E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

এগারো বছর পর এমন উজ্জীবিত মিছিল দেখল পিড়াকাটা

সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের রাজনীতিকে পরাস্ত করেছে হাজারো মানুষের শ্রেণিচেতনা

মেঘনাদ ভূঞ্যা


পিড়াকাটায় মিছিলে সুশান্ত ঘোষ, মেঘনাদ ভূঞ্যা সহ নেতৃবৃন্দ।

৪ ডিসেম্বর, ২০২২ এই প্রথম শালবনী ব্লকের পিড়াকাটাতে অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত কৃষক সভা,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কাউন্সিল সভা। এই উপলক্ষে পিড়াকাটাতে কৃষকদের বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় সংগঠনের শালবনী ব্লক কমিটি। ধামসা মাদল বাজিয়ে মিছিলে অংশ নেয় অসংখ্য মানুষ। গত ১১বছরে এত বড়ো উজ্জীবিত মিছিল দেখেনি এলাকার মানুষ। সংগঠিত হয় সভা।

মাওবাদী-তৃণমূল সৃষ্ট সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের রাজনীতি এখনো মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। ঘাতক বাহিনীর হাতে খুন হয় অধুনা ঝাড়গ্রাম সহ অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৩৭৫জন বামপন্থী নেতা ও কর্মী। শালবনী ব্লকে খুন হয় ৬২ জন। এদের ১৬ জনের দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়। তদানীন্তন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটানো হয় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি।

সভাতে উপস্থিত ছিলেন ৬২ জন শহিদ পরিবার এবং হাতির আক্রমণে নিহতদের পরিবারের মানুষ। সভার শুরুতে শহিদ এবং নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করে সমবেত জনতা। সমবেদনা জানানো হয় নিহতদের পরিবার পরিজনদের। পুষ্প স্তবক সহ শীতের কম্বল দিয়ে সম্মান জানানো হয় তাঁদের। হাজারো কণ্ঠে স্লোগান ওঠে - তোমরা বিশ্রাম নাও সহযোদ্ধা। বেঁচে আছো, আছো আমাদের মাঝে। আন্দোলনের ময়দানে। শ্রেণি চেতনায়।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সামন্ত জমিদারদের অত্যাচার,নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসংখ্য সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে বনাঞ্চলের মানুষের। চোয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল শালবনী ব্লক। ঘৃণা সৃষ্টির জন্য চুয়াড় নাম দিয়েছিল ব্রিটিশরা। আসলে এই বিদ্রোহ ছিল চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত সহ ব্রিটিশের ভূমি ও রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে অত্যাচারিত নিম্নবর্গীয় তথা পিছিয়ে পড়া জনজাতির মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াই।

পরবর্তী সময়ে জমি ও মজুরির লড়াই, আদিবাসী সহ পিছিয়ে পড়া দলিত জনজাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে লড়াই সহ অসংখ্য আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয় কৃষক আন্দোলন। মজবুত হয় বামপন্থী আন্দোলনের শ্রেণি ও গণ ভিত্তি। গরিব মানুষের গড়ে উঠা শ্রেণি ঐক্য দূর্বল করতে অতীতের মতো বর্তমানেও জাতি ও সম্প্রদায়গত সুড়সুড়ি,বিভ্রান্তি ও প্রলোভন দিয়ে চলেছে কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিরা, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদল।

তৃণমূল সরকারের ১১ বছরে তীব্র হয়েছে বনাঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার সংকট। বন সৃজন এবং বন সুরক্ষা কমিটি গঠন করে মানুষের আয় বৃদ্ধির কাজে সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক পলগেটি পুরস্কার পেয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৃণমূল জমানায় ধ্বংস হচ্ছে জঙ্গল। অসাধু ব্যবসায়ী ও শাসকদলের যোগসাজসে লুঠ হচ্ছে জঙ্গলের দামি কাঠের গাছ। হাতির হানায় ফসল নষ্ট, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, জীবন হানি সহ ক্ষতি হচ্ছে বিশাল। ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন না উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ। ধ্বংস হয়েছে বিশেষত আদিবাসী মানুষদের উন্নয়নের জন্য গড়ে ওঠা ল্যাম্পস সোসাইটিগুলি। বন্ধ হয়ে গেছে বা ধুঁকছে স্বসহায়ক গোষ্ঠীগুলি। কার্যকর হয়নি বনাধিকার আইন।

দালাল জমি মাফিয়াদের সাথে শাসকদল ও ভূমি দপ্তরের একাংশের যোগসাজসে চলছে জমির বেআইনি হস্তান্তর। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় টাকা বরাদ্দ বন্ধ। বিভিন্ন সামাজিক সহায়তা প্রকল্পগুলি হয় বন্ধ অথবা বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। কৃষিকাজে যন্ত্রের বিকাশের ফলে কৃষিতে কাজ কমেছে। ফসলের লাভজনক দাম নেই। রেগায় কাজ বন্ধ। কাজের বকেয়া মজুরি পাচ্ছেনা। পঞ্চায়েতগুলি এত চুরি করেছে যে, কাজের হিসাব দিতে পারছে না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে পাঁচশো টাকার অনুদানে পেট ভরেনা। বাধ্যহয়ে রাজ্যের বাইরে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। গঞ্জের দোকানগুলিতে বেচাকেনা তলানিতে। কারণ কৃষক সহ গরিব সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। বাড়ছে ক্ষুধা অপুষ্টি।

