৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
জ্যোতিষের বুজরুকি শিখেও এমএসসি, পিএইচডি?
পল্লব সেনগুপ্ত
বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের নামে একটা গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটা এরকমঃ একবার না-কি এক জ্যোতিষী বাদশাহের কাছে এসে তাঁর হাত দেখতে চাইলেন - মানে, তাঁর ‘করকোষ্ঠী’ বিচার করার আবেদন করলেন। ঔরঙ্গজেব সাধারণভাবে, যাকে ‘নো ননসেন্স’ ধরনের (অর্থাৎ বাজে কথা না বলা, শোনা টাইপের) মানুষ ছিলেন বলেই ইতিহাসের বইতে দেখা যায় যদিও, তবু সেদিন অজানা কারণে সেই জ্যোতিষীর আবেদন মঞ্জুর করেন। জ্যোতিষী তাঁর হাত দেখে, দরবারের পারসি গালিচা সরিয়ে মেঝেতে খড়িমাটির আঁকজোক কেটে বিমর্ষ মুখে ভারত সম্রাটের দিকে তাকালেন। বাদশাও কিছু-কিঞ্চিত অবাক হয়ে তাঁকে কারণ শুধোলে গণক ঠাকুর বলেন যে, তাঁর গণনা অনুযায়ী ভারত সম্রাটের পরমায়ু মাত্র আর তিনমাস, বা তারও কম। ঔরঙ্গজেব এই কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বিকারভাবে বসে থেকে জ্যোতিষী ঠাকুরকে বললেন তাঁর নিজের আয়ু আর কতদিন আছে গুণে-গেঁথে হিসেব কষতে। জ্যোতিষী নিজের হাতের রেখা-টেখা দেখে, খড়িপেতে দাগজোক দিয়ে,অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, ‘‘জাহাঁপনা, এই গরিব আরও দশ বছর সাতমাস এগারো দিন বাঁচবে।’’ ...এরপর ওই কিংবদন্তিতে আছে যে, বাদশাহ হঠাৎ তাঁর রাজকীয় তরবারিটা খাপ থেকে টেনে বার করে এক কোপে বেচারা জ্যোতিষীর ধড়-মাথা আলাদা করে দিয়ে বলেছিলেন যে, এই সব ‘কিসমৎ’ গোনাগুণতি যে আসলে সবটাই বিলকুল ঝুট, বে-বুনিয়াদ সেইটাই তিনি প্রমাণ করে দিলেন।...গল্পটার একটা ছোটো উপসংহারও আছেঃ বাদশাহ এরপরে আর মাস তিনেক নয়, পুরো বারো বছর বেঁচেছিলেন!
ঔরঙ্গজেব বাদশাহ কতটা কঠিন কিংবা উগ্রস্বভাব ছিলেন, সেটা বোঝানোর জন্যে কিন্তু এই কিংবদন্তিটি স্মরণ করছি নে যে, তা বলাই নিষ্প্রয়োজন। গল্পটা স্মরণ করলাম শুধুমাত্র এই কারণেই যে, হাত দেখা, খড়িপাতা, জ্যোতিষচর্চা, কাকচরিত্র, হনুমান চরিত্র, বাটি চালা, সরষে পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি বহু হাস্যকর কুসংস্কারই বস্তুতপক্ষে অন্ধ বিশ্বাস (নামান্তরে মূঢ়তা) ছাড়া আর কিছুই নয় - সেটাই বোঝাতে চাইছি। প্রসঙ্গটা হঠাৎ খবরের কাগজের হেড লাইন হয়ে ওঠা একটি ঘটনার বাবদেই এই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলো। অতি সম্প্রতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের মদতে ‘জ্যোতিষ’ নামক (অপ) বিদ্যাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ, এমএ, পিএইচডি প্রভৃতি উচ্চপাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়েছে, আর সেটা হয়েছে নাগপুরিয়া পাঁড়-হিন্দুত্ববাদী অশিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিতদের নির্বন্ধে। স্বাভাবিকভাবেই এই লজ্জাকর নির্বুদ্ধিতার বিরুদ্ধে