E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

ভাঙন ও আমরা

তাপস দাস


মালদহে কালিয়াচকে নদী ভাঙন।

ফারাক্কা ব্যারেজের ভাটির দিকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী-গঙ্গার পূর্ব তীরে ছোট্ট গ্রাম পারদেওনাপুর। বিগত কিছু বছর ধরে এই অখ্যাত গ্রাম খবরের শিরোনামে। কারণ গঙ্গা ভাঙন। সেই ভাঙন কবলিত মানুষের সঙ্গে গ্রাম সভায় বসে আছি, প্রবীণ স্কুল শিক্ষক জহিরউদ্দিন বাবুর সঙ্গে ‘নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনে’র কথা ভাগ করে নিতে গিয়ে হঠাৎ করে বলে উঠলেন, আপনারা তো ঠিক বলছেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমরা বন্যার সঙ্গে বেঁচে থাকতে ভুলে গিয়েছি। বন্যা অর্থাৎ নদীর জলের ধেয়ে আসা আবার জল চলে যাওয়া, এটা ছিল নদীর স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের এই নদী কখনো পূর্ব দিকে সরে যেত আবার কখনো পশ্চিম দিকে। ভাঙন হতো বাপ ঠাকুরদারা আবার ঘর বাড়ি তৈরি করতো। কিন্তু এই জায়গা থেকে কখনোই দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবতেন না। ‘‘নদীর পাড়ে বাস ভাবনা বারো মাস’’ এই প্রবাদ থাকলেও নদীর পাড়েই ছিল বাংলার মানুষের বাস। কিন্তু বর্তমানে গঙ্গা ভাঙন আর সেই সময়ের নদীর ভাঙনের তুলনা করলে ঠিক হবে না। কারণ সেই সময় নদী যেমন ভাঙতো তেমন গড়তো। আর আজকে আপনারা দেখুন ফারাক্কার উজানে হোক কিংবা ভাটিতে নদী শুধু ভেঙে যায়। এর আর কোনো গড়ে তোলার ক্ষমতা নেই। ভাবুন একটা নদী, খুব বেশি হলে ৭০০-৮০০ মিটার চওড়া ছিল। এ পাড়ে হাক দিলে ওপার থেকে মাঝি নৌকা নিয়ে এসে পার করে দিত। সেই নদী আজকের কোথাও কোথাও পাঁচ কিলোমিটার চওড়া।

ফারাক্কা টাউনশিপের কাছে বীরনগর, আরেকটি ভাঙন কবলিত গ্রাম। সেই গ্রামের এক বৃদ্ধা মা কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘‘আমার বাড়ি নদীর পাড়ে ছিল না।’’ অল্প কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, মালদার মানুষেরা নদীর পাড়ে কেন বাস করে? অশ্রুতে ভেজা এই বৃদ্ধার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কথার কেমন একটা ফারাক বুঝলাম। আরও জানতে বোঝা গেল নদী ছিল ১২ কিলোমিটার দূরে। আর আজ সে নদী তাঁর বাড়ি, জমি,বাগান, বাজার,স্কুল,মন্দির,মসজিদ মানব সমাজের অঙ্গ সমস্ত কিছু ভেঙে ভাসিয়ে দিয়ে স্কুল বাড়ির ত্রাণ শিবিরে থাকতে বাধ্য করেছে। বীরনগর স্কুলের উঠানে এসে দাঁড়ালে গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ দেখা যায়, শোনা যায়। ওনাদের ধারণা আর এক দু’বছরে এই ত্রাণ শিবির হওয়া স্কুলও যাবে জলে তলিয়ে। নদী এ কুল ভেঙে ও কুল গড়ে এ কথা তো সবাই জানে, কিন্তু এই ফারাক্কার উজানে আর ভাটিতে এলে নদীর সেই চরিত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে শুধু নদী ভাঙে, শুধু পাড় ভাঙে, আর দিনের পর দিন চওড়া হয়ে যায়। নদীর চরিত্রের এই বদলের কারণ কী? ১৯৭৫ সালের একুশে এপ্রিল ফারাক্কা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল। তার তিন বছর যেতে না যেতে ফারাক্কা ব্যারেজের সমস্যা বুঝতে ১৯৭৮-এর প্রীতম সিং কমিটি বা ১৯৯৬-এর কেশকার কমিটি গঠন করতে হয়েছিল। তাদের সুপারিশ তারা জানিয়েছিলেন। সেই মতো কি ব্যবস্থা হয়েছিল জানা নেই! কিন্তু সেই সুপারিশে এই ঘরহারা মানুষগুলোর পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। শুধু ফারাক্কা ব্যারেজ বাঁচানো আর কলকাতাতে জল পাঠালেই সমাজ রাষ্ট্রের লাভ বেশি। এই ধারণা এখনো বহমান। ফারাক্কা ব্যারেজ গড়ে ওঠার এত বছর পরে গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল-পলি ভেসে যাওয়ার পরেও আমরা যারা শহরের সুখীজীবন পেয়ে চলেছি, কখনো কি ভেবেছি যে শুধুমাত্র একটি ব্যারেজের কারণে নদীর চরিত্র বদলে যাচ্ছে। আর তাতে প্রাণদাত্রী নদী সভ্যতার ভরকেন্দ্র থেকে বদলে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। লক্ষ মানুষ বারবার উদ্বাস্তু হয়ে গেলেও এই বিপদকে কখনোই রাষ্ট্রীয় বিপদ ভাবা হয়নি। অথচ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল ফারাক্কার ব্যারেজ। প্রশ্নটি শুধুমাত্র ফারাক্কা ব্যারেজকে করলেই শেষ হবে না। এই বিপদের কারণ সবটা অনুধাবন করা যাবে না বলে আমার মত। বিগত ১০০-১৫০০ বছর ধরে নদী ব্যবহারের যে ‘‘ধারণা-পদ্ধতি’’ তাকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে।

বিহারের সীতামারী জেলায় বাগমতী নদীর তটবন্ধন বিরোধী একটি আন্দোলনে পৌঁছেছিলাম ২০১৭ সালে, সেখানের সাধারণ শ্রমজীবী গ্রামবাসী মানুষ তটবন্ধন প্রকল্প আটকেছেন। জেসিবি’র সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পকে মানুষ রুখে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু কেন? বা তাদের এত মনের জোর কোথা থেকে এসেছিল? স্থানীয় মৈথিলী ভাষায় প্রবাদ আছে, ‘‘আইল পানি গেইল পানি বাটে বিলাইল পানি’’ অর্থাৎ জল আসে জল যায় ভাগ-বাঁটোয়ারা করে । এই জলকে নিয়ন্ত্রণ বিপদের শুরু সেখানে ব্রিটিশদের এবং ভারতীয় জমিদারদের জমি রক্ষা করার জন্যই গঙ্গা দামোদর সহ দেশ জুড়ে নদীগুলোতে পাড়বাঁধ বা তটবন্ধন দেওয়া শুরু হয়েছিল, এই তটবন্ধনকে ব্রিটিশ ভারতের আধুনিক জল ব্যবস্থার জনক ব্রিটিশ প্রকৌশলী উইলিয়াম উইলক্স বলেছিলেন, ‘‘অশুভ শৃংখল’’। তাঁর চারটি বক্তৃতার সংকলন অনুবাদ করে বাংলাদেশের ফারুক ওয়াসিফ ‘‘বাংলার নিজস্ব সেচ ব্যবস্থা’’ নামে একটি বই লিখেছেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত সেই বইতে উইলিয়াম উইলক্সকে বাংলার সেচ ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা গেছে। তাঁর মতে ভারতীয় নদীর প্লাবনভূমি এবং প্লাবনের জল-পলিকে ব্যবহারের যে নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল তা ছিল আধুনিক এবং যথার্থ। ১৬৬০ সালে পরিব্রাজক বার্নিয়ে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছেন, কৃষি উৎপাদনে বাংলা মিশর থেকেও সমৃদ্ধ। সেই বাংলা উপনিবেশ সময়কালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নদী-খালকে ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করতে ভুলেছে। ১৯৭৮-এর দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বিধ্বংসী বন্যার পরে বাংলার খাল সংস্কার এবং নতুন খাল খননের এক সার্বিক পরিকল্পনা দেখা গিয়েছিল। যার সুফল বাংলা বহুদিন পর্যন্ত পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বাংলার নদী শুধুমাত্র বালি-পাথরের অবৈধ চালানের খনি। যার ফলে বাংলা জুড়ে নদীর ভাঙন। ভাঙনের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা এবং নদী নির্ভর মানুষের জীবন জীবিকা কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়ছে। গাজোল মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক অমর চন্দ্র কর্মকার ‘‘অথ গঙ্গা কথা’’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইতে ‘‘ফারাক্কা ব্যারেজ শুধু গঙ্গার নয়, গাঙ্গেয়দেরও হাড়ি কাট’’ এমন একটি শিরোনামে অনুচ্ছেদ রেখেছেন। সেখানে তিনি দেখাচ্ছেন ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে মানিকচক কালিয়াচক-২ ও ৩ ব্লকের ৬৭টি মৌজার সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে নদী গর্ভে সলিল সমাধি ঘটেছে। পুনর্বাসনের অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত একটি সংগঠনের উল্লেখ করে তিনি বলছেন, প্রায় সাড়ে ৭০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদী ভাঙনে হারিয়ে গিয়েছে। তিনি আরও বলছেন, গঙ্গা মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সুতি ১ ও ২, রঘুনাথগঞ্জ ২, লালগোলা, ভগবানগোলা ১ ও ২, রানিনগর ১ ও ২ এবং জলঙ্গি ব্লক এলাকার প্রায় ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাড় ব্যাপক ভাঙন প্রবণ। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে এমন খবর এসেছে, ফারাক্কা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত ১৭ জায়গায় নদী ভাঙন কবলিত হয়েছে। কলকাতার তরল বর্জ্য বয়ে নিয়ে চলা বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে সন্দেশখালি ১ ব্লকে বাউনিয়া দ্বীপের দুই হাজার বিঘা জমি ভেঙেছে। নদী ভাঙন প্রবল আকার নিচ্ছে। কোথাও ব্যারেজের উজান-ভাঁটিতে বা কোথাও বালি পাথর তোলার ফলে বাংলার নদীগুলি বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের কাছে গ্রামের কৃষক কমলউদ্দিন ঘরামি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন ভাঙন আর বন্যা এক জিনিস নয়। ভাঙন হলো সর্বনাশ, অপরিবর্তনীয় ক্ষতি। বন্যায় জল আসে জল চলে যায় জলের সঙ্গে থাকে নদীর আশীর্বাদ পলি। সেই পলিতে আমরা চাষ করি আমাদের বাপ ঠাকুরদার সময় থেকে। ১৯৬৮সালের বন্যায় তাঁর গ্রামে জল দাঁড়িয়েছিল মাত্র দু’দিন। একটু কষ্ট ছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতি তেমন ছিল না। বরঞ্চ তার পরের কয়েক বছর চাষ ভাল হয়েছিল। অথচ সেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে বিস্তর ভারত জুড়ে আলোচনা প্রাক্-স্বাধীনতা যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। আজকে যখন আমাদের মতন সাধারণ নদী কর্মীরা ভারতের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, তাঁদের দেখা বন্যা এবং ব্যাখ্যা করা আর সেই প্রাক্-স্বাধীনতা যুগ থেকে যে পদ্ধতি, তথ্য, গবেষণা বই পড়া জ্ঞানে পেয়েছি তার সঙ্গে এই প্রান্তিক মানুষদের জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ পরম্পরাগত জ্ঞান থেকে ফারাক থেকে যাচ্ছে। অথচ কোচবিহার জেলার কৃষক আর সীতামারি জেলার কৃষকের ধারণা একই থাকছে। যেভাবে সীতামারির মানুষেরা বন্যাকে ব্যাখ্যা করছেন, মা জ্ঞানে- দেবী জ্ঞানে পুজো করছেন, গান গাইছেন ‘‘বাড় মাইয়া ইসবার আও হামারি ঘর’’..., সেই একই চেতনাবোধ কোচবিহারের কৃষকের কাছেও। অথচ বরাবর ভারতের প্রশাসনের কাছে, অত্যন্ত চিন্তার বিষয় ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ’ ও কৃষকের কাছে সেচের জল পৌঁছে দেওয়া। এরজন্য লক্ষ লক্ষ টন সিমেন্ট, পাথর, লোহা সারা ভারতের নদীগুলিকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে। তার সঙ্গে জুড়ে আছে জলবিদ্যুৎ। তাতে নিশ্চয়ই ভারতের অর্থনৈতিক মুনাফা হয়েছে, হচ্ছে। আবার অন্যদিকে, ২০১৬ সালের মিহির শাহ রিপোর্ট বলছে, ভারতে বরো চাষ নির্ভর করে আছে ভূগর্ভস্থ জলের উপর। অর্থাৎ জলসেচ ব্যবস্থাও প্রশ্নের মুখে। অপরদিকে প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। ভারতীয় নদীতে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সেই বন্যার সঙ্গে বাঁচার জ্ঞান এবং আধুনিক বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার পদ্ধতি রপ্ত করা জরুরি। শুধু পরিকাঠামো তৈরিতেই লক্ষ কোটি টাকা খরচ করার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সহনশীল জীবন পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ ভাঙন যেমন এক কঠিন বাস্তব, তেমনি নদীতে জল প্রবাহের ঘাটতি জীব বৈচিত্র্য সহ নদী নির্ভর মানুষের জীবিকাকে সংকটগ্রস্ত করে তুলেছে। অথচ এই সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থাই মানুষের উপর শোষণকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। এই পরিকাঠামো বা পরিবেশ প্রকৃতির বদল ঘটানো কোন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখা হবে তার চর্চা নতুনভাবে চলছে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় স্থানীয় পরিকল্পনাকে যথার্থ পরিবেশবান্ধব ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের প্রশ্নগুলিকে শক্তিশালীভাবে রাখার প্রয়োজন।

ভাঙন মোকাবিলায় দীর্ঘকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অবিলম্বে কেন্দ্রের নিজস্ব নীতি হওয়া উচিত। যে নীতিমালা ভাঙন কবলিত মানুষের পুনর্বাসনের অধিকারকে সুনিশ্চিত করবে। বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার এমন নীতিমালা গ্রহণ করতে চলেছে। অথচ সেই নীতিমালা প্রকাশ্যে এখনো পর্যন্ত আসেনি। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য নদীকর্মী, পরিবেশকর্মী এবং প্রান্তিক মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত সবাইকে নিয়ে সার্বিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা জরুরি।