এই প্রেক্ষাপটে কৃষক সহ বনাঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা সমাধানের দাবিতে কৃষক সভার নেতৃত্বে ক্রমশ তীব্র হচ্ছে আন্দোলন। হাতির হানায় ক্ষতিগ্রস্তদের ও নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিভাগীয় বনাধিকারিক সহ রেঞ্জার অফিসগুলিতে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সহ দীর্ঘসময় ধরে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন মানুষ।

গোয়ালতোড়ে দুর্গাবাঁধে এক হাজার একর জায়গা জুড়ে সরকারি বীজ খামারে তৈরি হতো উন্নত মানের কৃষি বীজ। উপকৃত হতেন কৃষকেরা। কাজ করতো স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক। এই বীজখামার তুলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার। প্রথমে শিল্প হাবের নামে পাঁচিল দেয়। উদ্বোধন করে পাথর পোঁতা হয়। কোনো শিল্প হয়নি। পরে এই জমি কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হয়েছে করপোরেটের হাতে। বলা হচ্ছে এখানে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে।

কৃষকদের বক্তব্য, তাঁরা সৌর বিদ্যুতের বিরোধী নয়। কিন্তু সেজন্য বীজ খামার তুলে দেওয়া হবে কেন? বনাঞ্চলে অনেক ডাহি জায়গা পড়ে রয়েছে। ইস্পাত প্রকল্পের জন্য জিন্দালকে দেওয়া হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার একর জমি। ইস্পাত কারখানা হয়নি। একটি সিমেন্ট কারখানা করেছে বড়োজোর ৫০০ একর জায়গায়। বাকি অব্যবহৃত জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করে চালু করুক সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র - উঠেছে এই দাবি।

তাছাড়া বেসরকারি এই বিদ্যুৎ বিক্রি হবে ৩০ থেকে ৪০ টাকা প্রতি ইউনিট দরে। বনাঞ্চলের মানুষের কোনো উপকার হবেনা। কারণ তাদের এত টাকায় বিদ্যুৎ কেনার ক্ষমতা নেই। কাজ পাবে বড়োজোর ১৫০ জন দক্ষ শ্রমিক।

কৃষকের দাবি, দুর্গাবাঁধে এক হাজার একর জায়গায় সরকারি উদ্যোগে পুনরায় চালু করতে হবে বীজ খামার। উন্নত মানের বীজ তৈরি করে কৃষকদের সরবরাহ করতে হবে সুলভ মূল্যে। কার্গিল, মনসান্টোর মতো কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থা একচ্ছত্র দখল করেছে বীজের বাজার। দাম বেড়েছে বহুগুণ। মুনাফা করছে কোটি কোটি টাকা। তাছাড়া বীজ খামারে কাজ পাবে আড়াই হাজার শ্রমিক।

সরকারি উদ্যোগে অন্যত্র তৈরি হোক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বনাঞ্চলে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষদের মাসে ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে বিনা পয়সায়।

দুর্গাবাঁধে বন্ধ করে দেওয়া বীজ খামার পুনরায় চালুর দাবিতে কৃষক সভার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয় লাগোয়া বনাঞ্চলের কৃষকেরা। শামিল অন্যান্য অংশের মানুষ। দেড় সহস্রাধিক কৃষক ঘেরাও করে ব্লক ভূমি দপ্তর। দীর্ঘক্ষণ চলে পথ অবরোধ।

আদিবাসী মানুষ, বর্গাদার পাট্টা প্রাপকদের অধিকার রক্ষার লড়াই, দুর্নীতি ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছোটো বড়ো অসংখ্য সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বনাঞ্চলে বিকশিত হচ্ছে লাল ঝান্ডার লড়াই। তৃণমূল সম্পর্কে ক্ষুব্ধ মানুষ। মোহভঙ্গ ঘটছে বিজেপি সম্পর্কে। মানুষ চাইছে আরও বেশি করে যোগাযোগ গড়ে তুলুক কৃষক সভা। বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা। লাল ঝান্ডার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে বলে আনন্দে উল্লসিত ছিল কায়েমি স্বার্থের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তাদের কপালে এখন ভাঁজ পড়েছে। এভাবে লালঝান্ডা শেষ করা যায়না। পিড়াকাটার বিশাল মিছিল জানান দিয়েছে সংগ্রামের নতুন বার্তা। জেগে উঠেছে শাল মহুয়ার দেশ। শহিদের রক্তে ভেজা মাটি, গভীর অরণ্যের সবুজ বনানীতে লাল ঝান্ডার হিল্লোল। আগামীর বোধনে আরও তীব্র হবে বনাঞ্চলের মানুষের লড়াই।