E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পূর্তি

সীতারাম ইয়েচুরি


চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পক্ষ থেকে সৌভ্রাতৃত্বসূচক অভিবাদন জানাই। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগেই ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে অত্যাচারী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির শাসনাধীন ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। বিগত একশো বছরে দুই পার্টি নিজেদের মধ্যে নানাবিধ টানাপোড়েন, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেও সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

মার্কসবাদ - লেনিনবাদকে সিপিআই(এম) ‘সৃজনশীল বিজ্ঞান’ হিসাবেই মনে করে। এই মতাদর্শ যেকোনোরকম সংকীর্ণতাবিরোধী। গুটিকয়েক সূত্রের মাধ্যমে এই মতাদর্শের সরলীকরণ সম্ভব নয়। সৃজনশীল বিজ্ঞান হিসেবে একদিকে মার্কসবাদের বৈপ্লবিক নীতিসমূহ ও মুক্তিকামী লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকতে হবে, অন্যদিকে যেকোনো দেশের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একে প্রয়োগ করতে হবে। লেনিন সেই জন্যই উল্লেখ করেছিলেন, “নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণই হলো দ্বন্দ্বতত্ত্বের সজীব অন্তর্বস্তু”।

বিগত একশো বছরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বস্তুত চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগেরই সাক্ষ্য বহন করছে। রাশিয়ার বিপ্লবের সংগ্রামী ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং শিক্ষা গ্রহণ করেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দেশের মুক্তিসংগ্রামের লড়াই-এ নেতৃত্ব হিসাবে সাফল্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠাই সমাজতান্ত্রিক চীনের ভিত গড়ে দেয় - তাকে পরিণত করে গণ সাধারণতন্ত্রী চীনে। বিংশ শতাব্দীতে দুনিয়া বদলে দেবার মতো তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে - ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লব, ১৯৪৫ সালে হিটলার ও ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও তার ফলস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে উপনিবেশগুলির মুক্তি এবং ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠা। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সভ্যতার রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে এই তিনটি ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম।

সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাসের নানা বাঁক ও মোড়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নানাবিধ কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই পর্বে অনেক ভুল ত্রুটি হয়েছে।তবে ভ্রান্ত নীতিগুলিকে চিহ্নিত করে ত্রুটি সংশোধন করার ফলে সমাজতান্ত্রিক চীনের ভিত মজবুত হয়েছে। সেই লড়াইতে অনেক তিক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে, অনেক ঘটনা সমাজে ভয়ানক অস্থিরতা তৈরি করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এই সমস্ত ত্রুটি সংশোধন করে এবং ভবিষ্যতে এগুলির পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্প নিয়ে বিজয়ীর সম্মান লাভ করেছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতা হলো, অতীতের ভ্রান্তিসমূহকে চিহ্নিতকরণ এবং সংশোধনই হলো জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। সৃষ্টিশীলতা, আত্মমূল্যায়ন এবং সংশোধনের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালে এক সাহসী সংস্কার কর্মসূচির সূচনা করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। সেই সংস্কার পদক্ষেপের বিস্ময়কর ফলাফল আজ সারা বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে।

১৯৮৭ সালে আমাদের পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ চীনে গেলে আমিও তার সাথে যাওয়ার সুযোগ পাই। দেং জিয়াও পিং তখন পার্টির সমস্ত পদ ত্যাগ করেছেন এবং বিদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ রেখেছেন। সেবার যেহেতু ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ চীনে গেছেন তাই এই নিয়ম ভেঙে ই এম এস-এর সম্মানে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। কমরেড দেং জিয়াও পিং অবিরাম ধূমপান করতেন। কমরেড ই এম এস-এর সাথে তাঁর গভীর সখ্য ছিল। একটি সিগারেট ধরিয়েই কমরেড দেং ই এম এস’কে বললেন “তুমি আমার মতো দীর্ঘজীবী হবে না”। এই কথা বলে তিনি জোরে হেসে উঠলেন এবং বললেন “তুমি ধূমপানও করো না, মদ্যপানেরও অভ্যাস তোমার নেই, সুতরাং তুমি কিছুতেই আমার মতো দীর্ঘজীবী হতে পারবেনা”।

