৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
জলবায়ু ভাবনার বিজ্ঞান ও রাজনীতি
শ্যামল চক্রবর্তী
রেনেসাঁস ও শিল্পবিপ্লব না হলে কোনো দেশ এগোতে পারে না। ব্রিটেনে যখন শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়, শুরুতে কোনো কোনো মহলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও পরে মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের উপর শিল্পবিপ্লবের সার্থকতা নির্ভর করে। দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার যে উন্নয়ন তা দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্যাসিবাদের আক্রমণে পালিয়ে আসা আমেরিকায় আশ্রিত বিজ্ঞানীদের উপর, এবিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না। অবিশ্যি কেমন করে কাজে লাগাবে বিজ্ঞানীদের, সেবিষয়ে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা থাকে। সেই ভূমিকা ভালো মন্দ বা দু’য়ে মিশিয়েই হতে পারে।
শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানা তৈরি হলো। মানুষ কাজ পেল। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ল যেমন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে শুরু করল। এর ফলে বাড়তে থাকল পৃথিবীর তাপমাত্রা। কারখানায় তৈরি ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ওজোনস্তরের ক্ষয় সাধন করতে থাকল। ওজোনস্তর পৃথিবীর সকল জীবপ্রজাতিকে রক্ষা করে। সূর্য থেকে বিষময় অতিবেগুনি আলো এসে জীবপ্রজাতির ক্ষতিসাধন করতে পারে না। ওজোনস্তরের ক্ষয় হতে থাকলে মানুষ সহ সকল জীবন বিপদের মুখে পড়বে। কলকারখানার মালিকানা যখন রাষ্ট্রের হাতে না থেকে ধনতন্ত্ররক্ষকদের হাতে চলে যায় তখন প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার চলতে থাকে। এর ফল হয় ভয়ঙ্কর। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। সাধারণ বনজ সম্পদ শুধু নয়, অতিদামি কাষ্ঠল সম্পদ লুণ্ঠিত হয়। নির্বিচারে বনজঙ্গলের উপর হাত পড়ে। আমাজনের জঙ্গল পুড়ছে। অরণ্যাবৃত ভূমির পরিমাণ কমছে।
এদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা যত বাড়বে, মেরু এলাকায় বরফ গলনের হার তত বাড়বে। পৃথিবীর নানা দ্বীপে মানুষদের যে বসতি বা সমুদ্রের উপকূল নিকটবর্তী মানুষ আশঙ্কায় দিন গুণবে, সলিল সমাধি হবে না তো আমাদের? বরফ গলনের হার বেড়ে গেলে তো সমুদ্রের জলের উচ্চতাও বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা অশনি সংকেত দিয়েছেন। এমনকী আমাদের দেশেরও কয়েকটি এলাকা জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একটানা বেড়েই চলেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। ২০০৬ থেকে ২০২০। পনেরোটি বছরের মধ্যে বারোটি বছর উষ্ণতর। তাই ২০১০-২০ দশকটিকে পৃথিবীর ‘উষ্ণতম দশক’ বলা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের হিসেব, ১৮৮০ সালের পর থেকে প্রতি দশ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.০৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়ছে। ২০১৬ বছরটিকে বিজ্ঞানীরা ‘উষ্ণতম বছর’ বলেছিলেন। ২০২৩ সালের ১৮ মে তারিখে সকল সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় একটি খবর বেরোল। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ‘নতুন উষ্ণতম বছর’ দেখা দেবে। ২০২২ সালের প্রতিটি মাস দশটি উষ্ণতম বছরের তাপমাত্রা দেখিয়েছে।
বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের অপরিহার্য। কিন্তু জল বাতাস ও খাবার ছাড়া কোনো জীবন বাঁচবে না। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লে, লাগামহীন বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিলে, যা বরফের বেহিসেবি গলনের ফলে সম্ভব, কৃষিক্ষেত্র ও জৈববৈচিত্র্যে তার বড়োরকমের প্রভাব দেখা দেবে। ভারতের নদীগুলিকে প্রধানত আমরা ‘উত্তরের নদী’ ও ‘দক্ষিণের নদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। উত্তরের নদী হিমবাহ গলিত জলে পুষ্টি লাভ করে। আর দক্ষিণের নদী বৃষ্টির জলে পুষ্টি লাভ করে। কোনোবছর যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে হিমবাহের গলন হয়, উত্তরের নদীতে জল যাবে বেড়ে। দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেবে। বন্যার প্রভাব তো কৃষিফলনের ক্ষেত্রেও ঘটবে। কৃষির বেলায় পরাগসংযোগ খুব দরকারি বিষয়। দেখা গেছে, তাপমাত্রার রকমফের হলে পরাগসংযোগের সময়কাল বদলে যায়। ভারতের শতকরা ৬৫ ভাগ জমিতে সেচের ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টির উপর নির্ভর করে চাষিদের অপেক্ষা করতে হয়।
জলবায়ু আজকাল এমন বদলে গেছে যে, বর্ষাকালে হয় অনাবৃষ্টি নয়তো অতিবৃষ্টি দেখা যায়। স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা মেলে না। এমন জলবায়ুতে যে ফসল উৎপাদিত হয় দেখা গেছে সে ফসলের পুষ্টিমান কম। কমে গিয়েছে প্রোটিনের পরিমাণ ও দরকারি খনিজের পরিমাণ। বন্যা হলে জলবাহিত নানা রোগে ফসলের উদ্ভিদ ও শস্যদানা আক্রান্ত হয়। খরা থাকলেও কিছু বিশেষ অণুজীব ও পোকামাকড় সক্রিয় হয়ে উঠে।
এমন কথা বলব না যে, পৃথিবীর দেশগুলি পরিবেশ নিয়ে ভাবছে না। যদিও মনে পড়ে আমাদের, আমেরিকা প্রথম যে সরকারি রিপোর্ট তৈরি করেছিল সেই রিপোর্ট তৈরির সভাপতি জিম ইনহোফে বলেছিলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ধারণা পুরোপুরি নাকি এক অলীক গল্প। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ তৈরি করেছিল এক আন্তর্জাতিক সংগঠন। তার পুরো নাম ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা ‘আইপিসিসি’। পৃথিবীর সকল দেশ থেকে বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এই সংগঠনে কাজ করেন। কয়েক বছর পরপর পৃথিবীর জলবায়ু খতিয়ে দেখে পরামর্শ দান এদের প্রধান কাজ। ১৯৯২ সালে আইপিসিসি-র প্রথম রিপোর্ট বের হয়। তারপর ১৯৯৫, ২০০১, ২০০৭, ২০১৪ ও ২০২১ সালে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ রিপোর্ট বেরিয়েছে। রিপোর্টের আয়তন বাড়ছে বই কমছে না। ২০২২ ও ২০২৩ সালেও ষষ্ঠ রিপোর্টের কিছু অংশ বেরোল। জলবায়ু সুরক্ষা নিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা ঠিক করতে পৃথিবীর দেশগুলি প্রতিবছর আজকাল আলোচনায় বসে। সে আলোচনা চলে টানা বারোদিন। কখনো কখনো এক-দু’দিন বেশি হয়। এছাড়া খানিকটা ছোটো পরিসরে অনেক জলবায়ু সম্মেলন আয়োজিত হয়। এবছরের কথাই বলছি। জার্মানির বন শহরে ৫-১৫ জুন হচ্ছে বন জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন। ১৬ জুলাই নিউইয়র্ক শহরে আলোচনা হবে স্থিতিশীল উন্নয়নের স্বার্থে ‘প্যারিস চুক্তি’ (২০১৫) কীভাবে কার্যকর করা যায়। ৪-৮ সেপ্টেম্বর কেনিয়ার নাইরোবি শহরে বসছে আফ্রিকার দেশগুলো। তারা ‘আফ্রিকান ক্লাইমেট উইক’ পালন করবে সে সময়। ২০২৩ সালের ৯-১২ অক্টোবর মধ্য প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি মিলিতভাবে জলবায়ু সপ্তাহ পালন করবে। তার সমাবেশ হবে সৌদি আরবের রিয়াধ শহরে। বছরের শেষে আমরা যে জলবায়ু সম্মেলনের (সংক্ষেপে বলা হয় সিওপি বা কনফারেন্স অফ পার্টিজ) দিকে তাকিয়ে থাকি তা হতে চলেছে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর আরবের দুবাই শহরে।