দেশের অগ্রগণ্য বৈজ্ঞানিকরা এবং বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপকরা এই ব্যাপারটার তীব্র নিন্দা করেছেন। এই বিশিষ্ট পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে যে স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে তার স্বাক্ষরকারীদের সংখ্যা ১০০০+ এবং উত্তরোত্তর এই দেশজোড়া করোনা পরিস্থিতিতেও বহু জায়গায় প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে আপনা থেকেই। স্বভাবতই গেরুয়া শিবির, তাদের মধ্যযুগীয় মুর্খতা এরফলে বিব্রত হচ্ছে দেখে জ্যোতিষচর্চার সপক্ষে (+) ৩৫০ জন বিদ্যাজীবীর স্বাক্ষরিত একটা পালটা স্টেটমেন্ট জারি করিয়ে পৃষ্ঠরক্ষার চেষ্টা করছে ! তা করুক। আত্মরক্ষার তাগিদ জীব মাত্রেরই, তা যে মানুষই হোক, আর মানবেতর প্রাণীই হোক! কিন্তু হাজারেরও বেশি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী যে সব যুক্তিতে জ্যোতিষবিদ্যার অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করে দিয়েছেন, তার কোনওটাকেই খণ্ডন না করতে পেরে হাস্যকর এবং অবান্তর কতকগুলো মন্তব্য দিয়ে পালটা স্টেটমেন্টটি বাজারে চাউর করা হয়েছে। জ্যোতিষচর্চার বিরোধিতা মানে ‘‘ভারতীয় পরম্পরাকে অপমান করা’’, ‘‘পশ্চিমী বিদ্যার দাসত্ব করা’’, “মুঘল এবং ব্রিটিশ আমলে ভারতের সনাতন জ্ঞানচর্চাকে ধ্বংস করতে চাওয়া হয়েছে, এই জ্যোতিষ বিরোধিতা আসলে সেই দেশবিরোধী প্রয়াসেরই উত্তরসাধনা’’ ইত্যাদি-ইত্যাদি একগাদা ফাঁকা ঢাকের বাদ্যি বাজানো ছাড়া, একটিও তথ্যনিষ্ঠ, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য নেই সেখানে। বিজেপি-র আমলে যেভাবে জ্ঞান-বিদ্যাকে মধ্যযুগীয় তমসায় ঢেকে ফেলে মানুষকে আধুনিকতা-বিরোধী করে তোলার প্রবল প্রয়াস চালু হয়েছে গত সাতটা বছরে, এই জ্যোতিষের প্রেতকে পুনরুজ্জীবিত করার সরকারি উদ্যোগও তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
।। দুই ।।
জ্যোতিষের ভিত্তিহীনতার হাতে-কলমে ঘরোয়া প্রমাণ অত্যন্ত সুলভই ! এই যে দামি-নামি (অধিকাংশ) সংবাদপত্রে প্রতিদিন ‘‘রাশিফল’’ একটা অতীব জনপ্রিয় কলাম - তার ক’টা মেলে, মিলিয়ে দেখেছেন কী? প্রথম কথাই হলো যে, যদি যে কোনও একটা পত্রিকার ‘মহাবিজ্ঞ’ গণকবাবুর গোনাগাঁথা অনুযায়ী (যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নেন যে, সেগুলো ‘বৈজ্ঞানিক’ সত্য!) যদি দিনের বা সারা হপ্তার ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক, তাহলে তো সেই বচন পৃথিবীর সেই বিশেষ বিশেষ রাশির (যদি সত্যিই ‘রাশি’ বলে কিছু থাকে আদৌ!) অন্তর্গত দুনিয়ার সব লোকের একইরকম ‘ভাগ্যফল’(!) হতে হবে ! তাহলে একটা গড়পড়তা হিসেব যদি করিঃ ১২টি ‘রাশি’(!); ৩৭০-’৭২ কোটি মানুষ; অতএব, ৩৭২÷১২=৩১ সুতরাং রাশি পিছু ৩১ কোটি লোক। জ্যোতিষ গণনা অভ্রান্ত যদিই হয় (হাঃ হাঃ হাঃ), তাহলে প্রতি ৩১ কোটিরই এরকম ‘ভাগ্যফল’ হবে। এ কথার খণ্ডন আছে কি?
তারপরে, দ্বিতীয় প্রশ্নঃ কোনো পত্রিকার রাশিফল-নির্দেশই, অন্য কোনো পত্রিকার সঙ্গে একদমই মেলেনা! বরং, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, সম্পূর্ণ বিপরীত কথাই বলা হয় পত্রিকান্তরের ভবিষ্যদ্বাণীতে! তাহলে কী দাঁড়ালো রাশিফল গণনার নিট ফলাফল? সুকুমার রায়ের ‘হ-য-ব-র-ল’ বইয়ের সেই বিখ্যাত কাকেশ্বর কুচ্কুচের বচন অনুযায়ী, ‘‘সাত দুগুণে চৌদ্দর নামল চার, হাতে রইল পেনসিল’’ - হেঃ হেঃ হেঃ!
।। তিন ।।
জ্যোতিষের ফেরেব্বাজির প্রমাণ হিসেবে কিছু কিছু নিজস্ব অভিজ্ঞতার স্টক টেকিং (বা, ঝুড়ি উজাড়) করা যাক। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন গাঙ্গুলিবাবু। ভদ্রলোক অতি সজ্জন, পরোপকারী, সদাসর্বদাই হাসিমুখ, শান্তিপ্রিয় মানুষ - এবং সেটা সপরিবারেই। মানে, যাকে বলে আদর্শ প্রতিবেশী! মানুষটি খুব আস্থাশীল ছিলেন জ্যোতিষেও। তো, ওঁর একমাত্র মেয়ে যখন উচ্চ-মাধ্যমিক দেয়, তখনই ওঁরা আমাদের পাড়ায় এসে যান। মেয়ের রেজাল্ট বেরোলো। মোটামুটি ভালই করেছে। কলেজে ভরতি হবে। উনি গণনা করতে লাগলেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোন্দিকের (উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম) কলেজে ভরতি হলে তার বিদ্যাস্থান ‘শুভ’ হবে। যাক, ঘটনাচক্রে ওঁর যে কলেজটা পছন্দসই হলো, সেখানে ইতিমধ্যেই ভরতির লাস্ট ডেট চলে গেছে। একদা এই অভাজন সেখানে পড়াত, তাই সুপ্রতিবেশীর সাহায্যে মাঠে নেমে পড়তে হলো তাকে! প্রিন্সিপালকে অনুরোধ করে ব্যবস্থা করা গেল যে, লেট ফি দিয়ে ভরতি করা যাবে, কিন্তু সেখানে পরের দিনই এবং বেলা ২ টোর মধ্যে। গাঙ্গুলি মশাইয়ের সমস্যা তাতেও কমলো না। উনি পাঁজি খুলে দেখলেন যে পরের দিন আবার মঙ্গলবার এবং বাংলা মাসের সংক্রান্তি এবং তিথি হিসেবে একাদশী। একেবার, ‘ত্র্যহস্পর্শ অশুভ যোগ’! অর্থাৎ আমাদের বিচার-বুদ্ধি অনুসারে, ‘‘ত্রয়ী শক্তি, ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট/সংক্ষেপে বলিতে গেলে ‘‘হিং টিং ছট্’...’’ (রবীন্দ্রনাথ)। কিন্তু সে তো আর ওঁকে বলা যায় না! তখন আমার বৃদ্ধা মা ওঁর মাকে পরামর্শ দিলেন যে, সোমবার রাতেই তার যাবতীয় মার্কশিট ইত্যাদি নিয়ে ওর মামার বাড়িতে (পাড়াতেই) চলে যাক। পরদিন ভোরে ও ‘যাত্রা’ করে আগে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে এবং এখান থেকেই রওনা হবে কলেজের পানে! ওর বাবা, আলাদা গিয়ে সেখানে অপেক্ষা করবেন সকাল থেকে, বেলা ‘‘১২-৩৩ মিনিট ১৬ সেকেন্ড গতে’’ একাদশী ছাড়বে এবং তখন উনি মেয়ের সঙ্গে কলেজে ঢুকে ভরতি করিয়ে রাশিফল মেনে-টেনে তার শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে পারবেন!
