৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
অর্থনীতির সহজপাঠ
মূল্য ও দাম, পণ্য ও দ্রব্য এবং শ্রম ও শ্রমশক্তির মধ্যে পার্থক্য
আবুবকর সেখ
আমরা জানি যে, মার্কসবাদ হলো একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ। কারণ এই মতবাদের বিশ্ববীক্ষা হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। এই মতবাদকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলা হয় কারণ, বস্তুজগতের প্রতি মার্কসবাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বস্তুজগতের ঘটনা-প্রবাহ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার পদ্ধতি হলো দ্বন্দ্বমূলক। আবার বস্তুজগতের ঘটনা প্রবাহের ব্যাখ্যা, সেই সম্পর্কে এই মতবাদের ধারণা এবং তত্ত্ব হলো বস্তুবাদী।
তাই মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রতিটি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উত্থাপন করে। মার্কসীয় অর্থনীতির মতো করে অত গভীরে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে দক্ষতা দেখাতে পারে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি থেকে যায় যা মার্কসীয় অর্থনীতি ওই বিভ্রান্তিগুলি দূর করতে সক্ষম হয়। এমনই কিছু শব্দ সমষ্টি যা শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
মূল্য ও দামের মধ্যে পার্থক্য
পুঁজিবাদী সমাজে প্রচলিত অর্থনীতিতে মূল্য ও দাম এই দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখানো হয়না। কিন্তু মার্কসীয় অর্থনীতিতে মূল্য ও দামের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ব্যাখ্যা করে দেখানো হয়।
প্রথমে মূল্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মূল্য বলতে আমরা কী বুঝি? এই বিষয়ে কার্ল মার্কস তাঁর ‘পুঁজি’ গ্ৰন্থে প্রথম অধ্যায়ে মূল্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন,... “সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যেকটির ভিতরকার এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটির ভিতর আছে একই বিদেহী বাস্তব, বিশুদ্ধ সমধর্মী শ্রমের সংহত রূপ, ব্যয়ের প্রকার-নির্বিশেষে ব্যয়িত শ্রমশক্তির পুঞ্জীভূত অবস্থা। আমাদের কাছে এই সমস্ত দ্রব্যের একমাত্র পরিচয় এই যে, এগুলি তৈরি করতে মানুষের শ্রমশক্তি ব্যয়িত হয়েছে, মনুষ্য-শ্রম এগুলির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে। এই দ্রব্যগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই এই যে সামাজিক বস্তুটি বিদ্যমান তার স্ফটিক হিসেবে দেখলে এগুলি হলো - মূল্য।”(পৃষ্ঠা-৬১)
এখন বিষয়টি একটু সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রতিটি পণ্য উৎপাদন করতে মানুষের শ্রমশক্তি ব্যয়িত হয়। এই ব্যয়িত শ্রমশক্তির পুঞ্জীভূত অবস্থাই হচ্ছে শ্রম যা মূল্য সৃষ্টি করে। যে পণ্য উৎপাদন করতে যতটা শ্রম লাগে সেই পণ্যের মূল্য ততটাই, তার বেশি বা কম নয়। যেমন, এক জোড়া জুতো তৈরি করতে যতটা শ্রম লাগে, সেই পরিমাণ শ্রম যদি দুই জোড়া ধুতি তৈরি করতে লাগে, তাহলে এক জোড়া জুতো ও দুই জোড়া ধুতির মূল্য সমান। সুতরাং যখনই পণ্যের সঙ্গে বিনিময় হয়, তখনই যে সাধারণ বস্তুটি তার বিনিময়-মূল্যের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তা হচ্ছে তার মূল্য।
স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে কীভাবে কোনো দ্রব্যের মূল্যের পরিমাণ মাপা যাবে? এর উত্তরে মার্কস বলেন, “সোজাসুজি, মূল্যোৎপাদক বস্তুর, অর্থাৎ দ্রব্যে নিহিত শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই শ্রম-সময় দিয়ে ঠিক করা হয়, আর শ্রম-সময় পরিমাপের মান হচ্ছে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা।” (পৃষ্ঠা-৬২)
