E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৯ এপ্রিল, ২০২১ / ২৬ চৈত্র, ১৪২৭

পরিবেশ আলোচনা

কয়লা চুরির এপিঠ ওপিঠঃ রাজ্যে এবং কেন্দ্রে

তপন মিশ্র


প্রস্তাবিত মদনপুর দক্ষিণ কয়লাখনি অঞ্চলে এই বনভূমি।

২৪ ডিসেম্বর তারিখে ভারত সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে যে, ছত্তিশগড়ের হাসদেওর মদনপুর দক্ষিণ কয়লাখনি আদানির হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ হলো বিজেপি’র পুকুর চুরি। অর্থাৎ বাংলার কয়লাচুরি যদি তিল হয় তাহলে দেশের কয়লাচুরির ঘটনা তাল। পশ্চিমবাংলায় যে কয়লা চুরি ধরা পড়ল  তাতে চোখ কপালে উঠলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু দেশজুড়ে যে কয়লা চুরির ঘটনা ঘটছে তা শুনলে চোখ আকাশে উঠবে। এরাজ্যে কয়লা চুরি কাণ্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সামনের সারির নেতানেত্রীর পরিবার পরিজন যুক্ত হয়ে গেছে। অবৈধ কয়লা খনি থেকে অবৈধভাবে কয়লা তুলে বাজারে বিক্রির অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে। সেই টাকা ‘কাটমানি’ হিসাবে চলে আসে উপরতলায়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চুরির ভাবনা আর একটু অভিনব এবং সংগঠিত। পুরো খনিটাই বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে এদের সরকার। এখানে দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে আসে এবং সেই কারণে ছত্তিশগড় সরকার এই বিক্রির বিরুদ্ধে সরব। প্রথমটি হলোঃ মদনপুরের মতো এক অত্যন্ত গুরুত্বপূ্র্ণ বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে তার পূরণ হবে কী করে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি অবশ্যই আদানিকে হস্তান্তর ঘিরে। যে খনির অনুসন্ধানের (Prospecting) কাজে প্রায় এক দশক জড়িয়ে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেটা হঠাৎ আদানির হাতে গেল কী করে?

২০১৩ সালে মদনপুরে জীববৈচিত্র্য এবং তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সম্পদের অনুসন্ধান কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখেছি যে, এক অনন্য সম্পদের অধিকারী এই অঞ্চল। হাসদেওর মদনপুর এশিয়ার  সর্ববৃহৎ কয়লার ভাণ্ডার হিসাবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। বিলাসপুর রেল স্টেশন থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে মদনপুর কোল ব্লক। হাসদেও নদীর একদিকে মাটির নিচে রয়েছে সুবিশাল এই কোল ব্লক। এখানে কয়লা অনুসন্ধানের কাজ করে ভারত সরকারের সংস্থা ‘কোল ইন্ডিয়া’। বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি এবং হাতির আবাসস্থল এই অঞ্চলে কয়লাখনির বিরোধিতায় এলাকার মানুষ বড়মাপের আন্দোলন করেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে যে, Forest clearance অর্থাৎ বনভূমিতে কয়লাখনি তৈরির অনুমতি দেওয়ার আগে এক জৈববৈচিত্র্য সম্পদ সমীক্ষা করা দরকার। কিছু মাপকাঠির ভিত্তিতে ‘Go’ বা ‘No go’ অঞ্চল চিহ্নিত করা আবশ্যক হয়। যে সমস্ত মাপকাঠি ঠিক হয় সেগুলি হলো, প্রজাতি বৈচিত্র্য, লুপ্তপ্রায় প্রজাতির উপস্থিতি, গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী প্রজাতির আবাসস্থল, মাটির নিচে এবং উপরে জলের উপস্থিতি, অরণ্যবাসীদের অরণ্যসম্পদের উপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলে অরণ্য ধ্বংস করে কয়লা খনি খনন উচিত হবে কিনা তা ঠিক হবে। অনুসন্ধানের পরে দেখা যায় যে, এই অঞ্চল No go অর্থাৎ এখানে খনন করলে প্রকৃতির সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

১০ বছর পর সরকারি সংস্থা কোল ইন্ডিয়ার পরিবর্তে এই গুরুত্বপূর্ণ কয়লা খনি চলে যাচ্ছে আদানির হাতে। রাজ্য সরকারকে কোনভাবেই সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। ইতিমধ্যে এই এলাকার ১০টি গ্রামসভা এর প্রতিবাদ করেছে। পঞ্চায়েত আইনের  Panchayats (Extension to Scheduled Areas) Act বা PESA Act ১৯৯৬ এবং অরণ্য অধিকার  Forest Rights Recognition Act ২০০৬ অনুযায়ী গ্রামসভা এবং অরণ্যবাসীদের অনুমতি ব্যতিরেকে এই ধরনের খনন কাজ অসাংবিধানিক। একটা সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশ মিনেরাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এপিএমডিসি)-কে খনির স্বত্ব দেওয়ার কথা হয়। এই অনুযায়ী এপিএমডিসি প্রিফিজিবিলিটি স্টাডি (Prefeasibility study)ও করে। তাদের তথ্য বলছে যে, প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন টন কয়লা পাওয়া যাবে।

বিজেপি’র মুকুটে খনি সংক্রান্ত দুর্নীতির আরও বেশ কয়েকটি পালক আছে। কর্নাটকের লোহা খনি মাফিয়া রেড্ডি ব্রাদার্সের সঙ্গে সে রাজ্যের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার সম্পর্ক, গোয়ার লোহাপাথর খনি দুর্নীতি ইত্যাদি।

হাসদেও-আরনাদ বনাঞ্চল ছত্তিশগড়ের সরগুজা, সুরাজপুর এবং কোরবা এই তিন জেলার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। এরইমধ্যে মদনপুর উত্তর এবং মদনপুর দক্ষিণ। মদনপুর দক্ষিণ কয়লাখনির এলাকা হবে ৭১২ হেক্টর। এই অঞ্চল লেম্রু হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পের অন্তর্গত। এই এলাকার মধ্যে ৪৯০ হেক্টর জমি ঘন জঙ্গল অধ্যুষিত। বাকি অঞ্চল কম ঘনত্ব যুক্ত বনাঞ্চল বা চাষ জমি। কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল চলে যাচ্ছে আদানির হাতে।

এখানে অন্য একটি প্রশ্ন আসতেই পারে। আসানসোল, জামুরিয়া রানিগঞ্জ এলাকায় যেখানে কয়লা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেখানে সরকারি সংস্থা ইসিএল (ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেড) সেই এলাকার সংরক্ষণে যে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা না নিয়ে এই সম্পদ চোরেদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন? পরে অবশ্য ইসিএল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় থানায় চুরির অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু ঠিক নির্বাচনের আগে কেন? এসব তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। বিজেপি তো দু’কান কাটা। দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যক্তি মালিকানার হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে এলাকার মানুষকে। সম্ভবত দু’দলের নির্বাচনী প্রচারে নেতানেত্রীদের ঘোরার জন্য বরাদ্দ হেলিকপ্টারের রসদ আসে এখান থেকেই। এই দুই লুঠের মধ্যদিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ।