E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮

দিলীপ কুমার-এর জীবনাবসান


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ৭ জুলাই সকাল সাড়ে সাতটায় জীবনাবসান হলো কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমারের। মাঝে মাঝেই মুম্বাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিলেন ৯৮ বছরের অভিনেতা। সেখানেই এদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এদিন বিকেলে মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজে জুহু কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। রেখে গেলেন স্ত্রী অভিনেত্রী সায়রা বানুকে।

হিন্দি ছবির স্বর্ণযুগের ত্রয়ী রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং দিলীপ কুমারের মধ্যে শেষ কিংবদন্তীর প্রয়াণের খবরে স্বাভাবিকভাবে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন সকলেই। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ পালি হিলসের বাড়িতে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয়। অভিনেতা ধর্মেন্দ্র, শাবানা আজমি, শাহরুখ খান, অনিল কাপুর, বিদ্যা বালান প্রমুখরা অল্প সময়ের মধ্যেই এসে যান তাঁর বাড়িতে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারে বাড়িতে এসেই শ্রদ্ধা জানান কিংবদন্তী অভিনেতাকে। আসেন এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ারও। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরি সহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতারা শোকজ্ঞাপন করেছেন দিলীপ কুমারের মৃত্যুতে। সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়েছে অজস্র ছবি এবং শোক বার্তায়। তাঁদের মধ্যে আছেন লতা মঙ্গেশকরও। চিরকাল নিজের 'ছোটো বোন' বলেই লতাকে পরিচয় দিয়েছেন দিলীপ কুমার। এদিন দিলীপ কুমারে সঙ্গে একাধিক ছবি টুইট করে লতা মঙ্গেশকর বলেছেন, ‘ইউসুফ দাদা আজ নিজের ছোটো বোনকে ছেড়ে চলে গেলেন। ওনার সঙ্গেই একটা যুগের অবসান হয়ে গেল। আমি খুবই দুঃখিত। নিঃশব্দ হয়ে গেছি।’

পাকিস্তানের পেশওয়ারে ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম হয়েছিল ইউসুফ খানের। বাবা পেশোয়ারের সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে বাবার সঙ্গে ছেলের সম্পর্কে তিক্ততা ছিল। সেই বিবাদের জেরে এক দিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন ইউসুফ। বাড়ি ছেড়ে আসেন পুনেতে। সেখানে পাশে পান এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতিকে। তাঁদের সূত্রেই এক ক্যান্টিন কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেনাবাহিনীর ক্লাবের কাছে একটি স্যান্ডউইচের দোকান খোলে ইউসুফ। ব্যবসার সূত্রেই আলাপ হয় মাসানি নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। মাসানি তাঁকে নিয়ে যান বম্বে টকিজে। তখন ইউসুফ ছবির গল্প বাছাই এবং চিত্রনাট্য লেখার কাজে সহায়তা করতেন। উর্দু জানতেন ফলে সুনাম অর্জন করতে সমস্যা হলো না। বম্বে টকিজেই দেবিকা রানিই তাঁকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন, নতুন নামও দিলেন। ইউসুফ হয়ে গেলেন দিলীপ কুমার। প্রথম সিনেমা মুক্তি পেল ১৯৪৪ সালে ‘জোয়ার ভাঁটা’। তারপর থেকে ভারতীয় সিনেমায় নিজের আসন চিরকালীন করে নিয়েছেন দিলীপ কুমার। নাসিরুদ্দিন শাহ, অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহরুখ খান- বহু প্রজন্মের কাছেই অনুপ্রেরণা দিলীপ কুমার মাত্র ৬০টির কাছাকাছি ছবিই করেছেন। যার অধিকাংশই ‘ক্ল্যাসিক’ হিসাবে পরিচিত হিন্দি সিনেমায়। আঞ্চলিক ভাষার ছবির মধ্যে তপন সিনহার ‘সাগিনা মাহাতো’ উল্লেখযোগ্য।

