৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সারা ভারত কৃষক সভার ৩৫তম সম্মেলনের অভিমুখে
হান্নান মোল্লা
কৃষক সভার ৩৩তম সম্মেলনের সময় থেকেই কৃষক আন্দোলনে এক নতুন ধারার উদ্ভব হয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে, প্রভাব বাড়াতে, সংগঠনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং যৌথ সংগ্রামের প্রতি অন্যান্য সংগঠনের আগ্রহ তৈরিতে সাহায্য করতে স্বাধীন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার প্রতি কৃষক সভা সবসময় জোর দিয়েছে। এই লক্ষ্যেই স্লোগান দেওয়া হয়েছিলঃ “সব গ্রামে কৃষক সভা এবং সব কৃষক কৃষক সভায়”। সারা ভারত কৃষক সভা (এআইকেএস)’র সমগ্র ইতিহাস এটাই প্রমাণ করেছে। একইসাথে যুক্ত কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রতিও সম-গুরুত্ব দিয়েছে কৃষক সভা। যদিও যুক্ত আন্দোলনে টেনে আনার এই প্রচেষ্টা কম-বেশি সীমাবদ্ধ ছিল বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির মধ্যেই, কেননা আন্দোলন-সংগ্রামের ইস্যুগুলিকে নিয়ে তাদের মধ্যে একটা সাধারণ বোঝাপড়া এবং মতাদর্শগত ঘনিষ্ঠতা আছে। যুক্ত আন্দোলনে অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলিকে নিয়ে আসার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে বাম কৃষক আন্দোলনের মধ্যেও কিছু সংরক্ষণ ছিল। শ্রেণিচরিত্র বজায় রাখার ব্যাপারে তাদের উদ্বিগ্নতা ছিল এবং ভয় ছিল মতাদর্শগত বিচ্যুতির। যদিও পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে বেনারস কৃষক সম্মেলনে আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটাতে কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করা হয় এবং মধ্য ও ধনী কৃষকদের দাবিদাওয়ার প্রতি নজর দেওয়া হয়। গরিব ও ভূমিহীন কৃষক, খেতমজুর এবং গ্রামের গরিবদের প্রয়োজনীয় বিষয় ও দাবিগুলির জন্য লড়াইয়ে আমাদের যে বুনিয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বজায় রেখেই কৃষক সমাজের ধনী অংশের মধ্যে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিসমূহ এবং ফসলের দাম, ঋণগ্রস্ততা, উৎপাদন খরচ, আমদানি নীতি, বিপণন, পরিবহণ, ভরতুকি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত দাবিদাওয়া নিয়ে যে দ্বন্দ্বগুলি বিকশিত হচ্ছে তাকে আমরা কখনই উপেক্ষা করতে পারি না।
যুক্ত আন্দোলন
একবিংশ শতকের প্রথম দশকে নয়া-উদার নীতিসমূহের আগ্রাসী রূপায়ণের বিরদ্ধে কৃষিনীতিসমূহের পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিল এআইকেএস এবং কৃষক আন্দোলন। এরফলে ইউপিএ সরকারের সময় অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬, এমএনরেগা, জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ এবং স্বামীনাথন কমিশনের মতো কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু ওই নীতিসমূহের সম্পূর্ণ রূপায়ণ ঘটেনি, ইতিমধ্যে ইউপিএ সরকারের পরাজয় ঘটে, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন। করপোরেট পুঁজি মোদিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। এবং সেই কারণে তিনি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করেন যার মধ্যদিয়ে করপোরেটকে বাড়তি সুযোগ করে দেওয়া হয়। করপোরেট, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্তধর্মী স্বৈরাচারী সরকার দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা পুরোদস্তুরভাবে নয়া-উদারনীতির প্রয়োগ শুরু করে। প্রথম আক্রমণ আসে ২০১৪ সালে জমি অধিগ্রহণ অর্ডিনান্সের মধ্যদিয়ে।জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩-এ যে সীমিত সুযোগ কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল এই অর্ডিন্যান্সে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এক বিরাট সংখ্যক গণ ও সামাজিক সংগঠনসমূহ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে হাত মেলায়। এই আন্দোলন চলে তিন বছর। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রথম ৭০টি সংগঠনের বৃহৎ মঞ্চ ‘ভূমি অধিকার আন্দোলন’-এর উদ্ভব ঘটে। কৃষক ও অন্যান্য অংশের মধ্যে এই অর্ডিনান্সের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে আমরা সফল হয়েছিলাম।
