৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
অসমে বিজেপি শাসনে ইতিহাসের বিকৃতি এবং সীমা সংঘর্ষ
কমলেশ গুপ্ত
ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা করে অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক পরিবেশ রচনায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি দল, সঙ্ঘ পরিবার এবং তাদের পরিচালিত সরকারি প্রশাসন। অসমিয়া শৌর্যবীর্যের প্রতীক, স্বদেশপ্রেমী, যুগপুরুষ, বীর লাচিত বরফুকনকে স্মরণ করা হয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই। বিজেপি শাসনে সেই লাচিত বরফুকনকে 'হিন্দুবীর' হিসাবে স্মরণ করা শুরু হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা অসমের মানুষকে অবাক করে নতুনভাবে লাচিতকে ‘আবিষ্কার’ করে ঘোষণা করেছে যে, জাতি এবং দেশপ্রেমের প্রতীক, যার নামে ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রতিজন অসমিয়ার দেহ-মন পুলকিত হয়, সেই লাচিত বরফুকনকে একজন হিন্দুবীর হিসাবে আমাদের চর্চা করা উচিত।
সাম্রাজ্যবাদীদের কোনো জাত-পাত-বর্ণ-ধর্ম-ভাষার ভেদ নেই। সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বার্থে তারা দখল করার জন্য অন্য রাজ্য বা দেশ আক্রমণ করে, একথা সবার জানা। তথাপি হিন্দুত্ববাদীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মোগল সাম্রাজ্যের অসম আক্রমণকে মুসলমান আক্রমণ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে। গৌরবময় সরাইঘাটের যুদ্ধের আগে ও পরে সতেরো বার পরাক্রমী মোগলের অসম আক্রমণ প্রতিহত করার ঐতিহ্যের কথা বলা হচ্ছে। অথচ এই সতেরো বারের প্রথম আট বার আক্রমণের সময় ভারতে মোগল সাম্রাজ্য তো দূরের কথা ভারতে তারা এসেই পৌঁছায়নি। মোগল শাসনের যুগ আরম্ভ হয়েছিল দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে। সতেরোবার অসম আক্রমণের উল্লেখিত আটবার ১২০৪ সাল থেকে ১৫৩২ সালের মধ্যে হয়েছিল। এই সুদীর্ঘ ৩২৮ বছর মোগলদের অসম আক্রমণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সে সময় যারা আক্রমণ করেছিলেন তারা ইসলাম ধর্মী ছিলেন বটে, মোগল ছিলেন না।
অন্যদিকে আহোম সৈন্য বাহিনীর কামান, গোলা-বারুদের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি বাঘ হাজারিকা, যার প্রকৃত নাম ছিল ইসমাইল সিদ্দিকি, নিজে মুসলমান হয়েও অসমের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর যোদ্ধাদের সাথে লাচিতের সহযোগী হয়ে অসীম বিচক্ষণতা এবং সাহসের সাথে রাতের অন্ধকারে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মোগল ছাউনিতে ঢুকে কামানগুলোতে জল ঢেলে নিষ্ক্রিয় করেন এবং আহোম সেনাবাহিনীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন, তা অসমের ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই পাওয়া যায়। লাচিতের সাথে দেশরক্ষার জন্য অসমের মুসলমানরা মুসলমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করেছিলেন। নিজের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বারবার আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সত্ত্বেও আহোমরা কখনোই মুসলমান বিদ্বেষী হয়ে ওঠেনি। লাচিত কখনো ধর্মযুদ্ধ করেননি। যুদ্ধ করেছিলেন নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য। স্মরণ করা যেতে পারে মোগলদের হয়ে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন মোগল সেনাপতি ‘রাজা রাম সিংহ’। যিনি হিন্দু ছিলেন। মুসলমান নন। লক্ষ করার বিষয়, তখন অসম ভারতের অঙ্গ রাজ্য ছিল না। ভারতও ছিল না, ছিল হিন্দুস্থান, ইসলামিস্থান নয়। লাচিত বরফুকন সরাইঘাটের যুদ্ধে হিন্দুস্থানের মোগল শাসকদের পরাজিত করেন ১৬৭১ সালে। তার চাইতেও বড়ো কথা হচ্ছে লাচিত বরফুকন হিন্দু ছিলেন না। আহোমরাও তখন হিন্দু ছিল না। ১৭১৪ সালে স্বর্গদেব (রাজা) শিব সিংহের রাজত্বকালে হিন্দুধর্ম রাজধর্মে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় অহিন্দু লাচিতকে ভারতের হিন্দুবীর সাজানোর চেষ্টা হাস্যকর নয় কী?
