৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
বাংলার ‘উন্নয়ন’ ও পরিবেশ সংকট
সৌরভ চক্রবর্তী
পূর্ব কলকাতার জলাভূমি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইউনাইটেড নেশনস (ইউ)-এর ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ২০২২’ রিপোর্ট। ভারত ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৬০.৩২ নম্বর পেয়ে ডাহা ফেল করে ১২১তম স্থান অর্জন করেছে। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা সবাই ভারতের আগে। রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম হয়েছে কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ১২ নম্বরে, ত্রিপুরারও পরে। পশ্চিমবঙ্গ সবথেকে খারাপ করেছে ‘লাইভ অন ল্যান্ড’ - লক্ষ্য - ১৫-তে। ইউএন ২০৩০ পর্যন্ত ১৭টি লক্ষ্য স্থির করেছিল। এই ১৭টি লক্ষ্য নিয়েই পরীক্ষা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্ত নম্বর-৩৫। লক্ষ্য-১৫ হলো, পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ব্যবহার করো, রক্ষা করো, পুনরুদ্ধার করো, অরণ্যকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে পরিচালনা করো, মরুকরণ, ভূমির মানের অবনতির ও জৈব বৈচিত্র্যের ক্ষয় রোধ করো অর্থাৎ একাজে পশ্চিমবঙ্গের-৩৫ পাওয়া মানে, তথাকথিত উন্নয়নে সার্বিকভাবে পরিবেশের উপাদানগুলি অস্বীকৃত-অনাদৃত হওয়া। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা বিধ্বংসী। কথায় কথায় উন্নয়নের ঢাল ব্যবহার করে প্রতিটি উচ্চারিত উন্নয়ন শব্দ পরিবেশের কফিনে একেকটা পেরেক। এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখছি এক বল্গাহীন প্রাকৃতিক সম্পদের লুটের ব্যবস্থায়। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ বাদ যাচ্ছে না ডুয়ার্সের অরণ্য, বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে জলাভূমি, বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়, লুট হচ্ছে নদীর বালি মাটি পাথর। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি- নিয়মকানুনকে অগ্রাহ্য করে কয়লা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জঘন্য প্রচেষ্টা চলছে দেউচা-পাঁচামিতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরোধ করতে গেলে পুলিশ প্রশাসন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে লুটেরাদের সারিতে। উন্নয়নের নামে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংগঠিত হচ্ছে সীমাহীন অপরাধ।
‘উন্নয়ন’-এর তামাদি বিধ্বংসী মডেল
তথাকথিত উন্নয়নের আগ্রাসনবিদ্ধ দগদগে ক্ষত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যোশীমঠ। যে উন্নয়ন মডেল আজ তামাদি, যে উন্নয়ন মডেল ভূতত্ত্ববিদ্যা, ভূজলবিদ্যা, ভূপ্রযুক্তি, ভূ-ভৌত বিষয়গুলিকে অগ্রাহ্য করে উন্নয়নের নামে ভয়ঙ্কর ভূকম্পনের এলাকায়, যার অনতিদূরেই রয়েছে ‘মেইন সেন্ট্রাল থ্রার্স্ট’-এর ফাটল - বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চারধাম সড়কের মতো ভারি ভারি নির্মাণের ভার চাপিয়েছে ভঙ্গুর ভূমিখণ্ডে, ক্রমাগত অস্বীকার করে গেছে দুর্ঘটনাগুলিকে শুধুই উন্নয়নের নামে। আজ ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটে ফাটল আর ধস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যোশীমঠ। উদ্বাস্তু হচ্ছে মানুষ। নির্মাণ! নির্মাণ! আর নির্মাণ! নির্মাণ মানে বৃদ্ধি - উন্নয়ন নয়।
দেউচা-পাঁচামিতে জবরদস্তি ‘উন্নয়ন’