সকলেই জানি আমরা, ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন (সিওপি-১) অনুষ্ঠিত হয়। সাতাশটি সম্মেলন এপর্যন্ত হয়েছে। ২০০২ সালে আট নম্বর সম্মেলন (সিওপি-৮) ভারতের নয়াদিল্লি শহরে সংগঠিত হয়েছিল। প্রতি সম্মেলনেই পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার বহু বিষয় আলোচিত হয়। তর্ক বিতর্ক হয়। সহমতও তৈরি হয়। মনে রাখতেই হবে আমাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে নির্ধারিত করে। একসময়ে ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন। অনেক দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরে উগো সাভেজ খানিকটা কাস্ত্রোর ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন। মার্কিন ও করপোরেট জগতের আধিপত্য যত বাড়ছে, ‘সহমত’ ভাবনা সম্মেলনের আলোচনা থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্ত অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ছিল। পরে নতুন ভাবনা যোগ হলো। সহমতের নীতি নয়, একলা চলোর নীতি কার্যকর হবে। জলবায়ু সম্মেলন থেকে একটা নতুন শব্দবন্ধ চালু হলো। ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন বা এনডিসি। প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে তার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে। আন্তর্জাতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না।
সবশেষ সম্মেলন হলো গ্লাসগোতে। জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনার কথা আলোচনা হলো। ভারত বলল, ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের মাত্র শতকরা ৫০ ভাগ চিরাচরিত জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপাদিত হবে। ফলে ২০০৫ সালে যে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হতো ২০৩০ সালে তার শতকরা ৪৫ ভাগ কমবে। আমাদের সৌরতড়িৎ প্রকল্প ও বায়ুতড়িৎ প্রকল্পের কাজ হচ্ছে না এমনটা নয়। প্রয়োজনের অর্ধেক বিদ্যুৎ জীবাশ্ম না পুড়িয়ে তৈরির প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হয়, ছ-সাত বছর পরেই আমরা দেখতে পাব। কেউ একলা চলোর নীতিতে সদম্ভ আধিপত্য প্রচার করে। কেউ এমন কথাও বলে যার কোনো বাস্তবতা নেই। বিশাল জীবাশ্ম বাণিজ্য যারা করে পৃথিবীতে, তাদের খানিকটা তিরস্কারের সুরেই বলেছেন রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস (৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩), ‘যারা জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন করে ও যারা তা সরবরাহ করে তাদের লাগামহীন মুনাফার অভিপ্রায় নিয়ে আমি বিশেষভাবে একটি কথা বলতে চাই। যদি তোমরা নেট-শূন্যের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্যকর করার সফল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পার, তবে এই ব্যবসায় তোমাদের থাকা উচিত নয়।’ ‘প্যারিস চুক্তি’ হয়েছিল ২০১৫ সালে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কিছুতেই দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি বাড়তে দেওয়া চলবে না। খুব ভালো হয় যদি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখা যায়।
আমরা কি সঠিক পথে চলেছি? না আইপিসিসি-র ছ’নম্বর রিপোর্ট বলছে, ২০২৭ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি হবে। সভ্যতার অশনি সংকেত বাজছে। এই শতকের মধ্যে মহানগর কলকাতাসহ ভারতের বারোটি শহর কয়েক ফুট জলের নিচে নিমজ্জিত হবে। এখন আর শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ‘উদ্বাস্তু’ হন না মানুষ, ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ কথাটা অভিধানে এসে গিয়েছে। একটা হিসেব বলছে, ২০২১ সালে পৃথিবীতে চব্বিশ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ হয়েছেন। সভ্যতার এই বিসর্জনে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ ভিন্ন কোনো গত্যন্তর নেই।