E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

১০০ দিনের কাজ বন্ধের দায় কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার এড়াতে পারে না

অমিয় পাত্র


এ রাজ্যে রেগায় কাজ বন্ধ। শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। গৃহহীন গরিবের জন্য পাকা ছাদযুক্ত আবাস নির্মাণ বন্ধ ছিল, আবার শুরু হবে, কার বাড়ি হবে সেটা কে ঠিক করবে? পুলিশ নাকি অন্য কেউ তাই নিয়ে মহাবিরোধ। গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সবটার পিছনে কারণ একটাই দুর্নীতি, সীমাহীন দুর্নীতি। ১০০ দিনের কাজ বা রেগার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনের ২৭ নং ধারার উল্লেখ করেছে। কী আছে আইনের এই অংশে?

Power of Central Government to give directions:

(1) The Central Government may give such directions as it may consider necessary to the State Government for the effective implementation of the provisions of this Act.

(2) Without prejudice to the provisions of sub-section (1), the Central Government may, on receipt of any complaint regarding the issue or improper utilisation of funds granted under this Act in respect of any Scheme if prima facie satisfied that there is a case, cause an investigation into the complaint made by any agency designated by it and if necessary, order stoppage of release of funds to the Scheme and institute appropriate remedial measures for its proper implementation within a reasonable period of time.

রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগের আধিকারিক এমনকী ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁরা সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আর্থিক বছরের প্রায় ৯ মাস অতিক্রান্ত আজ পর্যন্ত একটি দুর্নীতির ঘটনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য, আধিকারিক যেভাবে এই বিপুল আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন তাতে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হলে জেলের বাইরে কেউ থাকবেন না। দুর্নীতির এই ব্যাপকতা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়। জেনে বুঝেই চোরদের আড়াল করা হচ্ছে। পঞ্চায়েত, সমবায়, বালি খাদান, কয়লা খাদান, গোরু পাচার কে কোথায় করে খাবেন তার ব্যবস্থা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করেন। তাই তাঁর পক্ষে দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব। মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব হলো - চোর থাকবে, লুটপাটও থাকবে, উনিও থাকবেন।

আমাদের সামনে প্রধান প্রশ্ন রাজ্যের ৩.৪২ কোটি নথিভুক্ত জব ওয়ার্কারদের কী অপরাধ? আইন চালু হয়েছে এই কর্মহীন শ্রমজীবীদের জন্য। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে কাজ করা সত্ত্বেও এদের মজুরি মিটিয়ে দেওয়া হয়নি। রাজ্যের শ্রমজীবীদের প্রাপ্য ২৬১০ কোটি টাকা অনাদায়ী। কেন্দ্র ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের জন্য লেবার বাজেট অনুমোদন করেনি। রাজ্য সরকার চাইছে চোর জোচ্চোরদের গায়ে হাত না দিয়ে পুনরায় কাজ চালু হোক। প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা যারা লুটেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো এফআইআর পর্যন্ত করা চলবেনা। এটা কি সমাধানের কোনো নিদান হতে পারে? রাজ্য সরকার ৩.৪২ কোটি শ্রমজীবীদের কাজের স্বার্থে আইনের আশ্রয় নিতে পারত, কিন্তু সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

রেগার কাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ছিল সমস্ত কাজের সামাজিক নিরীক্ষা। এই সামাজিক নিরীক্ষার মুখ্য ভূমিকা থাকার কথা প্রকল্পের উপভোক্তাদের। যে সভায় প্রকল্পের নিরীক্ষা হয় তার এক মাস পূর্বে বিস্তারিত তথ্য, হিসাবের খাতা, বিল ভাউচার, মাস্টাররোল, প্রকল্পের উদ্দেশ্য, প্রকল্পের অগ্রগতি জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করতে হবে। নিরীক্ষা সভায় জব ওয়ার্কারদের উপস্থিতি, তাদের বক্তব্য রাখা আবাধ হতে হবে। এই সামাজিক নিরীক্ষার নির্যাস রাজ্য বিধানসভায় পেশ করা হবে। রাজ্যের বর্তমান সরকার প্রকল্প রূপায়ণের এই সামাজিক দিকটা কার্যত তুলে দিয়েছে। রাজনৈতিক দল ও জো হুজুর আমলাদের সমানে মাতব্বরি চলছে। সমালোচনামূলক কোনো কথাই বলতে দেওয়া হয়না। ইদানীং গ্রামের শ্রমজীবীরা কেউ মনে করেন না - এটা তাদের অধিকার, তাদের অংশগ্রহণেই এই কাজের সম্পূর্ণতা। রাজ্যে যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এই নিয়োগের একটা দীর্ঘ মেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব জানার পরও রাজ্যের সুশীল সমাজের থেকে যে প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত ছিল তা দেখা যাচ্ছে না। এটাই স্বাভাবিক। এই দুর্নীতির অর্থে বহু সেলিব্রিটি, কবি, শিল্পী, সুশীলদের পুষতে হয়। এই অর্থ ভাণ্ডার দিয়েই মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট হয়। এটা ভেবে দেখার সময় রাজ্যের শাসক দল ও সরকার কীভাবে লুটপাট, দুর্নীতিকে গোটা সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজ এবং স্বচ্ছতার বিষয়টি দেখতে হবে। টাকা লুটপাট হচ্ছে তাই আমি প্রতিবাদী, লুটের অর্থ যখন আমার অ্যাকাউন্টে আসছে তখন আমি নীরব দর্শক। সবাই এভাবে অবস্থান পরিবর্তন করে এমনটা নয়। তবে মানসিক পরিবর্তনে কাঁচা টাকার ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প আইন প্রণয়নের সময়কাল স্মরণে রাখা দরকার। ২০০৫ সাল, কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকার। বামপন্থীদের নেতৃত্বে কাজের অধিকার আইনসিদ্ধ করার উদ্যোগ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার জন্য কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল সরকার ও বামদলগুলির সমন্বয় কমিটিতে। সেই কর্মসূচির অন্যতম ছিল গ্রামের গরিবদের জন্য বছরে ২০০ দিন কাজ দিতে হবে। সরকার পক্ষ আর্থিক সংস্থানের প্রশ্ন উত্থাপন করে ওই বছরের জন্য ১০০ দিনের কাজের অধিকারকে আইনিরূপ দেওয়ার প্রস্তাব করে। তার ভিত্তিতে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন-২০০৫ (MGNREGA) তৈরি হয়। এই কাজের অধিকারের আইনি সুরক্ষা দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেগার কাজ প্রসংশিত হয়। কাজের অধিকারের স্বীকৃতি এবং একই সাথে সম্পদ সৃষ্টির উদ্যোগ এক কার্যকর প্রয়াস বিশেষত সেই সব দেশ যারা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ক্যাশ ট্রান্সফারের বেশি ভাবতে পারেনি।

পশ্চিমবাংলার মানুষ কাজ, খাদ্য, মজুরি,আবাস, পানীয়জল ও জমির অধিকারের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন দেখেছে। আন্দোলনের ফলেই কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাস জমির পাট্টা, বাস্তু জমির ব্যবস্থা, মজুরি বৃদ্ধি, ভাগচাষের অধিকার নথিবদ্ধ করা - এমন অনেক অধিকার আমরা পেয়েছি। ১০০ দিনের কাজ, স্কুলে দুপুরের খাবার, খাদ্য সুরক্ষা আইন, জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার এসবই লড়াইয়ের প্রাপ্তি। প্রতিটি লড়াইয়ে গরিবের হাতে ছিল লালঝান্ডা। আজ যারা শাসক তারা কোনোদিন সংসদে বা মাঠে ময়দানে গরিবের আন্দোলনের পাশে ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবেনা। লড়াই শোষিত, বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে গরিবের শ্রমের মূল্য হজম করা জমিদার, পুঁজিপতিদের।

কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় প্রতি বছর রেগায় বরাদ্দ কমিয়েছে। চলতি বছরে কমেছে ২৫.৫ শতাংশ। ঠিক তার আগের বছর বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে ৪১ শতাংশ। রেগার কাজ সম্পর্কে একটি সাম্প্রতিক স্টাডি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে সক্রিয় জবকার্ড আছে এরূপ প্রতিটি পরিবারের জন্য ১০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করতে হবে ২.৬৪ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বছরের বরাদ্দের পরিমাণ ৭৩০০০ কোটি টাকা। এ থেকেই বোঝা যায় মোদি সরকারের এই প্রকল্প সম্পর্কে সদিচ্ছা কেমন।

এ বছর রাজ্যে চাষের উপযোগী বৃষ্টি সময়মতো হয়নি। বহু জমি অনাবাদী থেকে গেছে। বীজ, সার, কৃষি সরঞ্জাম কেনার এক বছরের ঋণ বরবাদ হলো। কে শুনবে কৃষকের যন্ত্রণা? গ্রামের গরিবের খেতেও কাজ নেই, রেগাতেও কাজ নেই। মজুরি প্রতিদিন কমছে অন্যদিকে জীবনধারণের খরচ বাড়ছে। তাই বাঁচার জন্যই সংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এদের কাছেই যেতে হবে। এদের কথা শুনতে হবে। বই পড়ে, বক্তৃতা শুনে বা টিভি-সংবাদপত্রের তথ্যে সবটা জানা যায়না। সমাজকে, সমাজের ব্যাধিকে জানতে মানুষই বড়ো শিক্ষক। কবে, কোথায় নিম্নচাপ হবে, ঝড়বৃষ্টি হবে সেটা আবহাওয়া অফিস থেকে সূচনা দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক মন্দা, বাজারের পতন-উত্থান সম্পর্কে সূচনা দেয় অর্থনীতি জগতের পণ্ডিতরা। সাধারণ মানুষের এসব জানা নেই। প্রলয় যখন আসে কেবল তখনই এরা টের পায়। এটা আমাদের দায় আমজনতাকে অবহিত করা। এটা আমাদের কাজ মানুষের পাশে থেকে তার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আজকের দিনের আক্রমণ সংগঠিত আক্রমণ। সমাজের সব অংশকে যুক্ত করেই এই বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।