সেই সময় চীনের পার্টিতে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলি সম্পর্কে আমরা জানতে চাইলে তিনি তাঁর এক সহযোগী কমরেডকে চীনের একটি মানচিত্র আনতে বললেন। একটি বড়ো টেবিলের উপরে সেই মানচিত্র খুলে তিনি চীনের গুয়াংদৌ (ভারতে এই অঞ্চল ক্যান্টন নামেই বেশি পরিচিত) প্রদেশের দিকে ইঙ্গিত করলেন এবং জানালেন এই অঞ্চল থেকেই সারা দেশে সংস্কার কর্মসূচি শুরু হবে। ১৯৮০’র দশকে দক্ষিণ চীন, ১৯৯০’র দশকে পূর্ব চীন, ২০০০ থেকে ২০১০ অবধি মধ্য চীন প্রদেশে, ২০১০ থেকে ২০২০ অবধি চীনের পশ্চিমাঞ্চল এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সেই কর্মসূচি পূর্ণতা পাবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ২০৫০ সাল নাগাদ চীন একটি সমৃদ্ধশালী সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে। আজ পিছনের দিকে ফিরে দেখলে বলতেই হয় দেং জিয়াও পিংয়ের সেই পরিকল্পনাকে আধুনিক চীন গড়ে তোলার কাজে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে।

আমরা বিশ্বাস করি যে, এইসব সংস্কারমূলক কর্মসূচি এবং উন্মুক্তকরণের নীতিসমূহ সবটাই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিপ্লবী মতাদর্শের আলোকেই পরিচালিত হবে এবং এই কাজ সমাধা করতে গিয়ে সমাজতন্ত্রের শত্রু যারা কোনোরকম সুযোগ পেলেই সমাজতন্ত্রের ক্ষতি করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাদের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। কয়েক দশক ধরে চলা সংস্কার ও অর্থনীতি উন্মুক্ত করার কর্মসূচি চালানোর সাথে সাথে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী সেই শক্তিগুলির সাথেও নিরন্তর লড়াই জারি রেখেছে যারা চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশানা করে আসলে সমাজতন্ত্রকে খাটো করে দেখাতে চায়। এই শ্রেণিযুদ্ধ কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে আরও বৃদ্ধি পাবে কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে ‘চীনকে ঘেরাও করা’র নীতি নিয়ে চলছে। সিপিআই(এম)আশাবাদী যে, এই সমস্ত বাধাকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

পুঁজিবাদ যা মূলগতভাবে একটি অমানবিক ব্যবস্থা, যা কখনই মানুষের উপরে শোষণের অবসান ঘটাতে কিংবা এই ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনা। একুশ শতকের প্রথম দুই দশক দেখিয়ে দিয়েছে ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া নিজেদের সৃষ্ট আর্থিক সংকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে পুঁজিবাদ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।

যখন বিশ্ব অর্থনীতির ক্রমশ শক্তিক্ষয় হচ্ছে এবং এগিয়ে চলেছে এক গভীর মন্দার দিকে, তখনই এলো কোভিড মহামারী যা ইতিমধ্যেই দুনিয়াজুড়ে যে অর্থনৈতিক অধোগতি শুরু হয়েছিল তাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। বর্তমান সমস্যার কোনোরকম সমাধানের অক্ষমতা আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদী নয়া-উদারনৈতিক বিশ্বায়নের দেউলিয়াপনা প্রমাণ করে দিচ্ছে।

কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনজীবনসহ দেশের অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করা ও বিকাশের পথে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করেছে তা গোটা পৃথিবীর কাছে শিক্ষণীয় বিষয়। এই সাফল্য পুঁজিবাদের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বই তুলে ধরেছে।

এতগুলো বছর ধরে সংস্কারমূলক কর্মসূচি পালনের সুবাদে ২০২০ সাল নাগাদ চীন নিজের দেশ থেকে চরম দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের দ্বারা দেশজুড়ে কর্মহীনতার হার নিচে নামিয়েছে, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতিসাধনে সফল হয়েছে এবং একইসাথে বিশ্বমানের পরিকাঠামো এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে যথোপযুক্ত বিনিয়োগের ফলে আজকের চীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটছে। অসমতা ও দুর্নীতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিসাধনের ক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সাফল্য অর্জন করেছে। এভাবে নিজেদের একশো বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪৯ সালের ভিতরে “সমৃদ্ধশালী, দৃঢ়, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক গুণ সম্পন্ন এবং সুসমন্বিত একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ” হিসাবে চীনকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি।

পৃথিবীর প্রগতিশীল মানুষ আশাবাদী যে শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি, প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গণসাধারণতন্ত্রী চীন সাফল্য অর্জন করবে।


('মালয়ালা মনোরমা' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের ইংরেজি থেকে অনুবাদ।)