৬০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ৯ জুন, ২০২৩ / ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (চোদ্দো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● বৃহত্তর অর্থে বেদ কোনো নির্দিষ্ট পুস্তকেরই শুধুমাত্র নাম নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট যুগের সাহিত্য। যে যুগ প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পরিব্যপ্ত। এই দীর্ঘ সময়-ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয় জনগণের সমগ্র সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করছে এই সাহিত্য। স্বাভাবিকভাবেই বৈদিক সাহিত্যের রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্র। সময়, ভাষা এবং বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে সমগ্র বৈদিক সাহিত্যকে যদি আমরা শ্রেণিবদ্ধ করতে চাই, তাহলে আমরা চারটি ভিন্ন ধরনকে চিহ্নিত করতে পারি। এই চারটি ধরন হলো যথাক্রমে -
১। সংহিতা - পদ্যের সংকলন;
২। ব্রাহ্মণ;
৩। আরণ্যক - অরণ্য বিষয়ক গ্রন্থ;
৪। উপনিষদ।
এই সমগ্র সাহিত্য সম্বন্ধে পূর্বে ধারণা করা হতো - এগুলি এত পবিত্র যে এগুলি লিখিত হতে পারে না। এগুলি কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের হৃদয় থেকে শেখা যেতে পারে। এগুলির উপলব্ধিকারীদের মুখ থেকে শুনে শেখা যেতে পারে। তাই তো এদের 'শ্রুতি' বলে অভিহিত করা হতো।
● বেদ নির্দেশিত পথের অন্যতম হলো যজ্ঞানুষ্ঠান। একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে যজ্ঞকারী যজ্ঞের আয়োজন করত। অবৈজ্ঞানিক ধারণার দ্বারা তারা পরিচালিত হয়েই যজ্ঞানুষ্ঠান করা হতো।আসলে যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে চাহিদা। আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রাকৃতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করার আদিম প্রবৃত্তিও যজ্ঞানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাজ করত। বিষয়টিকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আদি বস্তুবাদ বলে অভিহিত করেছেন।
● পুরাণে আমরা পুত্রহীন রাজা দশরথের পুত্র লাভের বাসনায় পুত্রেষ্টি যজ্ঞের গল্প শুনেছি। ধর্মরাজ রাজ্য জয়ের অভিপ্রায়ে রাজসূয় যজ্ঞ করেন। আসমুদ্র ধরিত্রীর অধিপতি হতে রামচন্দ্র রাজসূয় যজ্ঞ করেন। লক্ষণীয়, সমস্ত লক্ষ্যই বৈষয়িক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, কোনো আধ্যাত্মিক লাভের জন্য নয়।
● বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব অর্জনের জন্যই ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত যজ্ঞের আচার সংস্কারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখত। এই কর্তৃত্ব কায়েমের হাতিয়ার ছিল বেদ, যা বংশপরম্পরায় শাসকশ্রেণি ও তার আশ্রিত পুরোহিত শ্রেণির মাধ্যমে টিকে ছিল।
● সংহিতা - সংহিতা অর্থ সংকলন। চারটি বেদ যথাক্রমে ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ হলো চারটি সংহিতা।
● ব্রাহ্মণ - সংহিতার সাথেই গড়ে উঠল ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ, যা ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করা হতো। ব্রাহ্মণগুলি অন্য ধরনের সাহিত্য। গদ্যে লিখিত এবং বিভিন্ন আচারের (rituals) পবিত্র তাৎপর্য তাদের কাছে উত্থাপন করা হলো যারা এইগুলির সাথে পরিচিত নন।
● সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (History of Sanskrit Literature)-এর লেখক ম্যাকডোনেল (A. A. Macdonell)-এর ভাষ্য অনুযায়ী - ‘‘ব্রাহ্মণ-এর মধ্য দিয়ে সেই যুগের ভাব বা চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। যখন সমস্ত বৌদ্ধিক কার্যধারা উৎসর্গ (Sacrifice)-কে ঘিরে কেন্দ্রীভূত ছিল। এরইসাথে উৎসর্গ বা বলি (Sacrifice)-কে কেন্দ্র করে সমস্ত অনুষ্ঠানের বর্ণনা, এগুলির মূল্য (Values) সম্পর্কে আলোচনা, এগুলির উৎস এবং তাৎপর্য সম্পর্কে অনুমানের প্রতিফলন ঘটেছে ব্রাহ্মণ-এর মধ্যে। যজ্ঞের মতো বৈদিক আচার অনুষ্ঠান পরিচালনা করার বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ব্রাহ্মণের আলোচ্য। যজ্ঞ পরিচালনার জন্য যজ্ঞ-বেদিকা ও যজ্ঞকুণ্ড নির্মাণ, আসন গ্রহণ রীতি, বলিদানের পশু নির্বাচন, বলিদান, নিহত পশুর ভাগ-বাঁটোয়ারা, যজ্ঞপ্রণেতাকে অর্থদান এবং এই প্রতিটি পর্যায়ে নির্দিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ ব্রাহ্মণে লিপিবদ্ধ।