আবার উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং সেই সময়কার গড় দক্ষতা ও শ্রমের তীব্রতা সহ মেহনত করলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগে, তাকেই বলে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একই পরিমাণ সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বুনতে যে সময় লাগে, বাষ্পচালিত তাঁতে সমপরিমাণ সুতা দিয়ে কাপড় বুনতে অনেক কম সময় লাগে। অর্থাৎ পরিকাঠামো কী আছে তার উপর নির্ভর করে।
এখন দাম নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে
কোনো দ্রব্যের দাম বলতে আমরা কী বুঝি? ব্যক্তিমালিকানাধীন সমাজে পণ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে যেকোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় উক্ত পণ্যের চাহিদা ও জোগান রেখার ছেদ বিন্দুতে। যদি উক্ত পণ্যের চাহিদা জোগানের তুলনায় বেশি হয় তাহলে দাম মূল্যের বেশি হয়। আবার যদি চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হয় তখন দাম মূল্যের তুলনায় কম হয়। পুঁজিবাদী সমাজে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় এভাবেই কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়।
কার্ল মার্কস চাহিদা ও জোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণকে পরিহাস করে বলেন, “হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা এই প্রাথমিক নিয়মও জানেন না বলে মনে হয়। এই নিচে-মাথা উপরে পা-ওয়ালা আর্কিমিডিসরা জোগান ও চাহিদা দিয়ে শ্রমের বাজার-দাম ঠিক করতে গিয়ে কল্পনা করেন যে, সেই অবস্থান-বিন্দুটি পেয়ে গিয়েছেন - কিন্তু পৃথিবীকে নাড়ানোর জন্য নয় তার গতি বন্ধ করার জন্য।” (পৃষ্ঠা -৩৭৮)
এক্ষেত্রে জেনে রাখা দরকার যে, শ্রমিকদের শ্রমশক্তিও একটি পণ্য, যা মালিকের নিকটে শ্রমিক বিক্রয় করে। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপকরণের মালিক অনেক সস্তায় এই শ্রমশক্তি ক্রয় করেন। কারণ চাহিদার তুলনায় শ্রমশক্তির জোগান সবসময়ই অনেক বেশি থাকে।
এই চাহিদা ও জোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে উৎপন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ হওয়ায় আমাদের দেশের কৃষক সমাজ বরাবর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। মহারাষ্ট্রের নাসিকে পেঁয়াজ উৎপাদক কৃষকরা কেজি প্রতি মাত্র দুই থেকে তিন টাকা দাম পেয়েছেন যা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ির কৃষকদেরও একই অবস্থা। টমেটোর দাম দুই টাকা কেজি হওয়ায় কৃষক জমি থেকে টমেটো হারভেস্ট করাই বন্ধ করে দেয়। কারণ তাতে পরিবহণ খরচই উঠে আসে না। যেকারণে দেশের কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এম এস স্বামীনাথন কমিশন কম্প্রিহেনসিভ কস্ট অফ প্রোডাকশনের দেড় গুণ বেশি দাম (সি ২+৫০ শতাংশ) কৃষকদের দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিলেন।
ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থায় শিল্পজাত ও কৃষিজাত পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। শিল্পজাত পণ্যের গায়ে লেবেলে দাম লেখা থাকে।শিল্পপতিই বিক্রেতা হিসেবে তার পণ্যের দাম নির্ধারণ করন। ক্রেতাদের ওই দামেই পণ্যটি কিনতে হয়। কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে বিক্রেতা বা উৎপাদক তার পণ্যের দাম ঠিক করতে পারে না। এখানেও দাম বেঁধে দেন স্বার্থান্বেষী ক্রেতাই।
পণ্য ও দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য
কোন ধরনের দ্রব্যকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হবে সে বিষয়ে মার্কস বলেন, “যে সমস্ত সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির প্রাধান্য বর্তমান, সেখানকার ‘পণ্যের এক বিপুল সমারোহরূপে’ দেখা দেয়, আর এক একটি পণ্য এ ধনসম্ভারের প্রাথমিক রূপ হিসেবে দেখা দেয়।...
