৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন ও করপোরেটদের মুনাফার স্বার্থেই বর্তমানে পরিবেশ আইনের পরিবর্তন
তপন সাহা
১৭৫০ সালকে শিল্প বিপ্লবের শুরু বলা হয়। শিল্প থেকে দূষিত বায়ু বা জল নির্গত হলেও সেই পরিবেশ দূষণ নিয়ে মানুষ চিন্তিত ছিল না। পৃথিবীর আত্মশুদ্ধিকরণের ক্ষমতা ছিল। জঙ্গল, সমুদ্র ও জলাভূমি দূষিত বায়ু শোষণ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে নির্মল রাখত। দূষিত জল যা সমুদ্রে, নদীনালা, জলাশয় ও জলাভূমিতে নিক্ষেপ করা হতো তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জলে থাকা জলজ উদ্ভিদ সেই দূষিত জলের দূষিত পদার্থগুলিকে শোষণ করে জলকে দূষণ মুক্ত রাখত। দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবী তার আত্মশুদ্ধিকরণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ কোটির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভে ১৭৫০ সালে হয় ৭৫ কোটি, অর্থাৎ পৃথিবীর ৫০ কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি হতে লেগেছিল ১৭৫০ বছর। তারপরে ২৫কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮২০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হয় ১০০ কোটি, অর্থাৎ ২৫ কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে সময় লেগেছিল ৭০ বছর। ১০০ কোটি থেকে ২০০ কোটি হতে মাত্র ১১০ বছর লেগেছিল,অর্থাৎ ১৯৩০ সালে জনসংখ্যা হয় ২০০ কোটি। তারপর থেকে রকেট গতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০২২-এর নভেম্বর মাসে পৃথিবী ৮০০ কোটির জনসংখ্যা পেরিয়ে গেছে। বর্তমানের ৮০০ কোটির জনসংখ্যার মধ্যে ৬০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১০০ বছরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু হয়ে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বায়ু দূষণ ও জল দূষণ চরম আকার ধারণ করে। বিভিন্ন দেশে বিশেষত শিল্পোন্নত দেশেগুলিতে অ্যাসিড বৃষ্টি, পুকুর, লেক অন্যান্য জলাশয়ে জল দূষণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য লেকের মাছের মৃত্যু ও মার্বেল পাথরের ইমারত বা রাজ প্রাসাদগুলির ক্ষতি শিল্প মালিক ও রাষ্ট্র নায়কদের চিন্তায় ফেলে দেয়। ওই সময়ে ১৯৬২ সালে রাচেল কার্সেনের “সাইলেন্ট স্প্রিং” ও ১৯৬২ সালে গ্যারেট হার্ডেনের “দি ট্র্যাজেডি অফ কমন” এই দুটি বই পরিবেশের ক্ষতিকর দিকগুলি তুলে ধরে পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়। সমস্ত দেশে বিশেষভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলি যাদের দূষণ বেশি আন্তর্জাতিকভাবে তারা কিছু পরিকল্পনা রুপায়ণের চিন্তাভাবনা শুরু করে, তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে সুইডেনের স্টকহোমে ১৯৭২ সালে প্রথম পরিবেশ বিশ্ব সম্মেলন।
স্টকহোম সম্মেলন পরিবেশের প্রথম বিশ্ব সম্মেলন হিসাবে শুধু ঐতিহাসিক নয়, সমস্ত অংশের সাথে সাথে নীতি নির্ধারকদের কাছে একটি মাইলস্টোন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৯৭২-পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়স্তরে পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে কমিটি, বিশেষজ্ঞ কমিটি, বিভিন্ন সংস্থা গঠন হওয়া শুরু হয়। ওই সালেই পরিবেশের বিষয়টি দেখভালের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীনে গঠিত হয় “রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিবেশ কার্যক্রম” (United Nations Environment Programme)। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কিছু উন্নত দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও রক্ষা ও উপনিবেশের অধীনে থাকা কিছু দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য অরণ্য আইন চালু করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে থেকে কিছু দেশে কলকারখানা থেকে ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার The Bengal Smoke-Nuisances Act, 1905 ও The Bombay Smoke-Nuisances Act, 1912 চালু করে। স্বাধীনতার পরে ভারতে প্রথম পরিবেশ আইন তৈরি হয় ওডিশায় ১৯৫৩ সালে - Orissia River Pollution Prevention Act 1953, তারপরে গুজরাটে ১৯৬৩ সালে - The Gujrat Smoke-Nuisances Act, 1963। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০সাল পর্যন্ত ৪টি দেশে পরিবেশ আইন ছিল, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে মোট ১০টি দেশে পরিবেশ আইন ছিল এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালে পরিবেশ আইন আছে এমন দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় মাত্র ১৮টি। স্টকহোম সম্মেলনের সময়কাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে পরিবেশের বিভন্ন বিষয়ের উপরে ৩১টি দেশে জাতীয়স্তরে প্রধান আইন প্রস্তুত করা হয়। বিভিন্ন দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নও দ্রুতহারে হতে শুরু হয়। স্টকহোম সম্মেলনের আগে মাত্র ১০টি দেশে সরকারের পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক ছিল। ১৯৮২ সালের মধ্যে ১১০টি দেশে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক গঠিত হয় এবং এখন প্রতিটি দেশেই পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক আছে।
১৯৭২ সালের পরবর্তীকালে দেশের প্রথম পরিবেশ সংক্রান্ত আইন চালু হয় ১৯৭৪ সালে - জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৭৪ (The Water Prevention and Control of Pollution Act, 1974), তারপর ১৯৮১ সালে প্রস্তুত হয় বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১ (The Air Prevention and and Control of Pollution Act, 1981)। এই দুটি আইনের অনেক সংশোধন করা হয় এবং এই আইনগুলি প্রণয়নের জন্য অনেক রুলস প্রস্তুত করা হয়। ১৯৮৬ সালে জল ও বায়ু দূষণের আইন দুটিকে একই ছাতার তলায় নিয়ে এসে পরিবেশ (সুরক্ষা), আইন ১৯৮৬ (The Environment Protection Act, 1986) প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে যে সমস্ত আইন প্রস্তুত করা হয় তার অধিকাংশই পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন ১৯৮৬-র অধীনে রুলস ও নোটিফিকেশন আকারে প্রস্তুত করা হয়েছে - উপকূলীয় প্রবিধান অঞ্চল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ১৯৯১ (Coastal Regulation Zone Notification 1991 amended several times, last amended in 2023), চিকিৎসাজনিত জৈব বর্জ্য (ব্যবস্থাপনাও পরিচালন) নিয়মাবলি ১৯৯৮ (Bio Medical Waste (Management and Handling) Rules 1998, amended in 2016), ক্ষতিকর বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও পরিচালন) নিয়মাবলি ১৯৮৯ (Hazardous Waste Management Rules 1989, amended in 2016), পৌর বিষয়ক কঠিন বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার) ২০০০ (Solid Waste Management Rules 2000, amended in `2016), এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট ২০০৬ নিয়মাবলি (Environmental Impact Assessment ("EIA") Notifications 2006, amended in 2020) ইত্যাদি। এর বাইরেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন চালু করা হয় - বন (সংরক্ষণ) আইন ১৯৮০ (Forest (Conservation) Act 1980, final proposal for amendment in 2023), বন অধিকার আইন ২০০৬ (Forest Rights Act 2006), গণ দায়বদ্ধমূলক বিমা আইন ১৯৯১ (The Public Liability Insurance Act 1991), ন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৯৫ (National Environment Tribunal Act 1995), জীববৈচিত্র্য আইন ২০০২ (Biological Diversity Act, 2002 amended in 2022) ইত্যাদি। এছাড়া প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যবহার, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, শব্দ বাজি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়েও মাঝেমাঝেই নোটিফিকেশন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা) আইন ২০০৬ (East Kolkata Wetland (Conservation and Management) Act, 2006, amended in 2017) ও পশ্চিমবঙ্গ ভূগর্ভস্থ জলসম্পদ (পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রনিয়ম) আইন ২০০৬ (West Bengal Ground Water Resources (Management, Control & Regulation) Act, 2006) এই দুটি পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। ভারতে খনি সংক্রান্ত আইন প্রস্তুত করা হয় ১৯৫৭ সালে - খনি ও খনিজ (উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৫৭ (Mines And Minerals (Development And Regulation) Act, 1957) (No. 67 of 1957) যা অনেকবার সংশোধিত হয়েছে।