যোশীমঠের হিলং-মাড়োয়ারি চারধাম সড়কের কোনো ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) হয়নি। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইআইএ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যোশীমঠের তামাদি উন্নয়নের মডেলকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে এ রাজ্যের দেউচা-পাঁচামিতে। দেশের স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে সাতটি পর্যায় অতিক্রম না করে খনন পরিকল্পনা বা মাইনিং প্ল্যান সুনির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত খোলামুখ খনি অথবা ভূগর্ভস্থ খনি বলা যায় না। তাই কোনোভাবেই কয়লার পরিমাণ বা খনন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জমির যথাযথ হিসেব করা সম্ভব হয় না।
অষ্টম পর্যায়ে ইআইএ-এর ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক পরিবেশ এবং বনাঞ্চল সাফ করার ছাড়পত্র মেলে। কিছুই হয়নি এসব! অথচ বড়ো বড়ো করে ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজের গল্প ছাপা হচ্ছে। ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী গণশুনানির প্রয়োজন, সামাজিক অভিঘাতের মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। কোথায় হয়েছে এসব! যোশীমঠের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছেন বারে বারে। কেউ কথা শোনেনি! দেউচা-পাঁচামিতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। সাড়ে তিনশো মিটারের নিচে কয়লা তোলার অভিজ্ঞতাই নেই দেশের অথচ সাড়ে আটশো মিটার নিচের কয়লা তোলার গল্প হচ্ছে! কী আছে, কতটা আছে, আদৌ তোলা সম্ভব কীনা, কতটা সম্ভব, কীভাবে তোলা সম্ভব, কেউ জানে না! মাটির নিচের ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারের কী হবে কেউ জানে না! যোশীমঠের ৫২০ মেগাওয়াটের তপোবন-বিষ্ণুগড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের টানেল খুঁড়তে গিয়ে ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারকে ফুটো করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য সেই ঘটনা অন্যতম দায়ী। দেউচা-পাঁচামি যোশীমঠ হবে না কে বলতে পারে! সমীক্ষাটাই তো হলো না!
প্রকৃতি-মানুষ সম্পর্কতে ‘উন্নয়ন’-এর বুলডজার
তিলাবনি পাহাড়টাকে বিক্রি করে দেওয়া হলো। পাহাড়টা কতো উদ্ভিদ প্রাণীর আবাসস্থল। একটা বুনোট বাস্তুতন্ত্র। পাহাড়ি ঝরনা। পাহাড়টাকে ঘিরে আদিবাসী মানুষদের জীবনচক্র চলে। ঝরনার জল পান করে জীবন বাঁচে - কৃষিকাজ চলে। পাহাড়ের উপর, পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে কতো গাছ ফলমূল- মানুষের খাদ্য। তিলাবনির নিচে এক বিরাট আমবাগান। গাছের চাঁদোয়ায় ঢেকে যায় আকাশের রোদ্দুর। পরিষ্কার সেই জায়গায় আদিবাসী মানুষজন মিলিত হয় নানা অনুষ্ঠানে। পাহাড়ের বৃত্ত প্রসারিত হয়ে গ্রামের মানুষজনকে নিয়ে এক অখণ্ড চিরায়ত বাস্তুতন্ত্র। ধ্বংস করে ফেলতে হবে তাকে? গ্রানাইটের লোভে! আর কোথাও নেই গ্রানাইট? কত টন পাথরের জন্য এই সুবিশাল ধ্বংসলীলার পরিকল্পনা? কার স্বার্থে? তিলাবনির আদিবাসী মায়েরা বলছেন, ‘‘জান যাবে, তবু তিলাবনি দিব না।’’ জোট বেঁধেছে মানুষ। এখনো আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তিলাবনি।
‘উন্নয়ন’ মদমত্ততায় অরণ্য নিধন
‘ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট ২০২১’ অনুযায়ী পশ্চিমবাংলায় ২০১৯-২০২১ পর্যন্ত ৭০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য কমেছে। বিগত দশ বছরে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ৫০ বর্গকিলোমিটার ম্যানগ্রোভ অরণ্য কমেছে। বাঘ বেরিয়ে আসে লোকালয়ে, নাকি মানুষই যায় বাঘেদের আলয়ে? কোন কারণে ‘ম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট’ ঘটে? কলকাতা ২০১১-২০২১ সাল পর্যন্ত ৩০ শতাংশ বৃক্ষের আচ্ছাদন হারিয়েছে। এসব তথ্য নির্বিচারে অরণ্য ও বৃক্ষছেদনের আয়না। বিশ্বের সবাই যখন কী করে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেওয়া যায়, বিশ্ব উষ্ণায়ন কমানো যায় - তাই নিয়ে চুল ছিঁড়ছে, আর এখানে কার্বন শোষণের হাতিয়ার অরণ্য নিধন হচ্ছে উন্নয়নের নামে!
