৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সাম্প্রদায়িক হিংসার নির্মাণ এবং মোদি জমানা
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
গুজরাট দাঙ্গা ২০০২।
সাম্প্রদায়িক হিংসা আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসে একটি অবিরত কালো দাগ যা শাসকের প্রয়োজনে প্রলম্বিত হয়। এর মানে এই নয় যে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠী সংঘর্ষের কোনো নেতিবাচক পরম্পরা প্রাচীন ভারতে ছিল না। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও সেই ঘটনাক্রম আপাত বিচ্ছিন্ন এবং সাময়িক, তাৎক্ষণিক নানা কারণের যোগফল। কিন্তু আজকের দিনের সাম্প্রদায়িক হিংসা শাসকের মতাদর্শের আগ্রাসনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সংকটের দায়বদ্ধ অনিবার্যতাও বটে। নরেন্দ্র মোদির জমানাও এই বাধ্যবাধকতা মেনেই চলছে। তাই লাভ জিহাদ, ঘর ওয়াপসি, রামজাদে ইয়া হারামজাদে এই ধরনের শব্দবন্ধ ২০১৪ সালের পর থেকে আমাদের সামাজিক পরিসরে ঢুকে পড়েছে পরিচিতিসত্তা ভিত্তিক চেতনার উপরিকাঠামোর পলেস্তারা হিসেবে।
নরেন্দ্র মোদি জমানা আট বছর পেরিয়েছে। এই পর্বে সংখ্যা দিয়ে বা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অভিঘাত বোঝা একটা অসম্পূর্ণ চেষ্টা। তাহলেও গত মার্চ মাসে সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কী জানিয়েছেন সাম্প্রদায়িক হিংসার সংখ্যাতত্ত্ব প্রসঙ্গে তা একটু দেখে নেওয়া যাক তথ্য এবং যুক্তির নিরিখে। কারণ মোদি জমানার উন্নয়নের স্লোগান হলো, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ এবং তার সঙ্গে পরে যুক্ত করা হয় ‘সবকা বিশ্বাস’। ৩০ মার্চ ২০২২ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় বলেছেন সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় দাঙ্গা (communal or religious riot cases) যা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোয় ২০২০ সাল পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়েছে তার হিসেব এইরকমঃ ২০১৯ সালে ৪৩৮টি, ২০১৮ সালে ৫১২টি, ২০১৭ সালে ৭২৩টি এবং ২০১৬ সালে ৮৬৯টি। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক হিংসা-দাঙ্গা মিলিয়ে দেশে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৩৪০০টি ঘটনা ঘটেছে।
মন্ত্রী এনসিআরবি থেকে তথ্য উদ্ধৃত করে লিখিত জবাবে আরও জানিয়েছেন, দাঙ্গা সংক্রান্ত ঘটনা (rioting cases) ২০২০ সালে ৫১ হাজার ৬০৬টি, ২০১৯ সালে ৪৫ হাজার ৯৮৫টি, ২০১৮ সালে ৫৭ হাজার ৮২৮টি, ২০১৭ সালে ৫৮ হাজার ৮৮৮০টি, ২০১৬ সালে ৬১ হাজার ৯৭৪টি নথিভুক্ত হয়েছে। তবে মন্ত্রী এও জানিয়েছেন, মব লিঞ্চিং সম্পর্কিত তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’য় পৃথক করে রাখা হয় না। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা-দাঙ্গার সবচেয়ে ভয়ংকরতমটি হলো দিল্লির দাঙ্গা, যেখানে মৃত্যু হয়েছে ৫৩ জনের। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম।