২০১০ সাল পর্যন্ত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে যে সমস্ত আইন, নিয়মাবলি (রুলস), ও নোটিফিকেশন করা হয়েছে বা তার সংশোধন করা হয়েছে তা মূলত অধিকাংশই পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি রোধ ও উন্নয়নকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর প্রয়োগ সঠিকভাবে হয়নি এবং প্রশাসনিক গাফিলতি ও অসচ্ছতা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের মসনদে নির্বাচিত হয়ে যে সরকার আসে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খনি, শ্রম, শিল্প, জল, জীববৈচিত্র্য, বন, পরিবেশ সহ সমস্ত ক্ষেত্রের নীতিগুলিকে পরিবর্তন করে আইনগুলির সংশোধন করতে শুরু করে। এই পরিবর্তন ও সংশোধন মূলত সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারিকরণ করে করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যেই করা হচ্ছে। এই পরিবর্তন ও সংশোধন করার জন্য একটি জঘন্যতম প্রয়াস হচ্ছে করোনার কালকে বেছে নেওয়া অর্থাৎ ২০২০-র মার্চ থেকে ২০২২-র মার্চের মধ্যে ৭৪টি গেজেট বিজ্ঞপ্তি, ৪২টি অফিস মেমোরেন্ডাম, ৭টি অফিস সার্কুলার ও কিছু অফিস অর্ডারের মাধ্যমে শুধু Environment (Protection) Act 1986-এর অধীনে সমস্ত রুলস ও নোটিফিকেশনের ৩৯টা পরিবর্তন ও সংশোধন করেছে। এনভিরনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এসেসেমেন্ট ২০০৬-এর বিজ্ঞপ্তির ১৩টি সংশোধনী করা হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের যে সংবিধিবদ্ধ প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত ছিল তার শিথিলকরণ ও ছাড় প্রদানের লক্ষ্যেই ওই সংশোধনীগুলি করা হয়েছে যাতে দেশি ও বিদেশি করপোরেটদের দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনের আইনি বাঁধা দূর হয় এবং তারা মুনাফার পাহার গড়তে পারে। করোনার সময়কাল থেকে একাধারে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরো নিম্নগামী হয়েছে, দেশে বেকারত্ব রকেটগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, দেশে অপুষ্টি ও ক্ষুধার্ত মানুষের হার ক্রমশ বাড়ছে, আরেকদিকে এই সময়েতেই দেশে ভারতের শীর্ষতম ধনী ১০জন ব্যক্তির মালিকানায় চলে গেছে দেশের মোট সম্পদের ৫৭ শতাংশ; অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিচের দিকে থাকা জনগণের অর্ধেক অংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ১.৩ শতাংশ। আদানি, আম্বানি, ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক পুনাওয়ালার মতো ১০ -১২ জনের সম্পদ রকেট গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। আদানির সম্পদ ২০১৯ সালের ১৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৫৫ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় টাকায় ১২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা)।
এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০০৬ (ইআইএ ২০০৬) নোটিফিকেশনের সংশোধনী
যে কোনো প্রকল্প রুপায়ণের ক্ষেত্রে যাতে পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষার দিকে নজর রাখা হয় ও প্রাকৃতিক সম্পদের যাতে যৌক্তিক ব্যবহার হয় সেই লক্ষ্যেই এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০০৬ (ই আই এ ২০০৬) নোটিফিকেশন চালু করা হয়। ই আই এ ২০০৬ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কেন্দ্র, প্রতিটি রাজ্যে এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ই আই এ অথরিটি ও বিভিন্ন বিষয়ের উপরে বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে। সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো প্রকল্প রুপায়ণকারীকে এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সহ ই আই এ রিপোর্ট, প্রকল্পের সাইজ ও দূষণের প্রকৃতি এবং বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীল অঞ্চলের গুরুত্ব অনুযায়ী রাজ্য অথবা কেন্দ্রীয় স্তরে জমা দিতে হয়। কীভাবে রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হবে তার বিস্তারিত ই আই এ ২০০৬ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া আছে। এই রিপোর্ট বিশ্লেষণ করার পরে যে অঞ্চলে প্রকল্প হবে সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রকল্পের কারণে সামজিক, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কী প্রভাব পড়বে এবং তার নিরসনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা জানাতে হবে। এক মাস সময় দিয়ে তাদের সাথে মিটিং করে মতামত নেওয়ার বা জনশুনানির পরেই প্রকল্পে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ই আই এ ২০০৬-এর যে সংশোধনী, ২০২০-তে সেই মতামতের সময়কে ৩০ দিনের থেকে কমিয়ে ২০ দিন করা হয়েছে। আগে যে সমস্ত প্রকল্প ই আই এ ২০০৬-এর অধীনে ছিল তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে ই আই এ-এর ছাড়পত্র নেওয়া থেকে মকুব করে দেওয়া হয়েছে, যেমন রাস্তা, ক্যানেল ইত্যাদির মতো রৈখিক প্রকল্প (Linear Project), ১৫০ হেক্টর পর্যন্ত এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প - যেমন গুচ্ছ বাড়ি, বা উপনগরী তৈরি বা যদি কোনো জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত অঞ্চল, গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি ইত্যদির মধ্যে দিয়ে কোনো রৈখিক প্রকল্প গ্রহণ করলে কোনো ই আই এ-এর ছাড়পত্র লাগবে না। প্রকল্পের দূষণের ক্ষমতা বা বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীলতা অনুযায়ী প্রকল্পগুলিকে ই আই এ ২০০৬-এর বিজ্ঞপ্তিতে শ্রেণি বিভক্ত করা গুরুত্ব করা হয়েছিল। A শ্রেণিভুক্ত প্রকল্পগুলিকে কেন্দ্রীয়স্তরে ছাড়পত্র ও B2 শ্রেণিভুক্ত প্রকল্পগুলিকে রাজ্যস্তরে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান ছিল। B1 শ্রেণিভুক্ত প্রকল্পগুলিকে কোনো ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সংশোধনী ২০২০-তে অনেক A শ্রেণিভুক্ত প্রকল্প গুলিকে B1শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ও অনেক B1 শ্রেণিভুক্ত প্রকল্পগুলিকে B2 শ্রেণিভুক্ত করে ই আই এ ২০০৬-এর বিজ্ঞপ্তিকে লঘু করে দেওয়া হয়েছে। ই আই এ ২০০৬-এর ২০২০-র সংশোধনীর বিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং পরে তার অনুমোদন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে যাকে বলা হয় “Post-facto Approval”। এই বিজ্ঞপ্তির ৫৪টি পরিবর্তন শুধু করা হয়েছে শিল্প-কারখানা ও উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়ে এবং ৪৮টি পরিবর্তন করা হয়েছে ছাড়পত্র প্রদানকারী বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটি বা বিশেষজ্ঞ কমিটি বা ব্যক্তি নির্ধারিত দায়িত্ব বিষয় সম্পর্কিত। করপোরেটদের স্বার্থেই সমস্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। ই আই এ ২০২০ সংশোধনীতে করপোরেটদের দ্বারা পরিবেশ ধ্বংসের ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের সমস্ত রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। ওডিশা ও ছত্তিশগড়ে আগে খনি থেকে খনিজ সম্পদ নিষ্কাশন, গুজরাটে বন্দর নির্মাণ, বৃহৎ শিল্প ইত্যাদি প্রকল্প রুপায়ণের ক্ষেত্রে করপোরেটদের বিশেষত আদানিদের ই আই এ ২০০৬-এর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অনেক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল এবং বনবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল।
পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন ১৯৮৬-র অধীনে জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৭৪ ও বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১-র সংশোধনী এবং “জন বিশ্বাস বিল”
কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক ৩০ জুন, ২০২২-এ জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৭৪ ও বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১-র সংশোধনীর প্রস্তাব দেয় ও ১ জুলাই,২০২২ তাদের ওয়েবসাইটে দেয় যে কোনো ব্যক্তির বা সংস্থার মতামতের জন্য। এই সংশোধনীতে আগে রাজ্য সরকারের যে সমস্ত ক্ষমতা ছিল তার হস্তান্তর করে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে নেয়, যা আমাদের দেশের ফেডারেল কাঠামোর পরিপন্থী। ওই দুটি আইন লঙ্ঘন করলে আগে যে আর্থিক শাস্তির বিধান ছিল তা লঘু করে দেওয়া হয়। কারাদণ্ডের যে বিধান ছিল তাকে প্রায় তুলে দেওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। এই সংশোধনীতে যা আছে তাতে ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। এই সংশোধনীগুলিকে আইনে রূপান্তর করার জন্যে ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে আশ্চর্যজনকভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক লোকসভায় “জন বিশ্বাস বিল” পেশ করে। বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১, ভারতীয় বন আইন ১৯২৭, পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন ১৯৮৬, গণ দায়বদ্ধমূলক বিমা আইন ১৯৯১ যা পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রকের অধীনে আছে সেগুলিকে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের পেশ করা এই “জন বিশ্বাস বিল”-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিলে কারাদণ্ডের বিধানকে সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়েছে। এই বিলে ভারতীয় বন আইন ১৯২৭-এ যে আর্থিক শাস্তির কাঠামো ছিল তার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি, আর্থিক জরিমানার পরিমাণ ৫০০টাকাই রাখা হয়েছে , অথচ সব রাজ্যই এই জরিমানার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছিল। জন