৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
পৌরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে দিনভর সিবিআই তল্লাশি
আটক বহু নথি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ এরাজ্যে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ মদতে যে পাহাড়প্রমাণ নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে, তার তদন্তে গত ৭ জুন দিনভর সিবিআই তল্লাশি চলেছে। এদিন সকাল থেকে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড়ো তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই। সিবিআই আধিকারিকদের ২২টির বেশি তদন্তকারী দল একযোগে ১৪টি পুরসভা সহ প্রায় ২০টি জায়গায় তল্লাশি চালায়। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের হুগলির জগুদাসপাড়ার বাড়ি, ফ্ল্যাট ও অফিসে তল্লাশি চালিয়ে প্রাইমারি টেটে দুর্নীতির বেশ কিছু নথি ও পৌরসভায় চাকরির ওএমআর শিট পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
এছাড়াও এদিন সিবিআই’র তদন্তকারী দল সল্টলেকে পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরেও তল্লাশি চালায়। এখানেই বসেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এখানকার সহ-সচিব পদমর্যাদার এক অফিসারকে সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে এসে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এদিন উত্তর ২৪ পরগনার দমদম, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদম, বরানগর, কামারহাটি, টিটাগড়, বারাকপুর, নিউবারাকপুর, পানিহাটি, হালিশহর, কাঁচরাপাড়া, বাদুড়িয়া সহ নদীয়ার কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর পৌরসভায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই।
এদিনের এই তল্লাশি অভিযানে একাধিক পৌরসভা থেকে অসংখ্য নথি ও ডিজিটাল তথ্য উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গেছে। সিবিআই’র দাবি কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতি ও টাকার বিনিময়ে ওএমআর শিট বিকৃত করেই চাকরি বিক্রি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তদন্তকরী সংস্থার সূত্রে দাবি, এ রাজ্যে ৭০টির বেশি পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে। মূলত ২০১৪ ও ২০১৭ সালে টাকার বিনিময়ে বাঁকাপথে অফিস কর্মী, কম্পিউটার অপারেটর সহ মজুর ও সাফাই কর্মীও নিয়োগ হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন পুরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং এগজিকিউটিভ অফিসার কারা ছিলেন, কীভাবে নিয়োগ হয়েছিল, কোন পথে কত কর্মী নেওয়া হয়েছিল - এই সমস্ত কিছুর নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। এর পরেও আরও নথি জমা দিতে সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে প্রায় আড়াই মাস আগে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের হুগলির ফ্ল্যাট ও পৈত্রিক বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়ে পুর নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু নথি মিলেছিল বলে দাবি করেছিলেন ইডি’র তদন্তকারী আধিকারিকরা। তারপরই গ্রেপ্তার করা হয় অয়নকে। তাঁর কাছে হুগলি জেলার পঞ্চায়েতে নিয়োগ সংক্রান্ত নথিও মিলেছে বলে জানা গেছে।
তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর এই অয়ন শীলের সংস্থা এবিএস ‘ইনফোজেন প্রাইভেট লিমিটেড’কে পৌরসভায় নিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এজেন্সি হিসেবে বরাত দেওয়া হয়। এরা ইন্টারভিউ নেওয়া থেকে শুরু করে ওএমআর শিট ছাপানো, নিয়োগপত্র দেওয়া ইত্যাদি সব প্রক্রিয়ার বরাত পেয়েছে। আবার এই অয়নেরই অপর একটি সংস্থা ‘এবিএস ইনফ্রোজোন প্রাইভেট লিমিটেড’ পৌরসভাগুলির যাবতীয় নির্মাণকার্য থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের যাবতীয় বরাত পেয়ে এসেছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, একজন প্রমোটারেরই দু’টি সংস্থাকেই একদিকে পৌরসভার নিয়োগ ও অন্যদিকে পৌরসভার কাজের সমস্ত বরাত দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, পৌরসভায় নিয়োগের জন্য বিভিন্ন পদে আলাদা আলাদা করে রেট চার্ট করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী পৌরসভায় গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের জন্য ৪ লক্ষ টাকা, গাড়ি চালকের জন্য ৪ লক্ষ টাকা, সাফাই কর্মীর জন্য ৪ লক্ষ টাকা, টাইপিস্ট পদের জন্য ৭ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ইডি বলেছে, পৌরসভার নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে।
এদিন সিবিআই সূত্রে দাবি, অয়নের বাড়ি থেকে যে নিয়োগ দুর্নীতির তথ্য মিলেছে, তা হৈমশৈলের চূড়া মাত্র। তদন্তকারীদের অভিযোগ, বেআইনিভাবে পুরসভাগুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এগজিকিউটিভ অফিসার ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে শাসকদলের স্থানীয় নেতা, নগরোন্নয়ন দপ্তরের কর্মী-অফিসার, মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশনের কর্তাব্যক্তি ও বিভাগীয় সচিবদের একাংশ জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে।
