৫৮ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা / ৯ জুলাই, ২০২১ / ২৪ আষাঢ়, ১৪২৮
ডাক পাঠায় সুন্দরবন
সৌরভ চক্রবর্তী
বিতর্ক চলছে সুন্দরবন নিয়ে টেলিভিশনে, খবরের কাগজে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। সাধারণত সুন্দরবন সম্পর্কে আলোচনা, মানুষের বাঘ দেখা না দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। খুব যে মানুষ সুন্দরবনে যেত এমনটা নয়। আয়লা, আমফান, ইয়াসে ত্রাণের কাজে অগণিত মানুষ সুন্দরবনে গেছেন, পরের পর সাইক্লোনের অভিঘাতে সুন্দরবন জুড়ে ধ্বংসলীলা মানুষ দেখেছেন, আলোচনা করার সক্রিয় গ্রুপের পরিধি বেড়েছে। এছাড়া পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিরাও আছেন। এসব মিলে বিতর্ক উঠেছে সমাজ জুড়ে। বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত কারণে উপর্যুপরি সাইক্লোন এবং তার ধ্বংসলীলা আজ বিশ্ব জুড়েই দৃশ্যমান। বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ আর কথার কথা নয়।
বিশ্ব উষ্ণায়ন-আবহাওয়া পরিবর্তন ও সুন্দরবন
গলে যাচ্ছে আল্পস, হিমালয়, আন্দিজ, আলাস্কার হিমবাহ। আমাদের হিমালয়ে বছরে দেড় ফুট করে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রের জলের স্তর ৮ ইঞ্চি বেড়ে গেছে যে হারে, তা বিগত দশকের হারের দ্বিগুণ। আমাদের দেশেও একইভাবে সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। আমরা দেখছি আমাদের সুন্দরবনেও এর কুপ্রভাব পড়ছে, ভূমিক্ষয় হচ্ছে, ম্যানগ্রোভ কমছে, ইতিমধ্যেই লোহাচড়া, সুপারিডাঙা, কাবাসগাদি, তালপাট্টি এই চারটি দ্বীপ জলের তলায় তলিয়ে গেছে। মৌসুনি, ঘোড়ামারা দ্বীপ ভীষণভাবে ভাঙছে।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা আলোচনা করব আমাদের প্রিয় সুন্দরবন নিয়ে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হলো ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’এর বিশেষ প্রতিবেদন, যাতে বলা হলো ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যেই প্রাক্ শিল্পায়ন পর্বের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়ছে। এক্ষুনি কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ২০১৬-র প্যারিস কনভেনশনে শতাব্দী শেষের ঘোষিত লক্ষ্য মাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে। ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, এ বিশ্ব বাসযোগ্য থাকবে বড়োজোর ১০০ বছর। আমাদের ভবিষ্যৎ ঘিরে অতিকায় এক প্রশ্ন চিহ্ন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এই আলোকেই তামাম বিশ্ব, আমাদের দেশ, রাজ্য, আমাদের সুন্দরবনকে দেখতে হবে।
বিশ্ব উষ্ণায়নে দুটো কারণে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি হয়। এক, হিমবাহগুলো গলে গিয়ে, মেরু অঞ্চলের সঞ্চিত বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জল স্তর বাড়িয়ে দেয়; দ্বিতীয়ত, উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে ‘থার্মাল এক্সপানশন’ হয়, ফলে সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে জলস্তর বেড়ে যায়। জল ভূখণ্ডকে প্লাবিত করে। সুন্দরবনের দ্বীপভূমি জলে ডুবে যায়, ভাঙন হয়, এই কারণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পরিমাণ কমছে। রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস ব্যবহার করে যাদবপুরের 'স্কুল অফ ওসানোগ্রাফি' ১৯৮৬-২০১২ পর্যন্ত যে তথ্য প্রমাণ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পরিমাণ ১২৪.৪১৮ বর্গকিলোমিটার কমেছে। এতে ভবিষ্যতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের যে কার্বন শুষে নেওয়ার ক্ষমতা এবং অন্যান্য বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমজনিত উপযোগিতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বসবাসকারী মানুষেরা ইতিমধ্যেই উদ্বাস্তু হচ্ছেন। এই উদ্বাস্তুদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এনভায়রনমেন্টাল রিফিউজি’ বা পরিবেশ উদ্বাস্তু। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে।
সাগরদ্বীপে ১৯৮৫-২০১০ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর ২.৬-৪ মিলিমিটার জলস্তর বাড়ছে। ১৮টা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দ্বীপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে অবস্থা ভয়াবহ। গোসাবার ২০ শতাংশ ক্ষয় হয়েছে। জম্মু দ্বীপে এই ক্ষয় ১০ শতাংশ। সজনেখালি উত্তর, মাতলা, বুলচেরির অবস্থা ভালো নয়। ভারতের সুন্দরবনের যথেষ্ট পরিমাণে পলি জমছে না, মিষ্টি জলের পরিমাণও কম, ভাগীরথী তা বয়ে নিয়ে আসতে পারছে না, পশ্চিমের সুন্দরবন, পুবের সুন্দরবনের তুলনায় তুলনামূলকভাবে নিচু। ফলত, নোনা ভাগ বেশি। এরপর সমুদ্রের জলস্ফীতিজনিত কারণে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ডুবে যাচ্ছে। মিষ্টি জলের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে, ‘ম্যানগ্রোভ সাকসেসন’ এর পরিবর্তন ঘটছে। মিষ্টি জলের ম্যানগ্রোভ নোনা জলের ম্যানগ্রোভে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এর বাস্তুতন্ত্রজনিত প্রভাব মারাত্মক। বাংলাদেশের সুন্দরবনের এই সমস্যা নেই। সেখানে তুলনামূলকভাবে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা বিপুল পরিমাণে পলি এবং মিঠে জল বয়ে নিয়ে আসছে। তাদের জমি বাড়ছে। ১৯৮৮-১৯৯৫-এর মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবনের চারটি দ্বীপ লোহাচড়া, সুপারিডাঙা, কাবাসগাদি, তালপট্টি জলের তলায় তলিয়ে গেছে। ছয় হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন সাগরদ্বীপের ক্ষেত্রেও ৩০,০০০ পরিবেশ উদ্বাস্তু হবার সম্ভাবনা আগামীদিনে। (ইন্ডিয়া টুডে, ১৭ জুলাই, ২০১২)।
এর সাথে রয়েছে আবহাওয়া পরিবর্তন। ঘনঘন প্রাণঘাতী সাইক্লোনের সমস্যা। কেন হচ্ছে এই সমস্যা? ২০২১ সালের ২৮ মে ইন্ডিয়া টুডে-তে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হলো যে, বিগত ১২ মাসে বঙ্গোপসাগরে চারটি সাইক্লোন তৈরি হয়েছিল - সিভিয়ার সাইক্লোন আমফান (১৬-২১ মে, ২০২০), সিভিয়ার সাইক্লোন নিডার (২২-২৬ নভেম্বর, ২০২০), সিভিয়ার সাইক্লোন বুরেডি (৩০ নভেম্বর-৫ ডিসেম্বর, ২০২০) এবং ইয়াস (২৩ মে-২৭ মে, ২০২১)।
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণেই সাইক্লোন-এর জন্ম হচ্ছে এবং যার প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। ভারতীয় উপমহাদেশের সমুদ্র আগের তুলনায় উষ্ণ হয়েছে। সাইক্লোন জন্মাতে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড প্রয়োজন, যাকে বলে ‘থ্রেশহোল্ড টেম্পারেচার’, কিন্তু বঙ্গোপসাগর, আরবসাগর, ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছেছে। এটাই অশনি সংকেত। আজকের সুন্দরবনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত কারণে আবহাওয়া পরিবর্তন, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলস্তর-এর উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দ্বীপের ডুবে যাওয়া, ভাঙন, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি
এর সাথে রয়েছে সুন্দরবনের লবণাক্ততার পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত, ফরাক্কায় গঙ্গা, পদ্মা এবং ভগীরথীতে ভাগ হলো। পদ্মার মিঠে জলের পরিমাণ বাড়লো। ভাগীরথী হয়ে হুগলি নদীতে কম মিঠে জল নিয়ে বইলো এবং জলের কম পরিমাণের কারণে কম পলি নিয়ে বইলো। সুন্দরবনের পশ্চিমের ঢাল পূর্বের তুলনায় বেশি। ফলত ভারতের সুন্দরবনের নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশ, আবার পলি জমার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। তাই ডাঙা তৈরি হওয়ার পরিমাণ বেশি।
সুন্দরবনের জৈব বৈচিত্র্য
সুন্দরবন হলো পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্যভূমি। এর বিশেষত্ব হলো, এই ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ ভূমিতে বাঘ থাকে, যা বিশ্বের আর কোনও ম্যানগ্রোভ অরণ্যে থাকে না। এটিও সুন্দরবনের ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্যভূমির তুলনাহীন বৈশিষ্ট্য। উষ্ণ অক্ষাংশে, সমুদ্রে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সৃষ্টি হয়। সুন্দরবন ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনার পলিবাহিত ভূমি, এর নদী-খাড়িগুলি নির্দিষ্ট মাত্রার লবণাক্ত। এই পরিবেশে সুন্দরবনের নদী খাড়ি স্থলভাগে রয়েছে অনু উদ্ভিদ ও অনু প্রাণীর জৈব বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য্য।
৫০টির বেশি ব্যাকটেরিয়া, দু’শোর বেশি অনু ছত্রাক, ২০টির বেশি অনু শৈবালের উপস্থিতি জানা গেছে। এইসব উদ্ভিদ সুখাদ্য অনু খাদ্যের যোগান দিয়ে সুন্দরবনের বৈচিত্র্যকে ঋদ্ধ করছে, রক্ষা করছে।
ম্যানগ্রোভ বনানীর তলে পড়ে থাকা লতাপাতা, ফলমূল, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু, অনুছত্রসকের বিয়োজনে যে শর্করা ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য তৈরি হয় তাকে বলে ‘ডেট্রিটাস’, সেইসঙ্গে তৈরি হয় জৈব নাইট্রোজেন, ফসফেট, জৈব কার্বন। তার বেশিরভাগই থেকে যায় বনতলে, বাকিটা ভাটার টানে গিয়ে মেশে নদীর জলে, সেখানেই এই অনু খাদ্য প্রবাহমান জলে জন্মাতে সাহায্য করে ভাসমান এককোষি সবুজ উদ্ভিদ, যাকে বলে ‘ফাইটোপ্লাংক্টন।’
ফলে বাড়ে অনু প্রাণী ‘জুপ্লাংক্টন।’ এদের টানে ছুটে আসে দূর সমুদ্র থেকে অসংখ্য মাছ ও চিংড়ির পোনা ও সামুদ্রিক প্রাণীর ছোটো ছানাপোনারা। এভাবেই ম্যানগ্রোভ, নদী-খাড়ি অনুখাদ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী অন্যান্য প্রাণী পাখি, সাপ, মাছ মিলে তৈরি হয়েছে এক পরস্পরের নিবিড় শৃংখলে আবদ্ধ বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম, যার বৈচিত্র্যকে বলা হয় জৈব বৈচিত্র্য। সুন্দরবনের জৈব বৈচিত্র্যের মাহাত্ম্য জগৎজোড়া। এখানে ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩২ প্রজাতির কাঁকড়া, একশো কুড়ি প্রজাতির মাছ রয়েছে, গোসাপ দু’রকমের, ‘বেঙ্গল মনিটর’ এবং ‘ইয়েলো মনিটর।’ সামুদ্রিক রিডলে কচ্ছপ শীতকালে সুদূর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সুন্দরবনের বালুকাবেলায় ডিম পাড়তে আসে, ডিম পাড়ে অতি বিরল বাটাগুর কচ্ছপ। সাপেদের মধ্যে ময়াল, শঙ্খচূড়, পাখিদের মধ্যে শামুকখোল, লার্জ এবং মিডিয়াম এগ্রেট, কোর্চেবক ‘লিটল এগ্রেট’, পানকৌরি, বিলুপ্তপ্রায় সিন্ধু-ঈগল, বড়ো মাছখেকো বাজ, পূর্ব আফ্রিকার ‘গলিয়াথ হেরন’ বা ‘জায়েন্ট হেরন।’ শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে উরাল থেকে চলে আসে ‘পিনটেল’, ‘ওয়াইজিয়ন’ ও টাফ্টেড পোচার্ডের দল। এই বিশাল জৈব বৈচিত্র্যের জন্যই সুন্দরবনের জগৎজোড়া খ্যাতি।
কুমির, হাঙর, পার্শে, ভাঙড়, বাগদা চিংড়ির চাষ, লাল কাঁকড়া (মাড ক্র্যাব)-র চাষ খুবই লাভজনক। গলদা চিংড়ি, উত্তরের দিকে ভারতীয় লবস্টার পাওয়া যায়। আছে ঔষধি গাছ, সামুদ্রিক গুল্ম, হর্সশুক্র্যাব যা থেকে ওষুধ তৈরি হয়। সুন্দরবনের লাল কাঁকড়া রপ্তানিযোগ্য উপাদেয় খাদ্য।
এই নিবিড় বাস্তুতন্ত্রের সাথে মানুষ যুক্ত না থাকলে, আজকের সুন্দরবনের দ্বীপগুলির জলে ডুবে যাওয়া অবনমন, ভাঙন, ম্যানগ্রোভের পরিমাণ কমে যাওয়া অন্যভাবে আলোচনায় আসত, কিন্তু সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের ৫৪টি দ্বীপে ৫০ লাখের উপর মানুষ বাস করে, তারা বাস্তুতন্ত্রের অংশ। অন্যান্য প্রাণীর জীবিকা হয় না শুধু জীবন হয়, তাই মানুষের জীবন-জীবিকা দুটো নিয়েই আলোচনা হবে, দুটোই আক্রান্ত আজ।
সুন্দরবনে মনুষ্যবসতি আজকের নয়
ঐতিহাসিকভাবে আমরা পাচ্ছি ২৩০০ বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় গঙ্গারিডি নামে এক শক্তিশালী রাজ্য ও জাতি ছিল। গঙ্গা নদীর নামে এই রাজ্য ও জাতির নামকরণ হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। এর শৌর্যবীর্যের কাহিনী শুনে আলেকজান্ডার এই দিকে অগ্রসর হননি এমন কথা ঐতিহাসিক থিওডোরাস বলে গেছেন। পেরিপ্লাস ও টলেমির বিবরণ থেকে জানা যায়, গঙ্গারিডরি রাজধানী ছিল গঙ্গে নামক স্থানে। গঙ্গে ছিল এক প্রসিদ্ধ বন্দরের নাম। সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় এখান থেকে সুদূর পশ্চিম-এ যেত। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এটা প্রমাণ হয় যে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দেগঙ্গা - হাড়োয়া অঞ্চলের অন্তর্গত চন্দ্রকেতুগড় আসলে গঙ্গে বন্দর, গঙ্গে রাজধানী, গঙ্গারিডি সভ্যতা। খননকার্যে প্রাপ্ত ধূসর মাটির পাত্র, রূপা তামার স্বর্ণমুদ্রা, নানা মূর্তি, সিলমোহর থেকে প্রমাণ হয় এই সভ্যতা প্রাক মৌর্য থেকে কুষাণ, শুঙ্গ, গুপ্ত, পাল, সেন এই ছয় সভ্যতার কালপর্বজুড়ে বিস্তৃত ছিল। আজকের সুন্দরবনের উত্তরের সীমানা ডাম্পিয়ার - হজেস লাইনের মধ্যে অবস্থিত অর্থাৎ এই সভ্যতা সুন্দরবনে বিস্তৃত ছিল। টলেমির মানচিত্রে আদিগঙ্গা ও বিদ্যাধরীর মধ্যবর্তী এলাকাকে বলা হয়েছে গঙ্গারিডি রাজ্য।
প্রত্নতত্ত্বে সুন্দরবন
আমাদের পৃথিবীর বহিঃত্বকের গভীরে কতকগুলো সুবিশাল এবং কতকগুলো ছোটো পাথরের প্লেট, তার নিচের গলিত পাথুরে স্তর ম্যাগমার উপর ভাসছে। এই প্লেটগুলোর ভেসে-ভেসে স্থান পরিবর্তনে পৃথিবীর মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটে। একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের গায়ে উঠে পড়লে ভূমিকম্প বা সুনামি হয়।
এবার এই প্লেটটেকনোনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আরও একটি চিরকালীন প্রক্রিয়া অর্থাৎ গ্লেসিয়েশন এবং ডি-গ্লেসিয়েশন বা তুষার জমা এবং তুষার গলে যাওয়া চক্রের প্রভাবেও বঙ্গীয় অববাহিকায় পুরা ভূতাত্ত্বিক ভূ-প্রকৃতি তথা সুন্দরবনের পুরা অবস্থানের পরিবর্তন হয়ে চলেছে। এর প্রভাবে সমুদ্রের জলস্তরের স্ফীতি এবং জলস্তর নামার ঘটনা ঘটে। সমুদ্র মহাদেশগুলির অভ্যন্তরে ঢুকে আসে তখন তাকে বলে ট্রান্সগ্রেশন আবার যখন জল বেরিয়ে যায় বহুদূরে উপকূলের ধারে তখন তাকে বলে রিগ্রেশন।
প্রকৃতির এই নিরন্তর পরিবর্তনের প্রভাবে পুরা সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অঞ্চলসহ পুরা সমুদ্র উপকূল বারবার ভারতীয় উপমহাদেশের ভেতরে ঢুকেছে এবং বেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ যে সুন্দরবন এখন দেখছি তা চিরকাল এমনই ছিল না। এই পুরাতাত্ত্বিক ঘটনা আবার এটাই প্রমাণ করলো এ জগতে যা কিছু আমরা দেখি তা চিরন্তন নয়, পরিবর্তনশীল।
পুরা উদ্ভিদ প্রমাণ অনুসারে সাত কোটি বছর আগে আন্তঃক্রেটেসিয়াস পর্বে বোলপুর, বর্ধমান, ঘাটাল, জলঙ্গীর শিলাস্তরে গোলপাতা গাছের রেণুর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তখন এই অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল সুন্দরবন। হিমালয়ের উত্থানের জন্য বারে বারে টেকটনিক মুভমেন্ট হয়েছে, তার প্রভাবে বঙ্গীয় অববাহিকার অভ্যন্তরে সমুদ্র প্লাবন হয়েছে। ২ কোটি বছর আগে ভুটান-দার্জিলিংয়ের পাদদেশে শিবালিক শীলাস্তরে সুন্দরবনের বাইন, খলসী গাছের পাতা, সল্ট গ্ল্যান্ড সহ পাতার কিউটিকল এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির যেমন গোলপাতা বাইন, কেওড়া, গর্জন গাছের পরাগরেণু পাওয়া গেছে।