E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৯ এপ্রিল, ২০২১ / ২৬ চৈত্র, ১৪২৭

সরকার ও সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রসঙ্গে

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


‘শতং বদ, মা লিখ’ জীবনে চলার পথে গুরুজনদের এই শিক্ষা অনেকেই পেয়েছি। লেখার জগতে পেয়েছি নতুন শিক্ষা - লেখাতে যেন ফাঁকি না থাকে, সততা নিয়ে লিখতে হয়। লেখাতে যেন যুক্তি, তথ্যতে কোনো ঘাটতি না থাকে। কারণ, লেখা ছাপা হয়ে গেলে তা আর পাল্টানোর সুযোগ থাকে না। তাই যা প্রকাশিত হয়, প্রকাশের আগে তার সত্যতা শতবার না হলেও অন্তত কয়েকবার যাচাই করে নেওয়া দরকার। ছাপা অক্ষরের প্রতি কম-বেশি অনেক মানুষের দুর্বলতা আছেই। একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে যে, পেপারে বা বইয়ে বেরিয়েছে মানে সেটা ভুল হতে পারে না। ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপ-ইউটিউব-এর যুগে দাঁড়িয়ে পরিচিত শব্দ ‘ফেক নিউজ/ফেক মেসেজ/ফেক ভিডিও’। ঠিক তেমনি ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদ মাধ্যম, ‘নিরপেক্ষ’ সামাজিক মাধ্যম (সোস্যাল মিডিয়া)এই শব্দগুলো যে সোনার পাথরবাটি এটা বামপন্থীরা জানে ও বহুবছর ধরে সেটা বলেও আসছে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের মুখপত্র আর কোনো শিল্পপতির মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল বা সংবাদ মাধ্যমের পার্থ্যক্য একটাই - প্রথম জন তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, দ্বিতীয়জন সেটা না করে ঘোমটার তলায় খ্যামটা নাচে। শুধু তাই না, নানা কৌশলে মানুষের মধ্যে এই ধারণাও সৃষ্টি করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক দলের পত্রিকা মানেই একপেশে। তারা তো দলের প্রচার করার যন্ত্র, তাই তাদের পত্রিকা পড়ে দলের খবর ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।

এই অন্য ধারার পত্রিকা মালিকদের বা টিভি চ্যানেলের মালিকদের বা শিল্পপতিদের দর্শন হলো পত্রিকা পড়বে বা টিভি দেখবে তো মানুষ এন্টারটেইনমেন্টের জন্যে। তাই সেখানে রাখা যাবে না সমস্যার, আন্দোলনের গল্প। রাখা যাবে না বস্তির ছবি। থাকবে না গরিবের দিনযাপন। থাকবে হাইফাই জীবনযাপনের নানা গল্প কাহিনি। পত্রিকা পড়ে বা টিভি দেখে মানুষ যেন জানতে না পারে দেশে আসলে কি চলেছে; যেন জানতে না পারে কারা গরিবের পক্ষে, কারা শুধু ধনীদের পক্ষে, অথচ যে পত্রিকাগুলো বা টিভি চ্যানেলগুলো শাসকের হয়ে কথা বলে, তাবেদারি করে, শাসকের ভোট ম্যানেজারের কাজ করে, শাসকের সাফল্যের বানানো কাহিনি লেখে, শাসকের বিরোধীদের কুৎসা করে, কিন্তু সত্যি কথাটা স্বীকার করে না যে, ওরা শাসকের পক্ষে। বরং তাদের কেউ বলে ‘না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়’, কেউ বলে ‘ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায় না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যারা শাসকের মুখ আর মুখোশ চেনে ও মানুষের কাছে তুলে ধরার হিম্মত দেখায় তাদের গায়ে ছাপ দেওয়া হয় ‘রাজনৈতিক’ পত্রিকা বলে। যারা রাজনীতি করে না, তারা অনেকেই রাজনৈতিক দলের পত্রিকা এড়িয়ে চলে। ভাবটা এমন যা কিছু ‘রাজনৈতিক’ দলের তা বোধ হয় একপেশে, যাদের গায়ে ‘রাজনৈতিক’ দলের ছাপ নেই তারা একেবারে ‘নিরপেক্ষ’।

বাস্তবে সব কিছুই তো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। আসলে তো সব পত্রিকাই রাজনৈতিক। সব টিভি চ্যানেলই রাজনৈতিক। বেঁচে থাকাটাই তো আপাদমস্তক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। এটাই তো জীবনের সহজ সত্য। যিনি চাষ করে খান, যিনি শ্রম বিক্রি করে খান, ছোটো ছোটো দোকান, দোকান করার সামর্থ্য নেই বলে রাস্তায় বসে ফল, সবজি, জামাকাপড় বা অন্য কিছু বিক্রি করেন, পরের জমিতে কাজ করে খান, পরের দোকানে, পরের বাড়িতে কাজ করে খান, রাজনীতির জগতের কারুর সাথে যোগাযোগ রাখার একটু সময় নেই যাঁদের, তাঁদেরও সব কিছুর চালিকা শক্তি হলো রাজনীতি। যিনি কৃষক তাঁর ফসলের দাম পাবেন কি পাবেন না সেটা তো নির্ভর করে লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভায় বসে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যা ঠিক করে তার ওপরে। বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের ভালোমন্দ - সেটাও তো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। যেমন, কৃষি আইন হয়েছে।

সেই আইন এমন কৃষকদরদী যে, ১০০ দিন পার করেও আইন বদলানোর দাবিতে নাওয়া-খাওয়া ভুলে লাখে লাখে কৃষক রাস্তায় বসে আছে। ৭৫-৮০ শতাংশ টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্র সরকারের থেকেও জোরে চিৎকার করে যাচ্ছে লাগাতারভাবে যে, সরকারের আইন কত ভালো। বিনিময়ে চ্যানেল আর সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় সরকারের বিজ্ঞাপন সহ আরও নানা সুবিধা-অসুবিধায় সরকারের আশীর্বাদ আর ভালোবাসার বন্যা কিভাবে বয়ে গেছে তার খবর কে রাখে। শ্রমিকদের জন্য আইন হলো। মাঠে ময়দানে শাসকদল শ্রমিকদের স্বর্গ এনে দেবার গল্প বলে বেড়ালো। ৭৫-৮০ শতাংশ টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্র বারবার বলতে থাকল সরকারের আইন কত ভালো। যদিও শ্রমিকরা আইন দেখে খেপে আগুন। বিস্ফোরণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। ব্যাঙ্ক, রেল, এলআইসি সহ লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রির জন্য নানা আইন এলো। সরকার ও তার বাজনদার সংবাদ মাধ্যমের আনন্দ আর নাচনকোঁদনের অন্ত নেই। এত ভালো আইন যে আন্দোলন, সংগ্রাম আর ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলেছে দেশজুড়ে। তাও সরকারের টনক নড়ে না। সরকার বোধহয় এখনো বুঝে উঠতে পারছে না যে, মানুষ দেরিতে হলেও বুঝতে পারছে, দেশের সরকার চালায় যে দল মাঠে-ময়দানে বক্তৃতার সময় তারা গরিবের পক্ষে, কিন্তু লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভায় আইন করার সময় তারা শুধু গুটিকয়েক শিল্পপতির পক্ষে।