E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮

ভোট-পরবর্তী হিংসা


তৃণমূল সরকারের কড়া সমালোচনা করল কলকাতা হাইকোর্ট


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২ জুলাই ভোট-পরবর্তী হিংসাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের তৃনমূল সরকারের কড়া সমালোচনা করল কলকাতা হাইকোর্ট। অভিযোগ ওঠে এই পর্বে রাজ্য সরকারের ভূমিকা ছিল নিস্ক্রিয় নীরব এবং পক্ষপাতদুষ্ট। এই পরিস্থিতিতে আদালত এর আগে গত ১৮ জুন একটি কমিটি গঠন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সমস্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার অনুরোধ করে। অনেকেই মনে করছেন, এদিন আদালতের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশ থেকে এটা কার্যত পরিস্কার যে রাজ্যের সন্ত্রাস কবলিত মানুষের স্বাভাবিক জীবন জীবিকা নির্বাচন উত্তর পর্বে যে ভাবে ব্যাহত হয়েছে তা মান্যতা পেল। যদিও শপথ নিয়ে রাজভবনে শাসকদলের সন্ত্রাসের সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। আদালতের রায় প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, রাজ্য সরকার প্রথম থেকেই ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের কথা অস্বীকার করে গেছে। আদালত এই নির্দেশ না দিলে কিছুতেই প্রশাসন কাজ করবে না।

এদিন আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে সর্বক্ষণ দাবি করা হয়েছে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের কোনো অভিযোগ আসেনি। কিন্তু আদালতের হস্তক্ষেপে যখন স্টেট লিগাল অথরিটি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তখনই জমা পড়েছে বহু অভিযোগ। অভিযোগ করেও জীবন ও সম্পত্তি হানির ভয়ে অভিযোগকারীরা তাদের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছেন।

এদিন কলকাতা হাইকোর্টে পক্ষ থেকে রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভোট পরবর্তী হিংসাকে কেন্দ্র যে সমস্ত অভিযোগ রয়েছে, তার সব রেকর্ড রাখতে হবে, সমস্ত অভিযোগকে এফআইআর হিসেবে গণ্য করতে হবে। সিআরপিসি ১৬৪ ধারায় আক্রান্তের গোপন জবানবন্দি নথিভূক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাকে এই সমস্ত নির্দেশ দিয়ে বিচারপতিরা জানিয়ে দিয়েছেন, এই কাজে কোন রকম গাফিলতি হলে তার জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আমন্ত্রণ জানাবেন মুখ্যসচিব। সেইসঙ্গে আদালতের গড়ে দেওয়া কমিটি রাজ্য প্রশাসনের কাছে কোন তথ্য চাইলে তা তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা। এক্ষেত্রেও কোনরকম গাফিলতির অভিযোগ করে আসলে তার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য থাকবে আদালত। বৃহত্তর বেঞ্চ জানিয়েছে ২মে থেকে এদিন (২ জুলাই) পর্যন্ত রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও গোয়েন্দা বিভাগের যাবতীয় নথি চিঠি চাপাটি ফাইল সংরক্ষিত করতে হবে। রাজ্য পুলিশের সমস্ত কন্ট্রোল রুমের কথোপকথনের সব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আদালতের তরফে গঠিত কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরিত যাবতীয় নথি চিঠি চাপাটি খাম বন্ধ করে জমা দিতে মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

রাজ্য সরকারকে কলকাতা হাইকোর্টের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ভোট পরবর্তী হিংসায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের চিকিৎসা খরচ এবং রেশনের ব্যবস্থা রাজ্য সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। সন্ত্রাস থামাতে কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে ২ জুলাই কড়া নির্দেশ দেওয়ার প্রেক্ষিতে ৬ জুলাই আদালতের সেই নির্দেশকে পুনর্বিবেচনা করার আরজি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী ১৩ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য আছে।

প্রসঙ্গত গত ২ মে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা। তৈরি করা হয় সন্ত্রাসের পরিবেশ। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতী বাহিনীর হাতে নিহত হন সিপিআই(এম)কর্মী কাকলি ক্ষেত্রপাল। গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের ওপর শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ব্যাপক হামলা চালান হয়। যাদবপুর সহ বিভিন্ন এলাকার বহু পার্টি অফিস এবং রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বহু বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ রাজ্যে ভোট পরবর্তী সময়ে শাসকদলের সন্ত্রাসের মাত্রা এতটাই তীব্র যে নির্বাচিত বিধায়ক পর্যন্ত তার বিধানসভা কেন্দ্রে ঢুকতে পারছেন না। ভাঙ্গড়ের সংযুক্ত মোর্চার বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকে ভাঙ্গড় থানার সামনে খুন করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। প্রশাসনের সব স্তরে অভিযোগ করেও কোন সুরাহা হয়নি। রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে এদিন কার্যত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে আদালত। সরকারের এই ভূমিকার জন্য বহু মানুষ খুন হয়ে গেছেন। নাবালিকাদের পর্যন্ত নির্মম যৌন নিপীড়নের মুখে পড়তে হয়েছে। আক্রান্তদের ঘরছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে, এমনকি ভিন রাজ্যে পর্যন্ত পালিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি আদালতের গড়ে দেওয়া কমিটির সদস্যকে পর্যন্ত আক্রান্ত হতে হয় দুষ্কৃতীদের হাতে।

রাজ্য সরকারের এহেন ভূমিকা দেখার পরই গত ১৮ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আদালত একটি কমিটি গঠন করে সমস্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার অনুরোধ করে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ও স্টেট লিগাল সার্ভিস অথরিটি সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি আদালতের কাছে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল বিচারপতি ইন্দ্র প্রসন্ন মুখার্জি, হোসেন ও সুব্রত তালুকদারের তত্ত্বাবধানে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চ অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে অবিলম্বে রাজনৈতিক সন্ত্রাস আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে বলেছে। সন্ত্রাসের কারণে কেড়ে নেওয়া রেশন কার্ড ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনকে সক্রিয় হতে বলা হয়েছে।

ভোটের পর কাঁকুড়গাছিতে নিহত বিজেপি কর্মীর মৃতদেহ কমান্ড হাসপাতাল এর তত্ত্বাবধানে ফের ময়না তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে আদালতে তৈরি করে কমিটির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।