গরুমারা সংরক্ষিত বনের বাফার অঞ্চল লাটাগুড়িতে তিন হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হলো, সেই উন্নয়নের নামে! লাটাগুড়িতে জাতীয় সড়ক এনএইচ ৩১-এর উপর একটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ তৈরি হবে। প্রতিবাদী মানুষজন বললেন, নিউ মাল থেকে চ্যাংড়াবান্ধা স্টেশনের মধ্যে মোটে দুটো ট্রেন যাতায়াত করে। প্রয়োজন কি রেল ব্রিজের? এই অঞ্চল হাতির করিডর! কী হবে তাদের? জনবিজ্ঞান আন্দোলন দিল্লির, ন্যাশনাল গ্রিন টাইবুনাল (এনজিটি)-তে মামলা করল। অন্যরাও করল মামলা, কিন্তু দেশের সরকার যে পরিবেশের সমস্ত আইন লঘু করেছে, ইআইএ ২০২০ ভয়ঙ্কর, বদলে দিয়েছে বন সংরক্ষণ আইনকে। কেড়ে নিয়েছে আদিবাসীদের অধিকার, যা ২০০৬ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে তৈরি হয়েছিল। জেতা যাবে না মামলা! উন্নয়ন আর নির্মাণের আখমাড়াই কলে পিষে যাচ্ছে পরিবেশ। গাছ কাটা শুরু হলো, প্রতিবাদ হলো দেখা গেল অগুনতি পুলিশের সারি অরণ্য নিধনে শামিল। তারা জনবিজ্ঞান কর্মীদের উপর লাঠি উঁচিয়েছে।
অরণ্য নিধন করে কার্বন শোষণের জায়গায় কার্বন বাড়িয়ে দিচ্ছে উন্নয়ন! সাধে কি কোভিড ১৯, ইবোলা, মাংকি পক্সের মতো জুনোটিক ডিজিজ (প্রাণীদেহ থেকে মানুষের শরীরে ছলকে আসা)-এর প্রাদুর্ভাব হয়! ডেঙ্গুর মতো জুনোটিক এবং ভেক্টর ডিজিজের বাড়বাড়ন্ত হয়! এ কারণেই তো আইপিবিইএস (ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্লাটফর্ম ফর বায়ো ডাইভারসিটি এবং ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস) কোভিডের সময় বলেছিল - এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? যেভাবে অরণ্য নিধন, ভূমির চরিত্র বদল করা হয়েছে তাতে এতো হওয়ারই ছিল। সতেরো লক্ষ অজানা ভাইরাস আছে যার মধ্যে আট লক্ষ সাতাশ হাজার ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করতে সক্ষম। উন্নয়ন এসব কথা শোনে?
উন্মত্ত লালসার কোপে জলাভূমি
জলাভূমি নির্বিচারে ভরাট হচ্ছে। উচ্ছন্নে যাক পরিবেশ! হোক শুধু নির্মাণ! তথ্য বলছে, ২০১০-এ কলকাতায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ৭২০০টি, ২০২১-এ তা কমে দাঁড়াল ৩৭০০টি - অর্থাৎ অর্ধেক! জলাভূমি নানা উদ্ভিদ-প্রাণীর বাস্তুতন্ত্রের আধার। জলাভূমি প্লাবন এবং জল জমা ঠেকিয়ে দেয়। জলাভূমি কার্বন শোষণ করে। সর্বোপরি জলাভূমি ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারকে পুষ্ট করে। নির্বিচারে গাছ কাটা জলাভূমি ভরাট করাতেই কি বোঝা যায় না, কেন দিল্লির পরেই বিশ্বের দূষিত শহরটির নাম হলো কলকাতা!
‘উন্নয়ন’ বিভীষিকায় কলকাতা
এই যে আগ্রাসী নির্মাণ চলছে তাতে কলকাতার মাটির তলার জলের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। তোলা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল। ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডার নেমে যাচ্ছে ৩০-৪০ ফুট, কোথাওবা ৬০ ফুট। শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে কলকাতা! ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘স্প্রিংগার নেচার জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল আর্থ সায়েন্স’-এর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় - মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল তোলার জন্য কলকাতার ভূগর্ভে এক অবতল খাত তৈরি হয়েছে যা কলকাতা শহরের পৃষ্ঠতলের ৩০ শতাংশ বেশি - যার জন্য ভূগর্ভস্থ জলের ৭৫ শতাংশ জল অংশত বা সম্পূর্ণ নোনতা হয়ে যাচ্ছে। এক ফুট করে জলস্তর নামছে প্রতিবছর। জলস্তর নেমে যাবার জন্য আর্সেনিক সমস্যা বাড়ছে আর ভয়ানকভাবে বাড়ছে কলকাতার অবনমনের আশঙ্কা! শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতার উপর যে হিমালয় প্রমাণ নির্মাণের গুরুভার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে কি কলকাতা ভবিষ্যতের যোশীমঠ হবে?