বিশ্বাস বিলে পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন ১৯৮৬- ও বায়ু (দূষণ নিবারন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১-এর ১৫(২) ধারায় ধারাবাহিক অপরাধের জন্য প্রতিদিন ১০হাজার টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, অথচ জুলাই ২০২২-এর সংশোধনীতে ১ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। জন বিশ্বাস বিলে শুধুমাত্র বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১-এর ৩৭ নং ধারায় ধারাবাহিক অপরাধের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু জুলাই ২০২২-এর সংশোধনীতে ৫ লক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২০২২-এর জন বিশ্বাস বিল ও জুলাই ২০২২-এই দুটিতেই বিচারের ব্যবস্থা আদালতের থেকে তুলে নিয়ে বিচারকারী কর্মকর্তা হিসাবে কোনো প্রশাসনিক আধিকারিকের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সরকার নিজের হাতে রাখবে।
বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০-র পরিবর্তন
কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক জুন, ২০২২-এ বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০-র পরিবর্তন করে বন সংরক্ষণ রুল ২০২২ নামে একটি সংশোধনীর প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবে যে বিধানগুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রায় সবক'টি অরণ্য ধ্বংসের সহায়ক হবে - যে কোনো ধরনের বনভূমিকে যেখানে বনবাসী উপজাতি বা বনবাসী বা আদিবাসীদের পরম্পরাগত অধিকার আছে, সেই অধিকার হরণ করে সরকার বনাঞ্চলকে অধিগ্রহণ করতে পারবে। যেখানে ২০০৬ সালের অরণ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী যে কোনো বনভূমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যেমন খনি, কারখানা, বা জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, রাস্তা ইত্যাদির তৈরির ক্ষেত্রে আদিবাসী-অরণ্যবাসীদের অনুমতি নেওয়া জরুরি ছিল, এই বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০-র সংশোধনীর নামে বন সংরক্ষণ রুল ২০২২ প্রস্তুত করে তা নস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। এই নতুন রুলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৫ হেক্টরের বেশি আয়তনের কোনো অরণ্য অন্য কাজে ব্যবহার করতে গেলে পূর্বের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রকের কোনো অনুমতি লাগবে না। প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল নিজেরাই একটি স্ক্রিনিং কমিটি তৈরি করে ওই বনাঞ্চলে কারখানা, খনি, রাস্তা ইত্যাদি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে পারবে। এই সংশোধনীকে আইনে পরিণত করার জন্য বন সংরক্ষণ বিল ২০২৩ সংসদে পেশ করা হয়েছে। এই বিলকে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ করা হয়েছে। বনাঞ্চলের অবস্থিত সমস্ত অংশের মানুষ সহ অনেক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এই বিলের বিরোধিতা করছে।
একটি বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ২০২২-এর নভেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক জুলাই ২০১৪ থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ২২৫০টি প্রকল্প ছাড়পত্র দিয়েছে তার মধ্যে জীববৈচিত্র্য হটস্পটে ২৭০টি প্রকল্প আছে। বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীল অঞ্চল (Eco-sensitive Zone) ও সংরক্ষিত এলাকায় (Protected Areas - PA) ব্যাপকভাবে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ এর প্রতিবাদ করছে ও এই প্রকল্পগুলির বিরোধিতা করে আদালত বা জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের আশ্রয় নিয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ ও বন সংক্রান্ত সমস্ত আইনকে লঘু করার জন্য বা একেবারেই সমস্ত বাধানিষেধ তুলে দেবার লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে সংশোধনী বা বাতিল করার বিজ্ঞপ্তি বা বিল আনছে। করপোরেটদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ ও বন সংক্রান্ত আইনগুলির পরিবর্তনের জনবিরোধী এই জঘন্যতম প্রয়াসের বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের মানুষকে সচেতন করে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে এই আইনগুলি ইতিমধ্যেই প্রয়োগ করার প্রয়াস শুরু হয়েছে যা আগামীতে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পথকে সুগম করবে এবং আমাদের দেশে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসলীলা তরান্বিত হবে।