৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষকাল ২৫শে নভেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর
ঈশিতা মুখার্জি
এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রতি ৩ জন মহিলার মধ্যে ১ জন তার জীবদ্দশায় হিংসার স্বীকার হন। এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় ৫ জন মহিলা ও কন্যাশিশু খুন হয় তার পরিবারের মানুষের হাতে। এই মুহূর্তে বিশ্বে নির্যাতিত মহিলাদের ৪০শতাংশেরও কম আইনি সাহায্য বা যে কোনোরকম সাহায্য চায়। আমাদের দেশে জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় ৪৯জন মহিলার বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ঘটে। প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন মহিলা পণজনিত নির্যাতনে প্রাণ হারায়। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, যাদের তারা সমীক্ষা করেছিল, তার একতৃতীয়াংশ মহিলা পারিবারিক বা যৌন হিংসার বলি হন।
পরিসংখ্যানগুলি এই কারণে উল্লেখ করা কারণ, রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণায় প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে ২৫শে নভেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর এই পক্ষকাল নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষকাল বলে পালিত হয়। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সচিব ডাক দিয়েছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি হিংসা বন্ধ করতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। উপরের পরিসংখ্যান দেখে কি বিশ্বাস করা যায় যে মাত্র ৮ বছর বাদে এই নির্যাতন রোধ করা সম্ভব হবে?
২৫শে নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস আর ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এই পক্ষকাল ব্যাপী নানা আলোচনা, নানা স্লোগান সহ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে নারী নির্যাতন বিরোধী মতামতকে সংগঠিত করা হয় প্রতি বছর। কিন্তু তার পরেও এই পরিসংখ্যান আমাদের নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোভিড অতিমারীর সময়ে পারিবারিক হিংসা, কন্যাশিশু বিবাহ, পাচার সব ধরণের নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব জুড়ে মহিলা আন্দোলনও যেমন একদিকে জোরালো হয়েছে, তেমনি নারীবিদ্বেষও প্রকট হয়েছে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কি অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে? কেন নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না? সবচেয়ে ধনী উন্নত পুঁজিবাদী দেশে এই নির্যাতন সবচেয়ে বেশি তা রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টে প্রকাশ। আমাদের দেশ লুঠেরা পুঁজিবাদের কবলে নারী নির্যাতন, নারী বিদ্বেষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাড়ছে।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের অপরাধীদের ৭৫ শতাংশ শাস্তি পায় না। বিলকিস বানু কেসে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেল। নির্ভয়ার খুনিরাও মুক্ত হওয়ার পথে। শ্রদ্ধাকে খুন করে দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। ইদানীং ঘটনাগুলো দেখলে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে অপরাধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। সরকারিভাবে মনুস্মৃতি স্বীকৃতি লাভ করছে। মহিলাদের পিছিয়ে থাকা নিয়ে সরকারিভাবে অভিমত তৈরি এবং তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এই সবকিছু কি এই পক্ষকাল পালন করার উদ্দেশ্য লঙ্ঘন করা নয়?
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো এই পক্ষকালের মধ্যে। তারা নারীর প্রতি হিংসার বিরুদ্ধে ও নারীর মর্যাদা রক্ষার দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সম্মেলনে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যেভাবে আমাদের দেশে সম্প্রতি প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, খুন, বধূহত্যা, পণ নেওয়া, কন্যাভ্রূণ হত্যা, পাচার, পুড়িয়ে দেওয়া, মদ্যপান করে মহিলাদের পেটানো বেড়েই চলেছে। আমাদের রাজ্যে পরপর হিংসার ঘটনা ঘটেছে কাটোয়া, কামদুনি, রায়গঞ্জ, রানাঘাট, বাঁকুড়া, ধূপগুড়ি, হাসখালি, ইত্যাদি স্থানে। এসব জায়গায় নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ অপরাধীদের আড়াল করেছে। এখনো আদিবাসী মহিলাদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে খুন করা হয়। নারীবিদ্বেষী উক্তি সহজেই উচ্চারিত হচ্ছে দেশের ও রাজ্যের শাসকদের মুখে।
এই নির্যাতন মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি পরিকাঠামো বা সাহায্য নেই। সর্বোপরি রয়েছে অপরাধীদের শাসক গোষ্ঠীর প্রকাশ্য প্রচ্ছন্ন মদত। এই অপরাধ জগতের সাথে লুঠের রাজনীতির যোগাযোগ স্পষ্ট। আমাদের রাজ্যে নারী নির্যাতনের কোনো পরিসংখ্যান সংগৃহীত হয় না গত এগারো বছরে। নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষকাল নিয়ে কোনো সরকারি বিবৃতি না কেন্দ্রের সরকার দিয়েছে, না রাজ্যের সরকার দিয়েছে। পরিসংখ্যানগুলি দেশবাসী, রাজ্যবাসী সকলকে মাথা নিচু করে দিলেও সরকারের কোনো হেলদোল নেই। নারী নির্যাতনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এভাবেই তো দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন দেশের, রাজ্যের সব অংশের মানুষের তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন। এই আন্দোলন সামাজিক, রাজনৈতিক। এই আন্দোলনে মহিলাদের সঙ্গে সারা বিশ্বে থাকছে সব অংশের মানুষ। গণ আন্দোলন ছাড়া এই পক্ষকাল পালন করা সম্ভব হবে না।