‘উন্নয়ন’এ বিপন্ন ‘বিশ্বের বিস্ময়’
সারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ এক অদ্বিতীয় জলাভূমির নাম ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি।’ এই জলাভূমি প্রাকৃতিকভাবে কলকাতার আশিভাগ দূষিত জলকে বর্জ্য গর্ভেই জন্ম নেওয়া এবং শতগুণ বেড়ে ওঠা ব্যাকটেরিয়া এবং ‘অ্যালগি’ বা শৈবাল, সূর্যের আলোর সাহায্যে পরিশোধিত করে মাছের খাদ্য তৈরি করে। এই প্রাকৃতিক জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে মাছ চাষ, সবজি চাষের ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে তা বিশ্বের বিস্ময়!
২০০২ সালে এই জলাভূমিকে রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কলকাতার আশিভাগ বর্জ্যজল যার পরিমাণ এক হাজার মিলিয়ন লিটার প্রতি দিন, এই জলাভূমিতে নালার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে প্রায় দুশোটি ভেড়িতে ভাগ হয়ে গিয়ে এমন এক বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড ঘটায় যার জন্য কলকাতাতে ‘সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ নির্মাণ করেনি ব্রিটিশ শাসকরা। সেই ব্যবস্থা আজও চলছে। ফলে বর্জ্য পরিশোধন বাবদ ৪১৯ কোটি টাকা প্রতি বছরই বেঁচে যায় কেএমডিএ-র (‘স্প্রিংগার নেচার’ এ প্রকাশিত গবেষণার তথ্য)। এর সাথে বছরে আঠেরো হাজার টন মাছ এবং দেড়শো টন সবজি উৎপাদন করে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। আরও আছে! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক-লেখক সুদিন পাল দেখিয়েছেন, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বর্জ্য থেকে ৬৯ শতাংশ কার্বন সঞ্চয় করে। ভাবা যায়! এই হলো জলাভূমির উৎপাদনশীলতা! এই উৎপাদনশীলতা প্রাকৃতিক। উদারনীতির মুনাফাকারী উন্নয়নের উৎপাদনশীলতা নয়।
১৯৯৭ সালে ২৬৪টি ভেরি কার্যকর ছিল। আজ সেখানে মাত্র ২০০টি বেঁচে আছে। কিছুদিনের মধ্যে ধাপা-মনপুর মৌজা, বড়োবন ভেরি এবং রবি ঘোষের ভেরি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। ৩৭টি মৌজার ২০টি মৌজা ভয়াবহ জবরদখলের আতঙ্কে রয়েছে। জবরদখল এবং বর্জ্যজলের পরিমাণ কমে যাওয়া - এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে। ১৯৯২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে, এই জলাভূমির চরিত্র বদল করা যাবে না, অথচ বর্তমান সরকার সেই বিধিনিষেধ তুলে দেবার জন্য অপকৌশল অবলম্বন করছে।
রুখে দাও আত্মঘাতী ‘উন্নয়ন’ মডেল
‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-এর ষষ্ঠ প্রতিবেদন (সংশ্লেষ) বলছে, যে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ধরে রাখার অঙ্গীকার ছিল এই শতাব্দীর শেষে - ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে, এখন সেই গড় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেরিয়ে যেতে চলেছে ২০২৭ সালের মধ্যে। ১.৫ সেন্টিগ্রেড গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় আমরা জানি না। মানব সভ্যতা অস্তিত্বের সংকটে। পরিবেশকে বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থে লালসাপূর্ণ উন্নয়নের নামে একবগ্গা আগ্রাসী নির্মাণের মডেল - প্রাকৃতিক সম্পদের বল্গাহীন লুটেরা ব্যবস্থাকে রুখে দিতেই হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।