এ অবধি তো যা হোক কাটানো গেল। কিন্তু সমস্যা হলো বেচারির বিএ ফাইনাল পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার প্রথম দিন ওই রকম মঘা-অশ্লেষা-খরবার-পল্-অনুপল্-বিপল্ দোষ ইত্যাদি, ইত্যাদি খণ্ডন করিয়ে গাঙ্গুলিদা মেয়েকে নিয়ে যখন হলে পৌঁছুলেন, তখন শুরুর ঘণ্টা বেশ খানিক আগে বেজে গেছে! যাক, কোনও মতে বেচারি মেয়েটা প্রায় আধঘণ্টা পরে লিখতে শুরু করতে পারে এবং - এবং দেরির কারণে নার্ভাস হয়ে নিজের রোল নম্বরটি ভুল লিখে আসেঃ ‘CAL.F,...’ ইত্যাদির বদলে শুধু ‘CAL...’ লিখে আসে এবং যথারীতি ওই দিনের পরীক্ষায় ও অ্যাবসেন্ট বলে গণ্য হয় এবং পরে (রেজাল্ট বেরোবার পরে) সবটা যখন সামনে আসে, ওর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় আর কোনও কিছু সহানুভূতি দেখাতে রাজি হয় না। সুতরাং প্রথম থেকে তিথি-নক্ষত্র-বার ইত্যাদি নিয়ে এত কসরত, সবই জলে গেল। বেশ ভালই ছাত্রী ছিল মেয়েটি, কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্রের শুভ-অশুভ ইত্যাদির প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে বেচারির একটা বছর নষ্ট হলো।... এর পরেও দুঃখের কথা আরও আছে। ওর বিয়ে ঠিক করেন গাঙ্গুলিদা, ডজনখানেক ছেলের ঠিকুজি, কোষ্ঠি, জন্মাবার গণ ইত্যাদি তাবৎ নক্ষত্র বিশ্বাসের বিধানের সঙ্গে ওর ওই সব মিলিয়ে যার সঙ্গে, সে না কি ওঁদের পুরোহিতের মতে ছিল রাজযোটক এবং মেয়ের “সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হবে।’’ খুব ভাল কথা। কিন্তু বেদনার বিষয় হলো, বিয়ের ঠিক চার বছরের মাথায়, দুটি বাচ্চা নিয়ে ও ফিরে এলো বাপের বাড়িতে... হ্যাঁ, বিধবা হয়ে। ওর স্বামীর একটা দুরারোগ্য ব্যাধি ছিল - গাঙ্গুলিদা জামাইয়ের কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখার ব্যাপারে এমনই মগ্ন ছিলেন যে, তার সেই ক্রনিক কঠিন অসুখটার বিষয়ে কোনও সুলুক সন্ধান করেন নি। গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব অসহায় ২৭ বছরের মেয়েটির রক্ষা কবচ হিসেবে সেবারও ঢাল হয়ে দাঁড়ালো না!
।। চার ।।
গ্রহ-নক্ষত্র বিদ্যা (অ্যাস্ট্রোনমির কথা বলছিনে, বলছি অ্যাস্ট্রোলজির প্রসঙ্গ) যে, কী পরিমাণ ‘ব্লাফ’ (ইংরাজিতে); ‘বকোয়াস’ (হিন্দিতে), ‘গুলপট্টি’ (রক্নি বাংলায়), ‘অন্তঃসারশূন্য’ (শুদ্ধ বাংলায়) - তার আর একটি বিরাশি বছুরে নজির দেখিয়ে লেখাটা গুটিয়ে আনব!... আপনাদের এই অভাজন কলমচি বড়ো হয়েছে এক বিরাট যৌথ পরিবারে। তার ঠাকুমার মা - পারিবারিক বয়ানে, বড়ো মা ছিলেন সেই বিগ ফ্যামিলির দ্য গ্রেট ম্যাট্রিয়ার্ক। তাঁকে, জনৈক ভোলানাথ পুরোহিত গুণে-গেঁথে বলেছিলেন যে, এই অভাজন (তখন তার বয়স ৮ বা ৯ বছর) ঘোর বিপদের মুখে, কারণ (না কি) ১৫ থেকে ১৬-র মধ্যে তার প্রায় অনিবার্য মৃত্যুযোগ আছে এবং স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদিতে যদি বা সেই বিপদ কাটে, তাহলেও ভগ্ন-স্বাস্থ্য এবং বিদ্যাহীন ও অপরিমিত দারিদ্র্যের মধ্যে যে কিছুদিন