ভূমি অধিকার আন্দোলন চলার সময়েই মোদি সরকার কৃষকদের ওপর নতুন আক্রমণ নামিয়ে আনে। মোদি শতাধিক নির্বাচনী সভায় প্রতিশ্রুতি দেন, যদি তিনি ক্ষমতায় ফেরেন, তাহলে তিনি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, সব কৃষকের এককালীন ঋণমকুবের মতো স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলি রূপায়ণ করবেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি প্রতিশ্রুতি পালন থেকে সরে এলেন এবং সুপ্রিম কোর্টে এফিডেভিট দিয়ে জানালেন, তার সরকার স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো ফসলের দাম দিতে পারবে না এবং এও ঘোষণা করলেন কৃষকদের ঋণমকুব করতে পারবে না সরকার। এই দুই ও অন্যান্য দাবিতে এআইকেএস এবং অন্য আরও সংগঠন প্রচার শুরু করল, হাত মেলালো এবং ২০১৭ সালের ২০ জুন দিল্লিতে জাতীয় কনভেনশন সংগঠিত হলো। বিভিন্ন শ্রেণি ও মতাদর্শের প্রায় ১২০টার মতো সংগঠন এই কনভেনশনে যুক্ত হয়। অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিস)’র নামে কৃষক সংগঠনগুলির এক বিস্তৃততর ও বৃহত্তর মঞ্চের উদ্ভব ঘটে। শস্য সংগ্রহে সুনিশ্চিতিকরণ সহ সমস্ত শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইন প্রণয়ন এবং এককালীন সব কৃষকের ঋণমকুব - এই দুই প্রধান দাবিতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দেশজোড়া সংগ্রামের কথা ঘোষণা করে। এই সংগ্রামে আরও অনেক সংগঠন রাস্তায় নামে এবং প্রায় ২৫০টা সংগঠন এআইকেএসসিসি’র নেতৃত্বে এই লড়াইতে যুক্ত হয়। সাংগঠনিক, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত বিভিন্ন মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইস্যুভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বর্তমান সময়ে একান্ত প্রয়োজন।
যখন এআইকেএসসিসি’র নেতৃত্বে লড়াই চলছে সেইসময়ে হঠাৎ ২০২০ সালের ৫ জুন নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় কৃষকদের বিরুদ্ধে আরেক নতুন আক্রমণ নামিয়ে আনল। কৃষকদের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে তা করপোরেটদের হাতে তুলে দিতে কোনোরকম পরামর্শ ও আলোচনা ছাড়াই মোদি সরকার তিন কালা অর্ডিনান্সের ঘোষণা করল। আমরা এই ষড়যন্ত্রকে অনুধাবন করতে পারলাম। কৃষকদের কাছে এআইকেএস এবং এআইকেএসসিসি এই কালা অর্ডিনান্সের কপি পুড়িয়ে দেওয়ার ডাক দিল। হাজার হাজার স্থানে কৃষকেরা অর্ডিনান্সের কপি পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাল। এই কালাকানুনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর দিল্লিতে এক জাতীয় কনভেনশন সংগঠিত করে এআইকেএসসিসি। এআইকেএসসিসি’র ২৫০টি সংগঠন সহ আরও ২৫০টি সংগঠন এই কনভেনশনে অংশ নেয়। আমরা প্রস্তাব দিলাম, আমাদের সবার কালাকানুনের বিরোধিতার উদ্দেশ্যটা একই এবং শত্রুও সেই একই কেন্দ্রীয় সরকার। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলা উচিত। কনভেনশনে সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়, এই কালাকানুনগুলির বিরুদ্ধে এবং শস্য সংগ্রহ সুনিশ্চিতিকরণ সহ সব শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য আইন প্রণয়নের দাবিতে যৌথ আন্দোলন সংগঠিত করা হবে। কনভেনশন থেকে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর ‘দিল্লি চলো’র ডাক দেওয়া হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, এই আন্দোলন সংযুক্ত কৃষক মোর্চা (এসকেএম)’র ব্যানারে হবে। এসকেএম হলো ৫০০ সংগঠনের এক নতুন যৌথ মঞ্চ। এর পরের ঘটনাতো ইতিহাস।