অসমের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রয়াত ডঃ সূর্যকুমার ভূঞার ‘লাচিত বরফুকন অ্যান্ড হিজ টাইমস’ (Lachit Borphukan and his times) গ্রন্থটির অনুবাদ মারাঠি ভাষায় হয়েছে। অকৃত্রিম দেশপ্রেম, সাহস, কর্তব্যনিষ্ঠা, ত্যাগ এবং বীরত্বের প্রতীক অসমের বীর লাচিতের কথা মারাঠাবাসী জানতে পারছেন সেতো ভালো কথা, গৌরবের কথা, শুধু মারাঠীরা কেন সারা বিশ্বের লোক জানুক তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু আপত্তির কথা হচ্ছে - মারাঠি জনসাধারণকে লাচিতের বিষয়ে আগ্রহী বা আকর্ষিত করার জন্য বইটির যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাচিত বরফুকনঃ অসমের শিবাজি’। আজকের হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তাদের দ্বারা আদর্শ হিন্দু রাজা হিসাবে অভিহিত করা শিবাজির সুরাট লুণ্ঠনের সেই মর্মান্তিক ইতিহাস যারা জানেন তারা সহজেই বুঝবেন যে বীরত্ব এবং ত্যাগের প্রতীক অসমের লাচিত বরফুকনকে শিবাজির সমপর্যায়ের বলা কতটা অযৌক্তিক। ‘লাচিত বরফুকন ও তাঁর সময়’ নামটি পরিবর্তন করে ‘লাচিত বরফুকনঃ অসমের শিবাজি’ করা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সম্প্রতি লাচিতকে হিন্দুবীর সাজানোর জন্য দিল্লিতে সরকারি উদ্যোগে বিশাল পরিমাণের অর্থ ব্যয় করে লাচিতের ৪০০তম জয়ন্তী পালন করা হয় এবং কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে অসমের প্রান্তে প্রান্তে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। অসমে লাচিত দিবস আগেও পালিত হয়েছে, কিন্তু এমন নির্লজ্জ সরকারি প্রচার ও ব্যয় দেখা যায়নি।
।। দুই ।।
অসমের মুখ্যমন্ত্রীসহ সকল শীর্ষ মন্ত্রী এবং আমলা যখন ‘লাচিত দিবস’ পালনে ব্যস্ত সেসময় অসম-মেঘালয় সীমান্তে আরও একবার সংঘর্ষে নিহত হলেন ছয়জন। দু’রাজ্যের পুলিশ, বনরক্ষী এবং অধিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষের উত্তেজনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মেঘালয়ের শিলং সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। শিলং-এ অসম পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বেশ কিছু যাত্রীবাহী যানবাহন।
আন্তঃরাজ্য সীমা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা যে কেবল প্রচার সর্বস্ব তা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে অসম-মেঘালয় সীমান্তে সংগঠিত সর্বশেষ সংঘর্ষে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে বিশেষ কোনো গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভূমিকাও ইতিবাচক নয়। মাস কয়েক আগে অসম-মেঘালয় সীমা বিবাদ মীমাংসা করতে সরকারি পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ অসম-মেঘালয় সীমা সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করেছিলেন। দুই রাজ্যের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকও বেশ কয়েকবার হয়েছে। গণমাধ্যমে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রচার চলেছে। এত কিছুর পরেও সীমান্ত-সংঘাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। খবরে প্রকাশ, বনাঞ্চলে লুণ্ঠন চালানো মাফিয়ারা অসমের ভূমিতে বন ধ্বংস করার সময় এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নিহতদের মধ্যে অসমের এক গৃহরক্ষী জওয়ান এবং মেঘালয়ের পাঁচ জন অধিবাসী রয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়া অবশ্য কোনো কথাই স্পষ্ট নয়। কিন্তু সীমান্তের উত্তেজনাময় পরিবেশ যেভাবে দু’রাজ্যে তীব্র উত্তেজক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তা চিন্তার কারণ বটে।
অসমের সাথে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে সীমা বিবাদ রয়েছে। বেশ কয়েক দশক ধরে এই বিবাদের মীমাংসা হয়নি। মাঝে মাঝেই সীমান্ত অঞ্চলে অতি ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় সাধারণ মানুষের। শুধু নিরাপত্তা বাহিনীই নয়, সাধারণ মানুষও জীবন দিয়ে এই সংঘাতের মূল্য চুকিয়ে আসছেন। অসম-মেঘালয় সীমান্তেও তেমনই হয়েছে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন যে, অসম পুলিশ মেঘালয়ে প্রবেশ করে সংঘর্ষের সূচনা করেছে। মেঘালয় সরকার ক্যাবিনেট মিটিং করে সমগ্র বিষয়টির তদন্ত ঘোষণা করেছে। এমনকী বিষয়টি রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার আয়োগে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অসম-মেঘালয় সীমান্তে এখনো বহু বিবদমান অঞ্চল রয়েছে। তার মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনাস্থল পশ্চিম কার্বি আংলং জেলার মুক্রু অন্যতম। সীমান্তে অশান্তির সুযোগ নিয়ে বনজ সম্পদ লুট এবং নিষিদ্ধ সামগ্রীর অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমনকী একে কেন্দ্র করে সুযোগ সন্ধানীরা গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি চালাচ্ছে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
অসমের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কংগ্রেস দল সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে ডঃ হিমন্ত বিশ্বশর্মা ব্যক্তিগত লাভের জন্য মেঘালয় এবং মিজোরামের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন - এমন অভিযোগ করেছে। সিপিআই(এম)সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, এই সরকারের কার্যকালে সীমান্ত সংঘর্ষ অতি দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছে। সীমান্তের ভয়ংকর আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছে। সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করা জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ব্যর্থ হয়েছে অভিযোগ করে দুই রাজ্যের জনসাধারণের কাছে হিংসা পরিহার করে ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম)।