বেশি হয়তো বাঁচবে - এই বছর ৩৫-৩৬ অবধি এবং সেটার থেকে রেহাই পেতে গেলে মহা-স্বস্ত্যয়ন ও ফেৎকারিণী কবচ ধারণ ইত্যাদি করাতে হবে। বড়োমা, ঠাকুমা, জেঠিমা প্রমুখ প্রবল চিন্তায় পড়লেন - সেই সময়েই মোট খরচ ভোলা ঠাকুর মশাই বলেছিলেন পড়বে ১০-১২ হাজার টাকা... এবং তখন আমাদের বিশাল সংসারের মাসিক আয় শ-দু’য়েকের মতো এবং ব্যাঙ্কে লবডঙ্কা ঢং-ঢং করে বাজছে! ঋণ অনিবার্য, কিন্তু কে বা কারা দেবে? সেই প্রথমবার আমার মার্কসিস্ট বাবা (এবং তার সুযোগ্যা জীবনসঙ্গিনী আমার মা) বড়োমা নিয়ন্ত্রিত অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। কোনও স্বস্ত্যয়ন, কোনও ফেৎকারিণী, কোনও বিপত্তারিণী, বিঘ্ননাশিনী, পেরান-বাঁচায়নী কবচ ছাড়াই এই অভাজন তো বিরাশি বছর অবধি মোটামুখি খাড়া থেকেই চলে এলো ভাই... বিদ্যা কী হয়েছে জানি নে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলি ডিগ্রি জুটিয়ে (না না, সাউথ টেক্সাসের ডিগ্রি নয়, কলকাতা ইউনিভার্সিটি, রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটির) বহু বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করে এলো, কাজে-কাজেই ধনসম্পদ না থাকলেও ‘‘অপরিমিত দারিদ্র্যে’’ (ভোলা ঠাকুর কথিত) পড়তে হয়নি তাকে!! আত্মকথার ছিন্নপত্র তুলে আনলাম বলে, মার্জনা করবেন বন্ধুরা! তবে জ্যোতিষের ধাপ্পাবাজি প্রমাণের এমন বিরাশি-বছুরে নমুনা দাখিল করার লোভটা কিন্তু সামলাতে পারা গেল না!
।। পাঁচ ।।
আসলে যেনারা এই সব গোনা-গাঁথা করে টু-পাইস কামাচ্ছেন, তেনারা নিজেরাই কি এসবে বিশ্বাস রাখেন? তা রাখলে মেয়ের বিয়ের ভাল সম্বন্ধ এলে পাত্রের কোষ্ঠির সঙ্গে রাজযোটক (আবার গাঙ্গুলিদার মেয়ের কথা মনে পড়ছে!) মিলিয়ে কম্পিউটার মারফত জব্বর এক আধুনিক কোষ্ঠি ব্যাকডেট দিয়ে তৈরি করানোর খবর-টবর তো একেবারে দুষ্প্রাপ্য নয়!
তবে এসব কথা তো প্রায় ক্ষেত্রেই অরণ্যে রোদন! পঁচিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মহাকাশতত্ত্ব পড়াচ্ছেন যে প্রবীণ অধ্যাপক, তাঁকে যখন সূর্য গ্রহণের দিন গঙ্গা নাইতে যেতে দেখি কাঁধে তোয়ালে ফেলে, কিংবা নির্বাচিত ‘আধুনিক’ সরকারও শপথ গ্রহণের তারিখ ঠিক করে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করিয়ে, প্রগতিশীল বলে দাবি করা রাজনৈতিক কর্মীও প্রতিনিয়ত হোঁচট খান গ্রহ-নক্ষত্রের হিসেব-নিকেশ করে - সেখানে এই বিষগাছের ‘জড়’ উপড়ে ফেলা খুবই কঠিন, তা তো জানিই। তবে এ ব্যাপারে তো অগ্রণী হতে হবে আমাদেরকেই, কমিউনিস্টদেরই - শুধু বিজ্ঞানীরা প্রতিবাদ করলেই এ হলাহল সমাজের গলা থেকে নামানো যাবে না! মানুষকে অন্তত এটা বোঝাতে হবে যে, শেখার বিষয়, মানার বিষয় জ্যোতির্বিজ্ঞান - জ্যোতিষ নয়। তা নইলে ‘‘ভারতীয় ঐতিহ্য’’ ‘‘বৈদেশিক অপশিক্ষা’’ - ইত্যাদি বানানো কথার বুজরুকি কিন্তু বন্ধ করা যাবে না। আর সেটা গেলে, আখেরে ওই গোমাতার বাছুরদেরই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হবে। তা কী আমরা চাই?