এ রাজ্যে তৃণমূলের জমানায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া দুর্নীতির তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই নিত্যনতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। পরিস্থিতিও দ্রুত ভিন্ন পথে মোড় নিচ্ছে। সব মিলিয়ে জেরবার শাসকদল ও সরকার। রাজ্যবাসীর আজ আর অজানা নয় শিক্ষক নিয়োগ সহ পৌর কর্মী নিয়োগ, গোরু ও কয়লা পাচার কাণ্ড এবং ১০০ দিনের কাজ, আবাস প্রকল্প ও পঞ্চায়েতের অন্যান্য প্রকল্প মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্ত স্তরের নেতা কর্মীরা জড়িয়েছে। সিবিআই-ইডি প্রভৃতি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে অভিযুক্ত হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়ক সহ শাসকদলের অনেক নেতা-কর্মী এবং রাজ্য প্রশাসনের আধিকারিককে হাজত বাস করতে হচ্ছে। বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সহ শাসকদলের শীর্ষনেতাদের নামও বারে বারেই উঠে আসছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে গত ৫ জুন দুবাই যাবার পথে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি অভিবাসন দপ্তরে পৌঁছালে তাঁর পাসপোর্ট পরীক্ষা করে জানানো হয়, তাঁর নামে ইডি’র লুক আউট নোটিশ রয়েছে। কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তে এই লুক আউট নোটিশ জারি রয়েছে বলে জানা যায়। বিমানবন্দরেই অভিষেক পত্নী রুজিরা নারুলাকে আটকে দিয়ে তাঁর হাতে নোটিশ ধরিয়ে বলা হয়, ৮ জুন তাঁকে সল্টলেকে ইডি’র দপ্তরে হাজিরা দিতে হবে। এই ঘটনার ঠিক আট মাস আগে রুজিরার বোন, মেনকা গম্ভীরকেও ব্যাঙ্কক যাবার পথে একইভাবে বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। তাঁর নামেও লুক আউট নোটিশ জারি করেছিল ইডি।
ইডি’র সূত্রে জানা গেছে, আয়কর দপ্তরের সঙ্গে যৌথ তল্লাশি থেকে পাওয়া নথি ও ডিজিটাল প্রামাণ্য থেকে দেখা গেছে, কয়লা পাচারকাণ্ডের টাকা মাসের পর মাস ঢুকেছে অভিষেক পত্নী রুজিরার থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। গত বছরের জুন মাসেও প্রায় ৬ ঘণ্টা ইডি’র জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল রুজিরাকে। তারও আগে তাঁর হরিশ মুখার্জি রোডের বাসভবনে গিয়ে সিবিআই দু’দফায় জেরা করেছিল তাঁকে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও প্রায় ৮ ঘণ্টা ইডি’র ম্যারাথন জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল।
অনেকেরই স্মরণে আছে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিদেশ থেকে ফেরার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে অভিষেক পত্নী রুজিরা সহ দুই মহিলাকে সুটকেসের মধ্যে সোনা আনার অভিযোগে আটক করেছিল শুল্ক দপ্তর। তখন রাজ্য সরকারের আধিকারিকরা তড়িঘড়ি বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। যাই হোক, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বেআইনি কয়লা পাচারের বিপুল টাকার একাংশ নানান পথে ঘুরে ব্যানার্জি পরিবারের হাত ধরে লন্ডন, সিঙ্গাপুরে হোটেল ব্যবসাতেও ঢুকেছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, কয়লা ও গোরু পাচারকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত, যে বর্তমানে ফেরার ও তার নামে হুলিয়া জারি করেছে সিবিআই, সেই বিনয় মিশ্রের মাধ্যমে পাচারের টাকা পৌঁছায় ব্যাঙ্ককের নির্দিষ্ট একটি ব্যাঙ্কের শাখায়। সেখানেই রয়েছে রুজিরা ব্যানার্জির অ্যাকাউন্ট। এই তদন্ত কোনদিকে গড়ায় সেটাই দেখার।
এই আবহেই কয়লা পাচার মামলায় রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে তলব করেছে ইডি। আগামী ১৯ জুন দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরে তাঁকে হাজিরা দিতে হবে। এই মামলাতেই এর আগে ৯ বার ইডি’র সমন এড়িয়েছেন মন্ত্রী মলয় ঘটক। পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, রানিগঞ্জ, জামুরিয়ার বিস্তীর্ণ কোলিয়ারিতে একচ্ছত্র দাপট ছিল কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার। ইতিমধ্যে পুরুলিয়া, আসানসোল ও ঝাড়খণ্ডে লালার একাধিক অফিস ও ঠিকানায় দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে বিপুল নথি সংগ্রহ করেছে আরেক তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। লালার অফিস থেকে পাওয়া নথি ও তার হিসাব রক্ষক নীরজ সিংয়ের বাড়ি থেকে পাওয়া ল্যাপটপে মিলেছে একাধিক নাম। সেই সূত্রেই উঠে এসেছে মন্ত্রী মলয় ঘটকের নাম। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর সিবিআই এই মামলাতেই আসানসোল ও কলকাতায় মলয় ঘটকের সাতটি ঠিকানায় তল্লাশি চালায়। সিবিআই আধিকারিকরা মন্ত্রীর তিনটি স্মার্টফোনও বাজেয়াপ্ত করে। ইতিমধ্যে কয়লা পাচারকাণ্ডে সিবিআই’র হাতে ধৃত ইসিএল’র একাধিক প্রাক্তন আধিকারিকদের জেরায় এবং বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বয়ানেও উঠে এসেছে মন্ত্রী মলয় ঘটকের নাম। বিপুল টাকার বিনিময়ে প্রশাসনকে চুপ করিয়ে রেখে আসানসোল ও বাঁকুড়ায় খোলা মুখ খাদান থেকে কয়লা পাচারে মন্ত্রী মদত দিতেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে রাজ্যের মন্ত্রীসভা ও শাসকদলের আগাপাশতলা ডুবে আছে নানা দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পাঁকে।