বিভিন্ন রাজ্য থেকে দিল্লির উদ্দেশে কৃষক পদযাত্রা শুরু হলো। পাঞ্জাব থেকে সবথেকে বড়ো বাহিনী এসেছিল। এছাড়াও হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তরাখণ্ড থেকেও কৃষকরা এসেছিলেন। শ্রমিকদের করপোরেটের দাসে পরিণত করতে মোদি সরকার প্রণীত চারটি শ্রম বিধির বিরুদ্ধে সহ কৃষকদের দাবির সমর্থনে ওই একইদিনে ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ভারত বনধের ডাক দেয়। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক যৌথ সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হলো।
পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে লক্ষাধিক কৃষক শান্তিপূর্ণভাবে ধরনায় বসলেন। কৃষকদের ওপর বহু আক্রমণ নামিয়ে আনে মোদি সরকার। জল, শৌচালয়ের ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ করতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। খালিস্তানি, পাকিস্তানি, চীনের দালাল, মাওবাদী সন্ত্রাসী প্রভৃতি বলে কৃষকদের মনোবল ভেঙে দেওয়া চেষ্টা হয়েছে। সরকারের পা-চাটা সংবাদমাধ্যমগুলি সরকারের প্রচারমূলক বিবৃতি এবং আরএসএস-বিজেপি’র মিথ্যা প্রচারের টানা প্রতিধ্বনি ঘটিয়ে গেছে। কিন্তু কৃষকরা অদমিত থেকেছেন। স্বাধীনতার পর এটাই ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘতম ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এটা ছিল কৃষকদের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলনও। আবার আমাদের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন। প্রায় ৫০০ সংগঠন কোনো মতপার্থক্য ছাড়াই এই আন্দোলন পরিচালনা করেছে। এই আন্দোলনকে ভেঙে দিতে সরকার অপবাদ ও মিথ্যা প্রচারের মতো ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক কৌশল এমনকী সুপ্রিক কোর্টকেও ব্যবহার করেছিল আন্দোলন ভাঙতে। সবই বৃথা গেছে। সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। এমনকী আন্দোলনকে অপদস্ত করতে সাধারণতন্ত্র দিবসে হিংসার যে কৌশল সরকার নিয়েছিল তাও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদি হঠাৎ একতরফাভাবে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর কালাআইনসমূহ প্রত্যাহার করে নেয়। কৃষক-বিরোধী, জাতীয়তা-বিরোধী ফ্যাসিস্তধর্মী সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় কৃষকদের এটা ছিল সর্বোত্তম বিজয়। শেষপর্যন্ত আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী স্বৈরাচারীকে পরাস্ত করলাম। কৃষকদের এবং জনগণের মধ্যে এটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। আমাদের ৩৮৪ দিন ধরে চলা সংগ্রামে শ্রমিক, মহিলা, ছাত্র, যুব, কর্মচারী এবং বিপুল সংখ্যক জনগণের কাছ থেকে বিরাট সমর্থন অর্জন করেছিলাম। তারা সবাই আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। যারা মনে করতেন মোদিকে কখনই পরাজিত করা যাবে না, কৃষক আন্দোলনের এই জয় প্রমাণ করে দিয়েছে, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ থাকি তাহলে আমরা যেকোনো শত্রুকে পরাস্ত করতে পারব। দেশের সমগ্র গণতান্ত্রিক শক্তিকে এই আন্দোলন উৎসাহ জুগিয়েছে। এটা ছিল তুলনাহীন এবং ঐতিহাসিক, ভবিষ্যৎ আন্দোলনের প্রেরণার উৎসস্থল।
ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য শিক্ষা
এআইকেএস’র ৩৪ তম সম্মেলনের ঘোষণা ছিলঃ “ইস্যুভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম কৃষি সংকটকে পরাস্ত করতে পারে” এবং “সব গ্রামে কৃষক সভা, সব কৃষক কৃষক সভায়”। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম দেখিয়ে দিয়েছে ৩৪ তম সম্মেলনের এই ঘোষণার নির্ভুলতা। একদিকে শক্তিশালী স্বাধীন কৃষক সভা এবং অন্যদিকে বিস্তৃত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম - এই ছিল গত সম্মেলনের নির্দেশ। চূড়ান্তভাবে সম্মেলনের আবেদন ছিলঃ “কৃষকদের মধ্যে একতার এবং শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীকে শক্তিশালী করতে আমরা বিশেষ উদ্যোগ নেবো।” সম্মেলন আরও নির্দেশ দিয়েছিলঃ “কৃষির করপোরেটাইজেশনকে বৃহৎভাবে মোকাবিলায় কৃষক সমাজকে সাহায্য করতে হবে এবং কার্যকরী বিকল্প হিসেবে সমবায়ের বিকাশ ঘটাতে হবে।”
বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, সম্মেলনের নির্দেশসমূহকে রূপায়ণ করতে এআইকেএস আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা যতটা সম্ভব বিস্তৃততম যৌথ সংগ্রাম ও যৌথ মঞ্চ তৈরি করেছি যা কৃষকদের নীতিজ্ঞানবর্জিত, স্বৈরাচারী শত্রুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম করেছে এবং তাকে নত করেছে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব এবং মহিলাদের যৌথ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এই প্রক্রিয়া গৃহীত হয়। এরপরই এআইকেএসসিসি এবং এসকেএম’র নেতৃত্বাধীন এই ধরনের বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন গড় ওঠে।
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রথমিক প্রভাবের কারণে গণআন্দোলন মন্থর হয়েছিল এবং সংগঠনের অবনমন ঘটেছিল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পিত আন্দোলন ও কাজকর্ম গ্রাম/তহশিল, জেলা এবং রাজ্যস্তরে সাংগঠনিক কাজকর্মকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করেছে। হ্রাস পাওয়া সদস্য সংখ্যাকে পূরণ করা গেছে এবং ১ কোটি ৩৭ লক্ষে সদস্য সংখ্যা পৌঁছেছে।
সংগঠনের প্রসার ও সক্রিয় করতে শস্যভিত্তিক ফেডারেশন ও সাব-কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত রূপায়ণে এই সময়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া কৃষক সভার কাজকর্মের নিবিড়তা বৃদ্ধি করেছে এবং এক কৃষকদের বৃহৎ অংশকে তার পতাকাতলে আনতে পেরেছে। পি সুন্দরাইয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পুনঃসক্রিয়করণও এই সময়ে কৃষক আন্দোলনকে সাহায্য করেছে।এই উদ্যোগের মধ্যদিয়ে কৃষক আন্দোলন প্রসঙ্গে গবেষণা ও প্রকাশনা আগামীদিনে শক্তিশালী করা যাবে।
এআইকেএস’র ৩৪তম সম্মেলন নয়া-উদারনীতিসমূহের প্রয়োগের ২৫ বছরের মূল্যায়ন করেছিল। যখন অন্য কৃষক সংগঠনগুলি এই নয়া-উদার নীতিসমূহকে সমর্থন জানিয়েছিল তখন এআইকেএস'ই তার ২৭তম সম্মেলনে প্রথম এই নীতিসমূহের বিপদকে ব্যাখ্যা করে। এআইকেএস’র সেই বক্তব্য যে সঠিক ছিল তা প্রমাণ হয়েছে। এই নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে নিবিড় করার কাজকে নির্ণীত করাই আসন্ন ৩৫তম সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি।
এসকেএম-আন্দোলন নিয়ে প্রাথমিক পর্যালোচনায় এআইকেএস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আমরা এই আন্দোলনকে অন্যদের সাথে দেশের সর্বত্র নিয়ে যেতে পেরেছি। কিন্তু দিল্লির বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে এই কর্মসূচির প্রকৃতি ছিল সংহতিমূলক। তাই এআইকেএস নির্দেশ দিয়েছে, আগামীদিনে প্রতিটি রাজ্যে প্রকৃত লড়াই গড়ে তুলতে হবে। ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষকের যৌথ সংগ্রাম এক নতুন সাফল্য। এই নতুন রূপকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, কীভাবে রাজ্য, জেলা, তহসিল এবং গ্রামস্তরে এই ঐক্য গড়ে তোলা যায়, শ্রমিক-কৃষক ঐক্যকে কীভাবে গণআন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলা যায় - এগুলিই আগামীদিনে কৃষক আন্দোলনের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। ৩৫ তম সম্মেলনে এরই রোডম্যাপ তৈরি হবে।
