E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

মতাদর্শ চর্চা

মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (বারো)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


● এবারে আমরা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রসঙ্গে আলোচনা করব। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনকে প্রয়োগ করা। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগের অর্থ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা। প্রকৃতি জগৎ, মানবসমাজ ও মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানোই মূল লক্ষ্য। তাহলে আমাদের জানা প্রয়োজন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বলতে কী বোঝায়?

● দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য আমাদের অনুশীলন, বিশ্লেষণ এবং ব্যবহারিক কার্যধারাকে সঠিক ধারায় পরিচালনা করা। প্রতিটি নতুন ঘটনা, প্রক্রিয়ার অনুশীলন, উপলব্ধির ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ

১. বস্তুনিষ্ঠতা-বস্তুময়তা [Objectiveness]

জীবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং ঘটনার প্রতি বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হলো সমস্ত প্রক্রিয়া এবং ঘটনাকে যেভাবে এইগুলি বাস্তবে বিরাজ করছে, সেইভাবেই দেখতে হবে।

সরল করে বা জটিল করে না দেখে বাস্তবতার নিরিখে দেখতে হবে। বাস্তবে একটি গাছকে সেইভাবে দেখতে হবে, অন্য কোনো কাল্পনিক জটিলতর রূপ হিসাবে দেখলে তা হবে ভ্রান্তি। বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের অর্থ হলো জীবনের ঘটনার প্রক্রিয়ার প্রকৃত চিত্র উপস্থিত করা। অর্থাৎ প্রক্রিয়ার বা ঘটনার বিকাশের মূল প্রবণতাকে প্রকাশ করতে হবে। সাথে সাথে এই বিকাশের নির্ধারক শক্তিগুলি উন্মোচিত করতে হবে। লেনিনের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলো - ‘‘সামাজিক ঘটনাবলি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং বিকাশের প্রকৃত ধারাকে ভিত্তি করতে হবে।’’

বিষয়ীবাদ [Subjectivism]

বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত হলো বিষয়ীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। বিষয়ীবাদ প্রকৃতি এবং মানব সমাজের বস্তুনিষ্ঠ সূত্রকে (Laws) স্বীকার করে না। বিষয়ীবাদ সমাজের নিয়মের প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে এবং সর্বশক্তিমান চিন্তার ওপর আস্থাশীল। ব্যক্তিগত ইচ্ছা, তাগিদ, স্বার্থপরতা প্রভৃতি জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে পারে। যার ফলে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার বিকৃতি, লঘুকরণ ঘটতে পারে। যা প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। একমাত্র ব্যবহারিক ক্রিয়া বা কাজ (Practice)-ই হলো যেকোনো রূপের বিষয়ীবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত সুনিশ্চিতি [Guarantee]।

২. সর্বাঙ্গীণতা [Comprehensiveness]

প্রক্রিয়া এবং ঘটনার প্রতি বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রয়োজন এইগুলির সর্বাঙ্গীণ যাচাই বা পরীক্ষা। একমাত্র এই ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া বা ঘটনার মধ্যে প্রধান উপাদানকে নির্দিষ্ট করা সম্ভব। এইভাবেই ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মর্মবস্তুকে উপলব্ধি করা সম্ভব, স্বাভাবিকভাবেই সামনে যে কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে, তার মর্মবস্তু উপলব্ধি করা এবং সম্পাদনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। সর্বাঙ্গীণতার অর্থ হলো সমস্ত দিক বিবেচনায় রাখা, সমস্ত বৈশিষ্ট্য, শক্তি এবং প্রভাব বিবেচনায় রাখা, সমস্ত সম্পর্ক এবং আন্তঃসম্পর্ক উন্মোচিত করার সাথে সাথে সার্বিক বিশ্লেষণের জন্য দ্বন্দ্বের বিভিন্ন রূপ [Categories] যথা বিশেষ, সাময়িক, অস্থায়ী, সমগ্র অংশ, রূপ ও অন্তর্বস্তু, [Form content] বাহ্যিক-আভ্যন্তরীণ [External Internal appearance essence] বহিঃপ্রকাশ, মর্মবস্তু প্রভৃতি প্রক্রিয়া অথবা ঘটনার প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই নীতি লঙ্ঘিত হলে একদেশদর্শিতা, আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি, অতিমাত্রিকীকরণ [Super ficiality] অর্থাৎ অতিরিক্ত বানিয়ে দেখা, মানসিক ঔদার্যতা, সঠিকভাবে দেখতে ব্যর্থতা এবং মূল বিষয় তথা প্রক্রিয়ার মূল সূত্র বা সমগ্রকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে অসমর্থ হতে হবে।