বিজেপি পরিচালিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা সংক্ষেপে এনডিএ সরকারের প্রথম তিন বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটা ৮২২ ছিল, যা গত দশকের সর্বোচ্চ অঙ্কের তুলনায় সামান্য কম। গত দশকের ইউপিএ জমানায় ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৪৩। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এটা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। আবার ২০১৫ সালের একটি রিপোর্ট দেশের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির আভাস রয়েছে। ২০১৫ সালে ভারত ধর্মের সাথে জড়িত সামাজিক শত্রুতা (social hostilities involving religion) সংক্রান্ত ঘটনার মাপকাঠিতে পৃথিবীতে সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং ইরাকের ঠিক পরেই ছিল ভারত। বাড়তি কথা না খরচ করে শুধু এই সালতামামি থেকে বলাই যায়, ‘আচ্ছে দিন’ এর স্লোগান এখন তামাশায় পর্যবসিত হয়েছে।
আজকে গোটা দেশে বিভাজনের লক্ষ্যে সামাজিক প্রযুক্তি হিসেবে হিংসা ঘৃণা ও মৃত্যুর রাজনীতির প্রতিদিন নির্মাণ করা হচ্ছে। তার প্রক্রিয়া উপলব্ধি জন্য ইতিহাসের নিয়ম মোতাবেক সাম্প্রদায়িকতার সেই ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে একটু পেছনে তাকানো যাক। ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী হিন্দু এবং মুসলিম সৈনিকেরা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের পার্থক্যকে অতিক্রম করে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা অর্জন করেছিল। মার্কসের ভাষায় ‘জাতীয় বিদ্রোহ’। মহাবিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের এই উদাহরণ ১৮৫৭’র পর ব্রিটিশ শাসকদের আরও বেশি তৎপর করে তোলে ধর্মীয় পরিচিতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে। জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলি অবশ্য এই সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা থেকে সাধারণভাবে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। ১৯২৫ সালে গঠিত হয় আরএসএস। যার সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের ঘোষিত ভিত্তি ছিল সাভারকরের হিন্দুত্ব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা না করে এই দক্ষিণপন্থীরা প্রকাশ্যেই হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের সশস্ত্র করার লক্ষ্য ঘোষণা করেন। আধুনিক ভারতে সাম্প্রদায়িকতার কালো নকশা ব্রিটিশের অবদান। ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, তার জন্য ১৮৫৭’র ঠিক পরেই বিভাজনের নীতি নিয়ে এগোয়। তারা প্রথমে মূলত উত্তর ভারতে যেখানে যেখানে ১৮৫৭’র স্বাধীনতা আন্দোলনের পদচিহ্ন ছড়িয়ে ছিল সেই এলাকাগুলিকে লক্ষ্য করে এগোলো। মূলত কয়েকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে তারা। সেগুলি হলো, ১) উত্তর ভারতের সাধারণের ভাষা হিন্দোস্তানির লিপি কী হবে, দেবনাগরী অথবা উর্দু- সেই বিতর্ক উসকে দেওয়া, ২) গোহত্যা নিবারণ ৩) ধর্মীয় মিছিল ৪) সাধারণ উপাসনাস্থলকে দ্বন্দ্বের উপকরণে পরিণত করা ইত্যাদি। উত্তর ভারতে হিন্দি এবং উর্দু সংক্রান্ত বিভাজনের হাতিয়ার কাজে দিল। জাঁকিয়ে বসলো বিভাজনের রাজনীতি। পূর্ব ভারত ও দক্ষিণে ব্রিটিশ প্রয়োগ করে ভিন্ন অস্ত্র।
এবার গত আটের দশক থেকে বড়ো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদির পুর্বসূরিদের অবস্থান দেখে নেওয়া যেতে পারে। ১৯৮৪ সালে শিখ বিরোধী দাঙ্গায় মৃত্যু হয় ২৭০০ জনের। কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া যে দাঙ্গা ছিল মূলত উত্তর ভারতের দিল্লিকেন্দ্রিক। দাঙ্গা আটকাতে রাষ্ট্রপতি জৈল সিং সেনা নামাতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি তারলোচন সিং এ সম্পর্কে পরে জানিয়েছিলেন, জৈল সিং ব্যর্থ হয়েছিলেন, তার কারণ প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেউ তাঁর ফোন ধরেননি।
