৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮
জম্মু-কাশ্মীরের মর্যাদা আগে ফেরাতে হবে অন্যান্য আলোচনা পরে - গুপকার জোটের ঘোষণা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ফলাফল নিয়ে গুপকার সন্তুষ্ট নয়। বিরোধী দলের এই জোট দাবি জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা আগে ফেরাতে হবে, তারপর নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। জম্মু-কাশ্মীরে দমনপীড়ন বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছে গুপকার। গত ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লির বৈঠকের পর গুপকার নেতারা ৪ জুলাই আলোচনায় বসেন। সেই বৈঠক শেষেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এক বিবৃতিতে এদিন সিদ্ধান্তসমূহ জানিয়েছেন গুপকারের মুখপাত্র সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৪ জুলাই সন্ধ্যায় ফারুক আবদুল্লার সভাপতিত্বে তাঁর বাসভবনে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন গুপকার জোটের নেতারা। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি, ইউসুফ তারিগামি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হাসনেন মাসুদি, জাভেদ মুস্তফা মীর এবং মুজফ্ফর আহ্মদ শাহ। তারিগামি জানিয়েছেন, বৈঠকে উপস্থিত সকলেই দিল্লি বৈঠক নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন। বিশেষ করে মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য কোনও সুসংহত পদক্ষেপ করা হয়নি বলে গুপকার মনে করছে। যে অসাংবিধানিক এবং গ্রহণযোগ্য নয় এমন সিদ্ধান্ত জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের উপরে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করতে সাংবিধানিক, আইনি এবং রাজনৈতিকভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া হবে বলে সকলেই ঐকমত্য হয়েছেন। রাজনৈতিক ও অন্য বন্দিদের জেল থেকে মুক্তির বিষয়ে কোনও পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। ২০১৯ সাল থেকে জম্মু-কাশ্মীরকে যেভাবে বন্দি বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং দমনপীড়ন চলছে তা শেষ করতেও কোনও কথা বলা হয়নি। জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ যারা জম্মু-কাশ্মীর সমস্যার প্রধান অংশ এবং ভুক্তভোগী তাঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এই প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন ছিল বলে গুপকার মন্তব্য করেছে। জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয় নিয়ে গুপকার বলেছে, বিজেপি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিল, রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তারা সেই প্রতিশ্রুতিকে মর্যাদা দিক। তাই আগে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো হোক, তারপর নির্বাচনের পথে যাওয়া যাবে। একই সঙ্গে বিবৃতিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, গুপকার জোটের বৈঠকে এই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা চালানো হবে, যাতে এই বিষয়ে একটি সাধারণ অবস্থান নেওয়া যায়।
দিল্লি বৈঠকেই ফারুক আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, গুলাম নবি আজাদ, ইউসুফ তারিগামি সহ বিজেপি বিরোধী সমস্ত দলই আগে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানোর দাবি করেছিলেন। বৈঠক শেষে দিল্লিতে এবং শ্রীনগরে ফিরেও ব্যক্তিগতভাবে এই মতামতই জানাচ্ছিলেন ফারুক আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, ইউসুফ তারিগামি প্রমুখ। জোটের ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল কোনো কোনো মহল থেকে। তারপরই এই বিবৃতি প্রকাশ্যে আসে।
উল্লেখ্য, ২৪ জুন আচমকাই কেন্দ্রীয় সরকার কোনো অ্যাজেন্ডা ছাড়াই জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলিকে বৈঠকে ডেকে পাঠায়। জম্মু কাশ্মীর রাজ্যে মোট ৮৭ আসনের বিধানসভায় কাশ্মীরে ছিল ৪৬টি জম্মুতে ৩৭টি এবং লাদাখে চারটি আসন। বৈঠকে শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল যে, কেন্দ্র সরকার ডিলিমিটেশনের কথাই বলবে। কারণ ইতিমধ্যেই ডিলিমিটেশন কমিশন কাজ করছে এবং তার মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, ডিলিমিটেশনের লক্ষ্য হলো পুনর্বিন্যাসের কথা বলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের লক্ষ্যে কাশ্মীরের আসন কমানো এবং জম্মুর আসন বৃদ্ধি করা। তাই ডিলিমিটেশন মোদী শাহদের প্রধান লক্ষ্য। অর্থাৎ, ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে জনবিন্যাসের পরিবর্তন করে বিজেপি জম্মু-কাশ্মীরে ক্ষমতা দখলের যে ছক কষেছে তা পরিপূর্ণ হলে তবেই জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য হবে, নাহলে তা কেন্দ্রের হাতেই রেখে দেওয়া হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে, এমনই মতলব মোদী-শাহের, মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বক্তব্য রাখেন ফারুক আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, মোহাম্মদ ইউসুফ তারিগামি এবং গুলাম নবি আজাদ। তাঁদের বক্তব্যে তাঁরা ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পূর্ববর্তী অবস্থা ফেরানোর কথা বলেন।
তারিগামি বলেন, ৩৭০ ধারা বাতিল করা অন্যায় হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের কেন বারবার সন্দেহের চোখে দেখা হয় এই প্রশ্ন তুলে তিনি মনে করিয়ে দেন ভারতভুক্তির আগেও কাশ্মীরের মানুষের পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করার কথা। তিনি বলেন, সেই সময় কাশ্মীরের মানুষে বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সঙ্গেই থাকবেন। তাঁর প্রশ্ন, এতদিন পরে আজও আমাদের ভরসা করা হয়না। সংবিধানের মাধ্যমে যা পাওয়া গিয়েছিল তাও ছিনিয়ে নেওয়া হলো। সেটা করা হলো কোনো আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের কোনো মতামত নেওয়া হলো না। এর ফলে সেখানকার মানুষের ভাবনায় আঘাত লেগেছে। মানুষের বিশ্বাসের মাত্রা কম ছিল, তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দেশের জন্য তা ঠিক হলো না। একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের অবনমন করা হলো। এটা যদি দেশের অন্য কোনো জায়গার সাথে করা হতো তাহলে সেখানকার মানুষ কি করতেন, তিনি প্রশ্ন তোলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠকে বলেন, ...আপনাদের সব বক্তব্য আমি নোট করেছি। আগামীদিনেও এ ধরনের আলোচনা চলতে থাকবে। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে 'দিল্লি কি দুরি' আর 'দিল কি দুরি' দুটোই দূর করতে চান। যদিও বৈঠকের পরেও প্রধানমন্ত্রী ট্যুইট করে জানিয়েছেন, ডিলিমিটেশন হলে জম্মু-কাশ্মীরে ভোট হবে।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ডিলিমিটেশনের কাজে সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ডিলিমিটেশনের কাজ সম্পূর্ণ হলে বিধানসভা নির্বাচন করানো হবে। যদিও তিনি বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-কেউই সময়সীমা সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লা বলেন, আমরা বলেছি জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। অবিলম্বে তা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণ মর্যাদা ফেরানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ করা উচিত। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়ে দেন, সুপ্রিমকোর্টে তাঁর দল সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তকে সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে যে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে তা চলবে।
এদিকে ডিলিমিটেশন কমিশনের দল ৬ জুলাই থেকে জম্মু-কাশ্মীর সফরে এসেছে। আলোচনার জন্য। ৬-৯ জুলাই পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে তারা এই নিয়ে আলোচনা করবে বলে জানানো হয়েছে আগেই। জানা গেছে, ২০১১ সালের জনগণনাকে ভিত্তি করে ইতিমধ্যেই ডিলিমিটেশন কমিশন জেলাভিত্তিক ম্যাপ এবং পরিসংখ্যান নিয়ে একাধিক বৈঠক করে ফেলেছে। নাগরিক সমাজ এবং অন্য অংশের নানা ব্যক্তিও মতামত দিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছিল ওই বিবৃতিতে। তবে ডিলিমিটেশন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এনসি, সিপিআই(এম) সহ আরো কয়েকটি দল যোগ দেবে জানালেও পিডিপি যোগ দেবে না বলে জানিয়েছে।