কৃষিকাজের বড়ো অংশটাই করে মহিলারা। কিন্তু সংগঠন বা নেতৃত্বে তাদের কোনো ঠাঁই নেই। সংগঠনের বিভিন্নস্তরে এটা সমালোচনামূলকভাবেই আলোচনা করতে হবে। যৌথ সংগ্রাম প্রসঙ্গে কিছু কমরেডের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিগত কয়েক বছরের সংগ্রামে ও অভিজ্ঞতায় যথোচিতভাবেই মোকাবিলা করা হয়েছে। এটা জাতীয়স্তরে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এবং বৃহৎভাবে রাজ্যস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও একেবারে নিম্নস্তরে এটাকে অতিক্রম করা এখনো যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, রাজ্য ও জেলাস্তরে এসকেএম’র কর্মসূচিগুলি রূপায়ণে এসকেএম’র অন্য শরিকগুলির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এআইকেএস’র উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু এটা হয় না। আগামীদিনে এই দুর্বলতা কীভাবে মুক্ত করা যায় তা দেখবে ৩৫তম সম্মেলন।
গত সম্মেলনের আহ্বান “সব গ্রামে কৃষক সভা, সব কৃষক কৃষক সভায়” উদ্দীপনার সাথে সংগঠন গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সাফল্যটা সর্বত্র ছিল না। যদিও শেষ বিচারে স্বাধীন সংগঠন এবং আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। নতুন দাবিসনদকে জনপ্রিয় করতে, আমাদের লক্ষ্যের প্রচারকে নিবিড় করতে, গ্রামের শেষ কৃষকের কাছে পৌঁছতে, সমাবেশ করার ক্ষমতাকে বিরাট আকারে বৃদ্ধি করতে, কৃষক ও সমাজের অন্য অংশ - ছাত্র, যুব, মহিলা, দলিত, আদিবাসী এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তাকে পূরণ করতে আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে। এইগুলিই হলো সাফল্য অর্জনের এক-একটা পদক্ষেপ। আমাদের টোকেন কর্মসূচি নেওয়া পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের মিত্রদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করতে এবং গণতন্ত্রের শত্রুদের পরাস্ত করতে জঙ্গি কর্মসূচির ওপর আমাদের জোর দিতে হবে।
১৩-১৬ ডিসেম্বর কেরালার ত্রিশুরে এআইকেএস’র ৩৫তম সম্মেলন হবে। তৃণমূলস্তরে সম্মেলন সংগঠিত করার বিষয়ে এআইকেএস এবারে বিশেষ জোর দিয়েছিল। এব্যাপারে আগের তুলনায় ভালো সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সম্মেলনগুলিতে মহিলা প্রতিনিধি সুনিশ্চিত করা হয়েছিল, এবং এটা একটু ভালোভাবেই এবার করা গেছে। তবু এখনো এটা ভাবনার বিষয়। মহিলা এবং তরুণ কমরেডরা বিভিন্নস্তরের কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন। সম্মেলনগুলিতে আলোচনা উন্নতমানের হয়েছে। এইসবই ৩৫তম সম্মেলনে গুণগত পরিবর্তন আনবে। এআইকেএস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে কিংবদন্তি যোদ্ধা বিরসা মুণ্ডার জন্মদিবস ১৫ নভেম্বর দেশের প্রতিটা গ্রামে ‘পতাকা দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। এদিন দেশের হাজার হাজার গ্রামে এআইকেএস’র পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
সম্মেলনের পতাকা শোভাযাত্রার মাধ্যমে আসবে পুন্নাপ্রা ভায়লার থেকে এবং ফ্ল্যাগপোল আসবে কায়ুর থেকে। পতাকা ও ফ্ল্যাগপোল ত্রিশুরে এসে পৌঁছবে ১২ ডিসেম্বর। দুটি জাঠা যাত্রা শুরু করেছে, তারা একসাথে ১২ ডিসেম্বর সম্মেলনস্থলে এসে পৌঁছবে। প্রথম জাঠাটি শুরু হয়েছে তেলেঙ্গানা সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত এবং এই সংগ্রামে প্রথম শহিদ ডোড্ডি কোমারাইয়ার গ্রাম জনগাঁও থেকে। এই জাঠায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এআইকেএস নেতা পি কৃষ্ণ প্রসাদ। অপর জাঠাটি যাত্রা শুরু করেছে তামিলনাডুর কিঝভেননামি থেকে, যেখানে উচ্চ বর্ণ ও সামন্ত প্রভুদের গুন্ডারা ৪৪ জন খেতমজুরকে খুন করেছিল। এই জাঠার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এআইকেএস’র যুগ্ম সম্পাদক বিজু কৃষ্ণণ। এই দুই জাঠা সালেমে মিলিত হবে, সেখানে কারাগারে নিহত শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবে। সালেমে দুটি জাঠা মিলিত হয়ে সম্মেলনের উদ্দেশে অগ্রসর হবে। জাঠা দুটি যাত্রাপথে অসংখ্য সভা সংগঠিত করছে। ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্যদিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হবে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ত্রিশুরে কৃষক মিছিলের সূচনা করবেন।
(ইংরেজি থেকে ভাষান্তর - শংকর মুখার্জি)