৩. বিকাশ/প্রক্রিয়া

প্রক্রিয়া এবং ঘটনাকে বিকাশের ধারায় দেখতে হবে। এর অর্থ হলো, ঘটনা প্রক্রিয়াকে তাদের পরিবর্তনের আভ্যন্তরীণ উৎসের ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। বিচার্য ঘটনা অথবা প্রক্রিয়ার মর্মবস্তু উপলব্ধি করা সম্ভব একমাত্র বিকাশের আভ্যন্তরীণ উৎসকে উন্মোচিত করার মধ্য দিয়ে। যে দ্বন্দ্বের কারণে এই ঘটনা বা প্রক্রিয়া, তার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। কমরেড লেনিনের ব্যাখ্যায় - ‘‘পরস্পর বিপরীত, পারস্পরিক একচ্ছত্রতা এবং বিপরীত প্রবণতাগুলি যা মানব মন ও সমাজসহ সমস্ত ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে, তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং একটা সমগ্রকে বিভক্ত করতে হবে, এবং পরস্পর বিপরীত অংশগুলিকে জানাই হলো দ্বান্দ্বিকতার মর্মবস্তু।’’

৪. ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি

বাস্তবতা সম্পর্কে বোঝাপড়ার শুরু হলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আলোচ্য প্রক্রিয়া বা সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা যে সময়ে ও যে স্থানে সংঘটিত হচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলো প্রক্রিয়া বা ঘটনার অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক সংযোগ, তা যেন আমরা বিস্মৃত না হই। সমস্ত প্রশ্নকে পরীক্ষা করার সময়ে ইতিহাসে সেই ঘটনার অভ্যুদ্বয় কী করে ঘটল, সেই প্রক্রিয়া বা ঘটনার মূল স্তরগুলি কী এবং বিকাশের ধারাতেই সমস্তকিছুকে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানের রূপ, অবস্থান তার ভিত্তিতেই পরীক্ষা বা যাচাই করতে হবে। উৎপত্তি, বৃদ্ধি এবং মৃত্যু, অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, শুরু-মধ্যবর্তী এবং শেষ; পুরাতন এবং নতুন প্রভৃতি ধারণাগুলি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

● লেনিনের বিখ্যাত উক্তি, ‘‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট অনুশীলন’’ - এটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই উপস্থিত করেছে।

● অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বস্তুকামীতা [Fetishism] রহস্যবাদ [Mysticism] এবং উদীয়মান প্রবণতা সম্পর্কে অন্ধত্ব গড়ে ওঠে।

●   ●   ●

বাস্তব ঘটনাবলি এবং প্রক্রিয়ার সর্বব্যাপক বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ যা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উক্ত ঘটনার বা প্রক্রিয়ার বিকাশের আভ্যন্তরীণ কারণগুলিকে গুরুত্ব দেবে, সাথে সাথে সামাজিক ব্যবহারিক কাজের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রাখবে, একমাত্র এইভাবেই ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মর্মবস্তু উপলব্ধি করার সাথে সাথে তাদের মধ্যেকার মূল উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করা সম্ভব। স্মরণে রাখতে হবে, সামাজিক বিকাশের প্রতিটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত কাজের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য হলো মূল যোগসূত্রকে নির্ধারণ করা।

কমরেড লেনিনের শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো - এক বিপ্লবী এবং সমাজতন্ত্রের মতবাদের কর্মী অথবা কমিউনিস্ট হওয়াই যথেষ্ট নয়। প্রতিটি সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলের নির্দিষ্ট গ্রন্থিটি সমস্ত শক্তি দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে, যাতে সমগ্র শৃঙ্খলটাকে ধরা যায় এবং পরবর্তী গ্রন্থিতে রূপান্তরের সমস্ত প্রস্তুতি দৃঢ়ভাবে করা সম্ভব হয়।


(ক্রমশ)