...পণ্য হলো প্রথমত, বাহ্যিক একটি জিনিস, যা তার গুণাবলির দ্বারা মানুষের কোনো না কোনো চাহিদা পূরণ করে।” (পৃষ্ঠা -৫৭)
পণ্য ও দ্রব্যের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নির্ণয় করে মার্কস আরও বলেন, “মূল্য না থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিস ব্যবহার-মূল্য হতে পারে। এ রকমটি তখনই হয় যখন মানুষের কাছে তার ব্যবহারিকতার সৃষ্টি শ্রমের ফলে হয় না। যথা, বাতাস, অহল্যা ভূমি, প্রাকৃতিক তৃণভূমি, জঙ্গল, প্রভৃতি। একটি দ্রব্য পণ্য না হয়েও প্রয়োজনীয় হতে পারে এবং মানুষের শ্রম থেকে উৎপন্ন হতে পারে। যে কেউ নিজ শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্য দ্বারা সরাসরি নিজের চাহিদা পূরণ করে, সে অবশ্যই ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু পণ্য সৃষ্টি করে না। পণ্য উৎপন্ন করতে হলে, তাকে কেবল ব্যবহার-মূল্য উৎপন্ন করলেই চলবে না, উৎপন্ন করতে হবে অন্যদের জন্য ব্যবহার-মূল্য, সামাজিক ব্যবহার-মূল্য। (কেবল অপরের জন্য হলেই হবে না, আরও কিছু চাই। মধ্যযুগের কৃষক তার সামন্ত প্রভুর জন্য উৎপন্ন করত উঠবন্দি খাজনা দেবার শস্য এবং তার পাদ্রির জন্য দেবোত্তর খাজনার শস্য। কিন্তু অন্যের জন্য উৎপন্ন হয়েছে বলেই উঠবন্দি খাজনার শস্য বা দেবোত্তর খাজনার শস্য পণ্য হতো না। পণ্য হতে হলে, দ্রব্যকে বিনিময়ের মারফত স্থানান্তরিত হতে হবে অন্যের কাছে, যার সেবা করবে ব্যবহার-মূল্য হিসেবে। - এঙ্গেলস) পরিশেষে, ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্য না হয়ে, কোনো কিছুরই মূল্য থাকতে পারে না। দ্রব্যটি যদি অব্যবহার্য হয়, তার অভ্যন্তরস্থ শ্রমও অব্যবহার্য হবেঃ ওই শ্রম শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, কাজে কাজেই তখন মূল্য সৃষ্টি করে না।”(পৃষ্ঠা-৬৪)
সহজভাবে বলতে গেলে পণ্য হলো সেই জিনিস যা উৎপাদক নিজের ভোগের জন্য উৎপাদন করেনা, মুনাফা অর্জনের জন্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন করে। পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য উভয়ই বিদ্যমান থাকে।
অপরদিকে দ্রব্য হলো সেই জিনিস যা উৎপাদক শুধুমাত্র নিজের ভোগের জন্য উৎপাদন করে থাকে,বাজারে বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন করে না। দ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার-মূল্য থাকে, কিন্তু কোনো বিনিময়-মূল্য থাকে না। সুতরাং, পণ্য ও দ্রব্যের মধ্যেকার পার্থক্য সহজেই অনুমান করা যায়।
শ্রম ও শ্রমশক্তির মধ্যে পার্থক্য
আমরা জানি পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলি ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থায় যা কিছু উৎপাদিত হয় ব্যক্তি মালিকের মুনাফার জন্য, বাজারে বিক্রয়ের পণ্য হিসেবে উৎপাদন করা হয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শ্রমশক্তিও একটি পণ্য যা বাজারে বিক্রয়ের মালে পরিণত হয়।
তাহলে শ্রম ও শ্রমশক্তি বলতে আমরা কী বুঝি? শ্রমশক্তি মানুষের শ্রম বা মেহনত করার শক্তি বা ক্ষমতা। শ্রম করার শক্তি যতক্ষণ মানুষের দেহের মধ্যে থাকে, তা খরচ করা বা কাজে লাগানো না হয়, ততক্ষণ তা শ্রমশক্তি, শ্রম নয়। যখন শ্রমশক্তি খরচ হয়ে যায়, কোনো দরকারি জিনিস বা পণ্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়, তখন ওই শ্রমশক্তি আর দেহের মধ্যে থাকে না, দেহের বাইরে এসে শ্রমে পরিণত হয়। সুতরাং, শ্রম ও শ্রমশক্তি এক জিনিস নয়, দুটি আলাদা বিষয়। এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
এবিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার (২০০৬ সালে এন বি এ থেকে প্রকাশিত নবম সংস্করণ)-এর ২৮ নং টীকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব উদ্ভাবন করার আগে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের ১৮৪০-এর এবং ১৮৫০-এর শতকের রচনাবলিতে “শ্রমের মূল্য’’, “শ্রমের দাম’’, “শ্রম বিক্রয়” এই কথাগুলির ব্যবহার করেছিলেন। মজুরি, শ্রম ও পুঁজি নামক পুস্তিকাটির উপক্রমণিকায় ১৮৯১ সালে এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ওই কথাগুলি ‘পরবর্তী রচনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে অপর্যাপ্ত, এমন কি ভুলও বটে’। শ্রমিক পুঁজিপতির কাছে নিজের শ্রম নয়, নিজের শ্রম-শক্তিকেই বিক্রয় করে - এটি করার পর মার্কস আরও সঠিক কথার ব্যবহার করেন। পরবর্তী রচনাবলিতে মার্কস ও এঙ্গেলস “শ্রমশক্তির মূল্য”, “শ্রমশক্তির দাম”, “শ্রমশক্তির বিক্রয়” - কথাগুলি ব্যবহার করেন। (পৃষ্ঠা-৬৩)
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় কোন্ জিনিসটি ‘শ্রম’ আর কোনটি ‘শ্রমশক্তি’ তার মধ্যেকার যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বর্তমান তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কারণ অনেক সময় শ্রমশক্তিকেই ‘শ্রম’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানুষ এই শ্রমশক্তি পায় কোথা থেকে? বাজারে যে বিভিন্ন পুষ্টিসমৃদ্ধ পণ্য (চাল, ডাল, তরিতরকারি,মাছ,মাংস,ডিম,দুধ ইত্যাদি) পাওয়া যায় তা সরাসরি ভোগের মাধ্যমে মানুষ তার দেহে শক্তি সঞ্চয় করে থাকে পরের দিন উৎপাদন কাজে ব্যয় বা খরচ করার জন্য। এখন কোনো কাঠ মিস্ত্রি পুষ্টিকর খাবার খেয়ে তার দেহ যে শ্রমশক্তি অর্জন করেছে তা দিয়ে সারাদিনে একটি চেয়ার তৈরি করল। এই চেয়ারটি হলো কাঠ মিস্ত্রির শ্রমশক্তির পুঞ্জীভূত রূপ যা শ্রমে রূপান্তরিত হলো। সমস্যা দেখা দেয় যখন এই শ্রমকেই উৎপাদনের চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়, শ্রমশক্তিকে নয়। ফলে একজন শ্রমিক যে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে তা নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় না।ধরা যাক, কোনো একজন তাঁত শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে দুটি শাড়ি তৈরি করল। শাড়ি দুটি বিক্রয় করে মালিক ৮০০ টাকা পেল। তাঁতিকে মজুরি বাবদ ২০০ টাকা দেওয়া হলো। তাঁতি ৮ ঘণ্টা তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করে ২০০ টাকা পেল। এই দুই শত টাকার সমপরিমাণ মূল্য তাঁতি দুই ঘণ্টার মধ্যেই উৎপাদন করে ফেলে। বাকি ছয় ঘণ্টা উদ্বৃত্ত শ্রম সময়ে যখন সে যা উৎপাদন করে তা উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে আরও ৬০০ টাকার সমপরিমাণ মূল্য তৈরি করে, যা মালিক আত্মসাৎ করে। সুতরাং, শ্রম ও শ্রমশক্তির মধ্যেকার পার্থক্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে উদ্বৃত্ত মূল্য কীভাবে আসে তা বোঝা সম্ভব নয়।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, মার্কসীয় অর্থনীতি ও সর্বোপরি মার্কসবাদ সঠিকভাবে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের শব্দের অর্থগত দিক থেকে যে পার্থক্য সূচিত হয় তা অবগত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তা নাহলে বিভ্রান্তি থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়ে যায়। খুব স্বল্প পরিসরে হলেও এই বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরা হলো।