নাগরাকাটা কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসের সুখবীর সুব্বা এবং ধূপগুড়ি কেন্দ্রে সিপিআই(এম)’র প্রদীপ কুমার রায়।

বিগত সময়কালে মৃত্যু উপত্যকা বানিয়েছে তৃণমুল সরকার, আর মিথ্যার ফুলঝুরি ছুটিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আমাদের সাজানো সুন্দর ছবির মতো চা বাগানকে। তীব্র ক্ষোভ আর শ্লেষের সাথে একথা বানারহাটে বসে বললেন ডুয়ার্সের চা শ্রমিক নেতা তিলক ছেত্রী। ২০১২ সাল থেকে রেডব্যাঙ্ক গ্রুপের তিন চা বাগানে তালা ঝুলছে। রেডব্যাঙ্ক, সুরেন্দ্র নগর এবং ধরনীপুর চা বাগানে অনাহার অপুষ্টিতে এবং চিকিৎসার অভাবে দুই শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই তিনটি চা বাগান নাগরাকাটা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। কেন্দ্রের মন্ত্রী জয়রাম রমেশ, নির্মলা সীতারামন দুবার ঘুরে আশ্বাস দিয়ে গেছেন। রাজ্যের হাফডজন মন্ত্রী কয়েক দফা এসেছেন কিন্তু বাগানে কারখানার তালা খোলেনি। মুখ্যমন্ত্রী বাগানের গেটের সামনের জাতীয় সড়ক দিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা করেছেন, কিন্তু উঁকি দিয়ে খবরটুকুও নেননি। আর বার বার বলেছেন চা বাগানে নাকি কেউ অনাহারে মারা যায়নি। এই অনাহারক্লিষ্ট শ্রমিকদের নিয়ে তিনি উপহাস করে গেছেন। অথচ সরকার বিপুল অর্থ খরচ করে খাদ্য উৎসব করেছেন। সুরেন্দ্রনগর বাগানের জয়া মিঞ্জ বলেন, লাল ঝান্ডা আর তাদের ছাত্র যুব মহিলা ও কর্মচারীদের সংগঠনসহ নানা ধরনের সামাজিক সংগঠন বারে বারে এসে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা সামগ্রী দিয়েছে। রেডব্যাঙ্ক বাগানের শান্তি খেস, অঞ্চমি, পিত্রুস লাকড়া বার বার জানিয়েছেন, আমরা সরকারের দয়া ভিক্ষা বা কারো সাহায্য চাইনা। আমরা চাই বাগান খুলে আমাদের হাতে কাজ দেওয়া হোক। সব বন্ধ বাগান থেকে যুব মহিলা ভিন রাজ্যে গেছে কাজের সন্ধানে। অনেক যুবতী নিখোঁজ, কয়েক বছর ধরে তাদের খবর নেই। বানারহাট বাগানের চা শ্রমিক ও যুব নেতা অজয় মাহালি বলেন, একদিকে বাগানের স্থাবর সম্পদের লুটপাট চলছে, আরেকদিকে নারী শিশু পাচারকারীরা সক্রিয়। আমরা সব হিসেব বুঝে নিতে চাই দুই সরকারের কাছ থেকে। একদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত, আরেকদিকে ভুটান সীমান্ত - দুই সীমান্তের মাঝে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ গালিচা, তেমনি অরণ্যবেষ্টিত জনপদ, বিশাল অঞ্চলের কৃষি এলাকা। মহানন্দা, তিস্তা, জলঢাকার জলে পরিপুষ্ট কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন মানুষের জীবন জীবিকার সন্ধান ছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। শিলিগুড়ি লাগোয়া ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এবং রাজগঞ্জের মতো এলাকায় গড়ে উঠেছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পাঞ্চল। তিস্তা সেচ প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের লাগাতার টালবাহানা থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফলে জেগেছিল গ্রাম শহর। আর্থিক বিকাশ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছিল। গত দশবছর ধরে বেলাগাম দুর্নীতির ফলে সব আজ স্তব্ধ। জেলার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের সব চা বাগানে, বনাঞ্চলে, গ্রাম ও শহরে ফের নতুন করে ভয় সন্ত্রাস উপেক্ষা করে মুখ খুলছেন মানুষ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম জানতে চাইছে ভবিষ্যৎ ক্ষতি করে এদের আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যাবে না। প্রচারে মানুষের কাছে গিয়ে এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীরা। জেলার সর্বত্র প্রচারে যেমন মানুষের ঢল নেমেছে, ঠিক তেমনি প্রার্থীদের কথা শুনতে মানুষের সাগ্রহ উপস্থিতি বাড়ছে। মানুষের মুখে মুখে ফিরছে শাসকদলের চুরি আর দুর্নীতির কথা, সন্ত্রাসের কথা আর অধিকার কেড়ে নেবার কথা।