দিলীপ কুমার শুধু মাত্র তারকা নন, অভিনেতাও নন। ভারতের মিশ্র সংস্কৃতির প্রতীক। তাঁর ছবিগুলির মতোই সাত দশকের তাঁর সামাজিক জীবনও বিদ্রোহ, আশা আর ভালোবাসার প্রতীক। কোরান এবং গীতার শ্লোক একইভাবে স্মৃতি থেকে আওড়াতে পারতেন। দিলীপ কুমারের আত্মজীবনী ‘দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো’-র ভূমিকায় সায়রা বানু লিখেছেন, ‘তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাস অন্তর থেকে আসে। সমস্ত ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতির প্রতি তাঁর সমান সম্মান ছিল।’ এটা শুধু কথার কথা নয়।। সামাজিক জীবনে তিনি বার বার এর নজির রেখেছেন। ১৯৯০ এর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সঙ্কটের সময়ে যখন মুম্বাই আড়াআড়িভাবে বিভক্ত, দিলীপ কুমার শান্তির প্রতীক হিসাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যখন ১৯৯৩ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বাণিজ্য নগরীতে, তখন দিলীপ কুমারের ভূমিকার কথা এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। কিভাবে তিনি নিজের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন পীড়িতদের আশ্রয় দিতে এবং কিভাবে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ত্রাণ কাজ চালিয়েছিলেন, তা এখনও আলোচ্য বিষয়।

মহাকাব্যিক রোমান্স ‘মুঘল-ই আজম’, ‘দেবদাস’ বা ‘আন্দাজ’ ছবির সঙ্গেই ‘ট্র্যাজেডি কিং’ শব্দবন্ধনী তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে। কিন্তু স্বাধীনতার আগে ১৯৪৪ এর ‘জোয়ার ভাঁটা’ থেকে ১৯৯৮ এর ‘লাল কিল্লা’ পর্যন্ত তিনি প্রকৃত অর্থেই বহুমাত্রিক। তাঁর ছবিতে সেই সময়ের সমস্যাগুলি ধরা পড়ত। চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের ‘শহীদ’ বা ‘নয়া দৌড়’ এর মতো ছবি সদ্য স্বাধীন একটি দেশের চিত্রকেই তুলে ধরে। তাই অনেকেই তাঁকে নেহরুভিয়ান হিরো বলেছেন, যিনি সমস্যা সঙ্কুল তরুণ ভারতকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন ছবিতে। কিংবদন্তী ত্রয়ীর বাকি দু’জনের মতো দিলীপ কুমার কখনও ছবি তৈরি করতে যাননি, নিজের অভিনয় কাজেই দৃঢ়ভাবে নিয়োজিত থেকেছেন আজীবন।

পদ্মভুষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান ছাড়াও রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যও হয়েছিলেন। বম্বের শেরিফও থেকেছেন ১৯৮০ সালে। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মান নিশান-ই ইমতিয়াজ প্রদান করা হয় তাঁকে। সেই সময়ে কারগিল সংঘর্ষের জেরে রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল। এই নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে হিন্দুত্ববাদীরা। বিশেষ করে শিবসেনা এবং বাল থ্যাকারে। তাঁকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় এই জন্য। সেই সময়ে বম্বেতে বাল থ্যাকারে বা শিবসেনার বিরোধিতা করা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু মাথা নোয়াননি দিলীপ কুমার।

এদিন বিকালে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় ‘কোহিনূর’-এর। জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয় তাঁর দেহ। সমাহিত করার আগে জুহু কবরস্থানে আসেন অমিতাভ বচ্চন, সুভাষ ঘাই সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। অমিতাভ বচ্চন শোকবার্তায় বলেছেন, একটি প্রতিষ্ঠান চলে গেল। যখনই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস লেখা হবে তা দিলীপ কুমারের আগে এবং পরে হবে। অসাধারণ বক্তব্যে শাবানা আজমি বলেছেন, আপনি জানেন না আমি আপনার একলব্য। সিনেমা, ভাষা, মর্যাদার জন্য ধন্যবাদ। সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্যেও আপনাকে ধন্যবাদ।


‘‘এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমার প্রজন্ম তাঁর চরিত্রগুলি দেখে বেড়ে উঠেছে, চেতনা তৈরি হয়েছে। সংসদে তাঁর সহকর্মী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সময়ে তাঁর থেকে চরিত্রের দৃঢ়তা শিখেছি। সায়রাজি এবং তাঁর অগণিত অনুরাগীর জন্য রইল গভীর সমবেদনা।’’
- সীতারাম ইয়েচুরি