১৯৮৭ সালে উত্তর প্রদেশের মিরাট দাঙ্গা শুরু হয় মে মাসের শেষ সপ্তাহে, যা চলে দু’মাস ধরে। মারা যান সাড়ে তিনশ’ মানুষ। ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর দাঙ্গা চলে মাসাধিক কাল, যেখানে ১০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। বেঘর হন পঞ্চাশ হাজার মানুষ এবং ১১,৫০০ টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
সঙ্ঘ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয় ১৯৯২ সালে। দেশ জুড়ে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হলেও বাংলার মাটিতে ঝরেনি এক ফোঁটা রক্ত। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে শাসকের তৎপরতার চেয়েও শাসকের ইচ্ছার দৃঢ়তার কথা। দেশে সঠিক কত মানুষ ওই দাঙ্গায় নিহত হয়েছেন তার হিসেব পাওয়াটা দুরূহ। যদিও আদালত জানিয়েছে কারা মসজিদ ভেঙেছেন তা জানা যাচ্ছে না। ১৯৯২ সালে মুম্বাই দাঙ্গায় প্রায় ১৮০০ মানুষ প্রাণ হারান। দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত করা হয় শ্রীকৃষ্ণ কমিশনকে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাট দাঙ্গা ঘটানো হয়। এই গণহত্যায় মৃত্যু হয় প্রায় দুই হাজার মানুষের, যাঁদের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু। তহলকা ডট কম-এর অনুসন্ধানী স্টিং অপারেশনে বিজেপি’র এক এমএলএ-কে বলতে শোনা যায়, নরেন্দ্র মোদি তাঁদের বলেছিলেন যা করার তিন দিনের মধ্যে করতে হবে...। সে কথা অস্বীকার করলেও নরেন্দ্র মোদি গুজরাট দাঙ্গার অনপনেয় কলঙ্ক মেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ইনিংস শুরু করেন।
২০০৯ সালে চতুর্থ ভাইব্রান্ট গুজরাট শীর্ষবৈঠকের সময় অনিল আম্বানি বলেছিলেন, নরেন্দ্র ভাই গুজরাটের জন্য ভালো কাজ করেছেন। এখন তিনি যদি দেশের নেতৃত্ব দেন তাহলে কী হবে ভেবে দেখুন। আবার ২০১০ সালেই ব্যাপক দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলি ফাঁস হতে থাকে। করপোরেট সংস্থাগুলি এতে জড়িয়ে পড়েছিল। টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, বেআইনি খনি ব্যবসা, কয়লা খনি বরাদ্দ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে অনিল আম্বানি গোষ্ঠী, টাটা, বিড়লা, এসার এবং জিন্দাল গোষ্ঠী জড়িয়ে পড়ে। সমগ্র করপোরেট মহল এসব দুর্নীতিবিরোধী মামলাগুলির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। তার পরিণতিতেই করপোরেটকুল দাঁড়িয়ে যায় মোদির পেছনে। অঢেল টাকা এবং প্রচারের ঢক্কানিনাদে ক্ষমতায় আসীন হন মোদি।
লগ্নি পুঁজির স্বার্থে নয়া-উদারবাদী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতির অভিমুখের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বৈষম্য বৃদ্ধি এবং ক্ষতির বোঝা শ্রমজীবী মানুষের উপর চাপানো। এর পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার নেবে না। ছাঁটাই হবে সামাজিক নিরাপত্তা ভরতুকি ইত্যাদি। যেখানে ঋণ খেলাপি শিল্পপতিরা পাবে জামাই আদর। মোদির গুজরাটে এই কাজটা করা হয়েছে সংখ্যাগুরুবাদের জমির ওপর দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ, একটি বাস্তব অর্থনৈতিক সংকটের উপর ভিত্তি করে বিভাজনের লক্ষ্যে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে সামাজিক মেরুকরণ নির্মাণেরও পরীক্ষাগার ছিল মানব সম্পদ উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকে পিছিয়ে থাকা গুজরাট।