ভোট প্রচারে গিয়ে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আরেকবার স্বচক্ষে দেখলেন শুনলেন কীভাবে এ রাজ্যের শাসকদল গরিব খেটে খাওয়া মানুষের সর্বনাশ করেছে। মাঠে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ আলু তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন এক দুপুরে। মাথার উপর ঠা ঠা রোদ্দুর, খোলা মাঠের মাঝে সার দিয়ে বসে সবাই দু’হাত সজোরে মাটির নিচের দিকে ঠেলে চালান করে মাটি আলগা করে দিচ্ছিলেন। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল সাদা আলু, আবার কোনো জমিতে লাল আলু। ঝারআলতা ২ গ্রামপঞ্চায়েতের উত্তর খট্টিমারি, দক্ষিণ খট্টিমারি মৌজার অধিকারী পাড়া, ঢ্যাংকালি সহ কয়েকটি গ্রামে প্রচার করতে গিয়েছিলেন ধূপগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী অধ্যাপক প্রদীপকুমার রায়। সাথে ছিলেন পার্টির এরিয়া কমিটির সম্পাদক মুকুলেশ রায় সরকার, জয়ন্ত মজুমদার সহ স্থানীয় নেতৃত্ব ও কর্মীরা। সবাই আলু তোলার মাঠে হাজির হলেন প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দিতে। লালঝান্ডা নিয়ে সকলকে দেখে কেউ এগিয়ে এলেন, কেউ হাতের কাজ বন্ধ করে প্রতিনমস্কার জানালেন। এখানে কাজ করতে থাকা খেতমজুররা বললেন, আলুর দাম, ফসলের দাম একেবারে তলানিতে চলে গেছে, আমাদের বাঁচার উপায় জানা নেই, কী হবে? কৌশল্যা রায়, ধন্যমোহন রায়, নির্মল রায় - এই খেতমজুররা নিজেদের মতো করেই গ্রাম্য ভাষায় বললেন, একদিকে ফসলের দাম নেই, তার উপর প্রতিদিন যেভাবে চাল, ডাল, তেল নুনের দাম বাড়ছে তাতে আমরা দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। প্রার্থী প্রদীপকুমার রায় বলেন, গত দশ বছর ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যেভাবে চলছে, সেখানে গরিব মানুষের স্বার্থে কথা বলার লোকের অভাব। সব লুট করে আর বেচে দেওয়া হচ্ছে। আপনাদের যন্ত্রণা অভাব অভিযোগ বলতে যেতে চাই বিধানসভায়। বাম জনপ্রতিনিধি কমে গেলে লুটেরাদের সাহস বাড়ে তাই এসব হচ্ছে। পার্টি নেতা মুকুলেশ রায় সরকার বলেন, একারণেই দিল্লিতে গত চার মাস ধরে কৃষকরা ধরনায় বসে আছেন। মোদীর সরকার মূক-বধির-কালা হয়ে থাকার ভান করছে। অন্যদিকে রাজ্যের তৃণমূলের সরকার তাদের সমর্থন করেই চুপচাপ রয়েছে। এই দুই সরকারকে জবাব দিতে হবে ভোটে।

গ্রামের কৃষক রমনী অঞ্জলি রায়, যুবক অলক রায়, ছাত্র কমল রায়, কৃষক বিমল রায় - সবাই বলেন, ১০০ দিনের মজুরি ঠিকমতো পাইনা, কাজ করার জন্য টাকা দিতে হয়। ইন্দিরা আবাসের ঘরের জন্য টাকার ভাগ দিতে হয়। ঝারআলতা ২ গ্রামপঞ্চায়েত পরিচালনা করছে তৃণমূল-বিজেপি। এরা সবাই মিলে টাকা ভাগাভাগি করে চলছে। এসব দেখছেন গ্রামের মানুষ। প্রচারপর্বেই গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ মানুষ বলেন, এরকম দিন দেখব ভাবিনি। আগের বামফ্রন্ট সরকার অনেক ভালো ছিল। লালকে ফিরিয়ে না আনতে পারলে শান্তি ফিরবে না। এই গ্রামের প্রচার শেষ করে সকলে চলে যান পাশের গ্রাম শালবাড়ি ১ গ্রামপঞ্চায়েতের কেরানিপাড়ায় এক কর্মী সভায়। এখানে মহিলা পুরুষ সহ অনেক মানুষ ছিলেন। এই কেরানিপাড়া এমন একটা বুথ যেখানে গত ৪০ বছর ধরে যত রকমের ভোট এসেছে সব ভোটেই লালঝান্ডার জয় এসেছে। সাত সকালে তিরিশ কিলোমিটার দূরে গাদং ১ গ্রামপঞ্চায়েতের খলই গ্রাম ভোট পাড়া গ্রাম থেকে প্রচার শুরু করে রাতের অন্ধকার নেমে আসে খট্টিমারি ফরেস্ট ঘেষা এই গ্রামে। তবুও প্রচার চলতেই থাকে। প্রতিটি সভা, মিছিল আর প্রার্থীর এলাকা পরিক্রমায় মানুষ ভিড় করছেন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে।