৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
বিভাজন এবং হিংসার রাজনীতিকে পরাস্ত করার শপথ নিল কাছারি ময়দানের সমাবেশ
কাছাড়ি ময়দানে সিপিআই(এম)-র সমাবেশে বলছেন মহম্মদ সেলিম।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশজুড়ে বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে আর রাজ্যে তাদের দোসর তৃণমূল খুন সন্ত্রাস করে ভোটে জিততে চাইছে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে। বিভাজন এবং হিংসার এই রাজনীতিকে দৃঢ়কণ্ঠে না বলতে হবে। সংবিধানসম্মতভাবে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সংসদীয় ব্যবস্থা বজায় রাখতে এবং বিকেন্দ্রীকরণের স্লোগানকে কার্যকর করতে বিজেপি তৃণমূল বিরোধী সমস্ত শক্তিকে মাথা উঁচু করে একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে। ৬ জুন বারাসতে কাছারি ময়দানে সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির ডাকে আয়োজিত সুবিশাল জনসভায় এ কথা বলেন নেতৃবৃন্দ। ভয়াবহ দাবদাহ এবং হুমকি সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এদিন জমায়েতে অংশগ্রহণ করেন।
এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাশ। বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদক ও পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এবং জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি সহ জেলা বামফ্রন্টের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। তৃণমূল জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপিআই(এম) সমর্থকদের সভায় যোগ দেওয়া আটকাতে নানাভাবে হেনস্তা করেছে, ভয় দেখিয়েছে - কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই লাখো মানুষের জমাট ভিড় উপচে পড়েছে বারাসতের কাছারি ময়দান লাগোয়া প্রায় সব রাস্তায়।
গৌতম দেব অসুস্থতার জন্য এদিন সমাবেশে না এলেও তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয় সভায়। জমায়েতে সন্ত্রাস ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আসা মানুষকে তিনি অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর বার্তায় বলেন, ধর্মান্ধ শক্তি বিজেপি মানুষের মধ্যে বিভাজন আনার যে চেষ্টা করছে এবং তৃণমূল কংগ্রেস যে বোমার রাজনীতি করছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে উপযুক্ত ভূমিকা মানুষ পালন করবেন।
সভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, বারাসতের কাছারি ময়দানে সভা করতে দেবে না বলেছিল জেলার পুলিশ প্রশাসন। এই সভা প্রমাণ করছে - ‘না’ কে কী করে ‘হ্যাঁ’ করতে হয় তা জানেন বাংলার মানুষ। এখানে জেলাশাসকের দপ্তর অভিযানের সময় ছোটো ছেলে মেয়েদের জেলে ভরেছিল প্রশাসন। কিন্তু মানুষের মনোবল ভাঙতে পারেনি। অনেক মিথ্যাচার, মিথ্যা মামলা, জেল জরিমানা হয়েছে, মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, কিন্তু লাল ঝান্ডাকে মুছে দেওয়া যায়নি বাংলা থেকে।
তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে মোদি-শাহ’রা মিলে ২০১১ সালে বলেছিল ‘লাল হটাও দেশ বাঁচাও’। বাংলা থেকে বামফ্রন্ট সরকার সরেছে কিন্তু দেশ বাঁচেনি। গোটা দেশে এখন লুট চলছে। আমরা সেই লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী রোজ মিথ্যে বলছেন, ভাঁওতা দিচ্ছেন, কিন্তু মানুষ ধরে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, এই লুট চলেছে মিথ্যে আর বিভাজনের জোরে। গত ১২ বছর ধরে বিজেপি-তৃণমূল মানুষকে ভাষার নামে, জাতের নামে ভাগ করেছে। আরএসএস মমতাকে দুর্গা সাজিয়ে বজরং দল, হিন্দু সংহতি, দুর্গা বাহিনীর মতো সংগঠনগুলিকে পাশে দিয়ে ১২ বছর ধরে আমাদের রাজ্যের মানুষকে ভাগ করেছে। এই জেলার কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়ায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হয়েছে। মানুষ খুন হয়েছেন রেলের প্লাটফর্মে। আমরা শান্তি মিছিল করেছি। ধুলাগড়ে দাঙ্গার পর সীতারাম ইয়েচুরি এসেছিলেন এবং এই জেলার বসিরহাটে যখন দাঙ্গা হলো তখনও আমাদের ঢুকতে দেওয়া হলো না। যারা দাঙ্গা করে সেই জামাত-জমিয়ত-আরএসএস-বিজেপি-কে কেন ঢুকতে দেওয়া হলো?
তিনি বলেন, তৃণমূল আগে এসেছে তারপর তাদের ঘাড়ে চেপে বিজেপি এসেছে। এদের মধ্যে কোনো তফাত নেই। সংসদে দেখা যায় নাগরিকত্ব বিল থেকে কৃষক মারা বিল, সব ব্যাপারেই তৃণমূল-বিজেপি এককাট্টা। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, হাওড়ায় দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু সেখানে হিন্দু-মুসলিমের বিরুদ্ধে বা মুসলিম হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়তে চাইছিল না। মানুষকে তখন ভুল বোঝানো হলো।
তিনি বলেন, জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা কেন হয় না? জ্যোতি বসু উত্তর দিয়েছিলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন তৃণমূলের সময় কেন দাঙ্গা হয়?
তিনি বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সিবিআই-ইডি’র হিম্মত হয়নি কোনো বামপন্থী নেতাকে গ্রেফতার করার। আর এখন ভাইপো, ভাইপোর বউয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে রক্ষাকবচ চাইতে হচ্ছে। এদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে লাল ঝান্ডার শক্তিকে মজবুত করে ওপরে তুলতে হবে। তৃণমূল বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তি যারা মাথা উঁচু করে এদের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি বলেন, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন দুটো জায়গাতেই চোর ঢুকেছে। স্কুল বন্ধ হচ্ছে। মাদ্রাসা বন্ধ হচ্ছে। তাই শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাদ্রাসা আর স্কুলকে বাঁচাতে একসাথে লড়তে হবে।
তিনি বলেন, মোদি-অমিত শাহরা দেশকে সংবিধান অনুযায়ী চালাচ্ছে না। আমরা সংবিধান থেকে বিচ্যুত হতে দেব না - এই শপথ নিতে হবে আমাদের। ধর্মনিরপেক্ষতা, সংসদীয় গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আমাদের ধরে রাখতে হবে। এটাই লড়াই। আমরাই বলেছি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, রাজ্যের হাতে বেশি ক্ষমতার কথা, জেলা পরিষদ-পঞ্চায়েত-পুরসভার হাতে, গ্রামসভা-ওয়ার্ড কমিটির হাতে বেশি ক্ষমতা দেবার কথা। মমতা ব্যানার্জি এসে গ্রাম সভা তুলে দিলেন, আর মোদি এসে লোকসভা তুলে দিলেন। এই জন্য ওরা লাল ঝান্ডা চায় না, আপসে যাতে খেলে নিতে পারে। এই পুলিশ, সিভিক-কে দিয়ে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নমিনেশন দিতে দেয়নি আমাদের। মা বোনেদের চুলের মুঠি ধরে মারা হয়েছে। আমরা ডিএম-এসপি-ইলেকশন কমিশন-নবান্ন-কে বলছি এটা ২০২৩, ২০১৮-নয়। এরপরে যদি কমিউনিস্টদের খুন করার রাজনীতির খেলা আবার শুরু করেন তাহলে বাংলার রং নীল সাদা হবেনা, লাল হয়ে যাবে। লড়াই করতে গেলে হিন্দু-মুসলমান-তপশিলি-আদিবাসী-রাজবংশী-কুড়মি-রাভা-মেচ আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই করতে হবে - তবেই জয় আসবে।
বক্তব্য রাখছেন সুজন চক্রবর্তী।
কাছারি ময়দানের এই সভাকে ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করে সুজন চক্রবর্তী বলেন, চক্রান্ত রুখে এই সভা করতে পারার যে লড়াই তাতে আমরা জিতেছি আর নীল সাদা বাড়ি হেরেছে। মানুষের দাবির জন্য আমাদের এই মিটিং। আমাদের পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, রাজ্যে আইনের শাসন চাই। ১০০ দিনের মজুরি চাই, ২০০ দিনের কাজ চাই। কেরালা যদি পারে একুশ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দিতে আমরা কেন পারব না?
তিনি বলেন, তৃণমূল যা পায় তাই খায়। গোরু পাচারের টাকা, বালি পাচারের টাকা, কয়লা পাচারের টাকা খায়। আবাস যোজনার ঘর লুটের টাকা, ১০০ দিনের টাকা লুট, স্কুল কলেজের চাকরি লুট, একের পর এক লুট চলেছে। কিন্তু এখন যাবে কোথায়। আর ভাইপো বলছে, শুভেন্দু টাকা চুরি করেছে। এ কথা ওর বলার দরকার নেই। সিপিআই(এম) শুরু থেকেই বলেছে - যাহা বিজেপি তাই তৃণমূল।
তিনি বলেন, যে তৃণমূল ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসেব বুঝে নেওয়ার কথা বলতো তারা এখন কোর্টের বেঞ্চিতে বেঞ্চিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে রক্ষা কবচ পেতে। তৃণমূল এখন ভাজা পাপড় হয়ে গেছে। টোকা মারলেই ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। রাজ্যের মানুষ একবার তৃণমূলকে বিশ্বাস করে ঠকেছেন। আবার বিজেপি এসেছে তাদের ঠকাতে, কিন্তু গরিব মানুষ বুঝে গেছেন অপরাধী লুটেরা তৃণমূল-বিজেপি’র জোঁকের মুখে নুন হচ্ছে বামপন্থীরাই।
প্রশাসন এবং পুলিশের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ এবং প্রশাসনে বসে থেকে তৃণমূলের দালালি চলবে না। নন্দীগ্রামে ভাইপোর মিছিলে প্রায় চার হাজার পুলিশ হাঁটতে দেখা গেছে। এসপি এবং পুলিশ কর্তাদের বলছি, পুলিশের উর্দি আপনার নিজের সম্পত্তি নয়। মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কেনা। হয় এই উর্দিকে মর্যাদা দিন, না হলে মানুষ উর্দি টেনে ছিড়ে ফেলে তৃণমূলের পোশাক পরিয়ে দেবে। এই ধরনের অঘটন যাতে আমাদের ঘটাতে না হয় সেটা খেয়াল রাখবেন।
বক্তব্য রাখছেন পলাশ দাশ।
পলাশ দাশ বলেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গ বদলাচ্ছে। ১২ বছর ধরে এ রাজ্যের মানুষ ভয় পেতে পেতে ভয়কে জয় করে ফেলেছেন। আমরা দুর্নীতির বিরোধিতার ডাক দিয়ে রাজ্যের প্রতিটি বুথে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ বলছেন, তৃণমূলের এই দুর্নীতির রাজত্বের অবসান চাই। ২০২১ সাল পর্যন্ত বিজেপি মানুষকে বুঝিয়েছিল, তৃণমূলকে ঠেকাতে পারে বিজেপি আর তৃণমূল বলেছিল বিজেপি’কে তারাই রুখতে পারে। ওদের তো কথা ছিল চাকরি দেবার, জিনিসপত্রের দাম কমানোর, কলকারখানা তৈরি করার! কিন্তু ওরা মানুষের কাছে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান, জাত-পাত বুঝিয়ে বিভাজন তৈরি করছে কেন? ওরা সিপিআই(এম)-কে ভয় পাচ্ছে। কারণ রেগার বকেয়ার দাবি, ফসলের দাম, মজুরির দাবি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরাই একমাত্র লড়াই করছি।
তিনি বলেন, আমাদের এই সভা করতে দিতে চায়নি তৃণমূল সরকার। গত সাতদিন ধরে বারাসত ২, হাড়োয়া, মিনাখা, সন্দেশখালি, বারাকপুর, টিটাগড়, বিরাটি, বিশরপাড়া জেলার এইসব জায়গায় আমাদের ওপর বার বার আক্রমণ হয়েছে। ন’জন কমরেড গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। আজকে পালটা দেওয়ার জায়গায় সিপিআই(এম) দাঁড়িয়েছে। আমরা হিংসা চাই না। কিন্তু যদি কোনো সিপিআই(এম) কর্মীর মাথা তৃণমূলীরা ফাটায় তাহলে তাদের মাথাও অক্ষত থাকবে না!
এই সমাবেশ থেকে বলছি মমতা ব্যানার্জির সরকার আউটগোয়িং সরকার। বিভিন্ন জায়গায় থানা, বিডিও দপ্তর, জেলা পরিষদে বঞ্চিত মানুষ জড়ো হচ্ছেন। মানুষের মনে ঘৃণা তৈরি হয়েছে। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ যা গণতন্ত্রে অভিপ্রেত নয়। চুরি দুর্নীতিতে ল্যাজে গোবরে অবস্থা তৃণমূলের। এই তৃণমূল সরকার যেমন থাকবে না তেমন এই সরকারের অভিভাবক মোদি সরকার - ২০২৪ সালে সেটাও থাকবে না।
তিনি বলেন, টেলিভিশনের প্রচারে আমরা নেই, কিন্তু মাঠে ময়দানে পাড়ায় মহল্লায় গলিতে সব জায়গায় আমরা মানুষের পাশে আছি। মানুষ তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা বুঝছেন। পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের সমর্থন করুন। আবার আমরা পশ্চিমবঙ্গকে নতুন করে গড়ার দিকে এগোই।
জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, কাছারি ময়দানের এই সুবিশাল জমায়েত প্রমাণ করছে মানুষ জাগছে। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদের ৫৭টার মধ্যে কুড়িটি আসনে আমরা জিতি। ছটা পঞ্চায়েত সমিতিতে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই। চল্লিশ শতাংশ পঞ্চায়েত আমরা দখল করেছিলাম। এই পরিস্থিতি দেখে তৃণমূল পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে এবং সমাজবিরোধীদের নিয়ে তারপর থেকে ভোট লুটের মধ্য দিয়ে সব দখল করার পথ নিল। এতদিন ধরে যারা নানাভাবে বালি, পাথর, গোরু পাচারের মধ্য দিয়ে লুট চালিয়েছে তারা এখন ভয় পেয়েছে ধরপাকড়ের জেরে। এরা মানুষের কথা বলে না। মানুষের কথা বলি আমরাই।