প্রসঙ্গত, সিপিআই(এম)-র অষ্টাদশ কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সংগঠনিক রিপোর্টে ২০০৫ সালের এপ্রিলে বলা হয়েছিল, গত দেড়দশকের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর উত্থান এবং ৬ বছর সরকার চালানোর ফলে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি সমাজের বিভিন্ন অংশের ভিত্তি মূলে আঘাত হানতে সমর্থ হয়েছে। তাদের সুপ্ত শক্তিকে খাটো করে দেখা ভুল হবে।
তাই হিন্দুত্ববাদী মোদির ফরমুলা হলো ঘৃণা-ভাষণ সহ হিংসা সংখ্যাগুরুবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের বিভাজনের হাতিয়ারের নিয়মিত অনুশীলন ও প্রয়োগ। তাই উত্তরপ্রদেশের আখলাক আহমেদ-এর মৃত্যু হয় ফ্রিজে গোমাংস রাখার গুজবে। ট্রেনে ঘিরে ধরে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় ১৬ বছরের জুনেইদ খানকে, রাজস্থানের আলোয়ার জেলায় গোরু পাচার করার সন্দেহে স্বঘোষিত গোরক্ষকদের হাতে খুন হন পেহলু খান। খুন হন যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তক নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুরগি, গৌরী লংকেশ - একই কায়দায়। অপরাধীদের শাস্তি হয় না। দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সংবিধান বিরোধী আইন এনে নাগরিকত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। এফটিআইআই’র মতো সংস্কৃতি এবং সৃজনের ক্ষেত্র সহ সমস্ত সাংবিধানিক সংস্থার মাথায় সঙ্ঘীদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বদলে দেবার চেষ্টা হচ্ছে সংবিধান, মুছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে। গরিব গুর্বো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে প্রমাণপত্র। শাস্তি হয় না ঘৃণা ভাষণেও।
পশ্চাৎমুখী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম-কানুনের মধ্যে থাকতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদ, যার পোশাকি নাম মনুবাদ তার ভিত্তিতে বর্ণাশ্রম-কে খোলা ময়দান দিতে লক্ষ্যবস্তু করা হয় নারীদের। চলছে বহুত্ববাদকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা। দলিত এবং আদিবাসীদের সমাজকে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ এবং নিয়ম-কানুনের মধ্যে টেনে আনার কাজ চালু হয়েছে পুরো দমে। দেশের মানুষ কী পরবে, কী খাবে, কী দেখবে, কী লিখবে, কী বলবে তার সবটাই ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তথ্য বলছে, এই সময় তপশিলি এবং উপজাতি অংশের মানুষ সহ আদিবাসীদের উপর বাড়ছে আক্রমণ। তাই সংঘাতও ঘটছে।
এদেশের সভ্যতা সংস্কৃতি ইতিহাসের বহুমাত্রিক ইতিবৃত্ত নির্মাণ করেছে ভারতীয় অস্তিত্বের মূল নির্যাসটিকে - যাকে এক কথায় বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। ‘দিবে আর নিবে, মিলিবে মিলাবে’ এটাই ভারতের সহজাত বাস্তবতা। প্রায় আটান্ন শতাংশের বেশি মানুষ ভোটের হিসেবেই হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার বিরুদ্ধে, অথচ সেই স্লোগানটিকে সামনে এনে ভারত ধারণাটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ মানুষ পারস্পরিক সংঘাতে রক্তাক্ত হলে মানুষের ঐক্য ক্ষতবিক্ষত হবে, তাতে করপোরেট কুলের লাভ।
তাই নয়া উদারবাদের বিরোধিতায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ না করতে পারলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা অসম্ভব। এই কাজটা শ্রমজীবীরাই পারে আর তাঁদের সংগঠিত করতে পারে বামপন্থীরাই। এটাই আজকের মূল দায়িত্ব। শাসক শেষ কথা বলেনা, স্বাধীনতার এই ৭৫তম বছরে আরও একবার একথা বোঝানো এবং বুঝে নেওয়া জরুরি।