● ব্রাহ্মণ সাহিত্য বলি বা উৎসর্গ অনুষ্ঠানের গোঁড়া দাবিতে পরিপূর্ণ, কল্পনাপ্রসূত প্রতীকবাদ (Fanciful Symbolism) এবং সীমাহীন কল্পনার জল্পনাতে (Speculation) পরিপূর্ণ। যখন প্রথম স্তব বা স্ত্রোত্রগুলি রচিত হয়েছিল তখন বলিদানের আনুষ্ঠানিকতা এত বিস্তারিত ব্যাপার ছিল না। কিন্তু যখন স্তবগুলির সংগ্রহ এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত করা হলো তখন আনুষ্ঠানিকতা ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি করে জটিল আকার ধারণ করল। বিভিন্ন বলিদানের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বিভিন্ন নির্দিষ্ট পুরোহিতদের স্বতন্ত্র শ্রেণির মধ্যে বণ্টন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। এটা ধরে নেওয়াই যেতে পারে যে, এটা ছিল এমন একটা সময় যখন বর্ণভেদ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। বলিদান ও তার আচারই সেই সময়ে ছিল একটি মাত্র বিষয় যাতে বুদ্ধিমান ও ধার্মিক মনগুলিকে জড়িয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। স্বাধীন অনুমানমূলক চিন্তা বলিদানের অনুষ্ঠানের কার্যধারার অধীনস্ত ছিল। এর ফলশ্রুতি ছিল চরম কল্পনাপ্রসূত ধর্মীয় ও প্রতীকী ব্যবস্থা, জ্ঞানবিদ্যা (Gnostics) ছাড়া এর কোনো তুলনা মেলে না। এটা বর্তমানে বিশ্বাস করা হয় যে, ব্রাহ্মণ পর্যায়কাল শেষ হলো ৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।
● আরণ্যক - ব্রাহ্মণের আরও বিকাশের ধারায় আরণ্যক-এর আবির্ভাব ঘটল। আরণ্যকের অর্থ হলো অরণ্য রচনাবলী। এই রচনাবলী সম্ভবত রচিত হয়েছিল বয়স্ক ও বৃদ্ধ মানুষদের জন্য, যারা অরণ্যে অবসর জীবনযাপন করত এবং যাদের পক্ষে অরণ্যে দুষ্প্রাপ্য এমন বহু জিনিসপত্র প্রয়োজন, এমন বিশদ বলি তথা উৎসর্গের অনুষ্ঠান করা সম্ভব ছিল না। এই ক্ষেত্রগুলিতে নির্দিষ্ট চিহ্নকেন্দ্রিক ধ্যানগুলিকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচনা করা হতো এবং এইগুলি ক্রমান্বয়ে উন্নততর রূপ হিসাবে বলি অনুষ্ঠানগুলিকে প্রতিস্থাপন করেছে। এখানে আমরা দেখতে পাই, একাংশ বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে আচার-প্রথার ধারণা ক্রমান্বয়ে পিছু হঠছে এবং সত্যর প্রকৃতি (Nature of truth) সম্পর্কে দার্শনিক অনুমান ক্রমান্বয়ে স্থান করে নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘বৃহদারণ্যক’-এর শুরুতেই আমরা দেখি, অশ্ব-বলিদানের প্রকৃত অনুষ্ঠানাদি (অশ্বমেধ যজ্ঞ)’র পরিবর্তে ঊষা (সূর্যোদয়ের সময়)-কে অশ্বর মাথা হিসাবে কল্পনা, সূর্যকে অশ্বর চোখ, বায়ু হলো অশ্বর জীবন সহ অন্যান্য বর্ণনা সহ ধ্যানের নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে। এটা একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অগ্রগতি যেখানে বলি অনুষ্ঠানের জটিলতার পরিবর্তে জল্পনা (Speculation) অথবা ধ্যান-এর বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়গত অনুমানের বিকাশ এবং তা সর্বোচ্চ মঙ্গলসাধন করতে সক্ষম - এই ধারণা ক্রমান্বয়ে বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের স্থান দখল করল। দার্শনিক ধ্যান ও আত্মজ্ঞানকে জীবনেব সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করল।
● সুতরাং আরণ্যক যুগ এমন একটি পর্যায় যখন মুক্তচিন্তা ক্রমান্বয়ে আচার অনুষ্ঠানের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার প্রয়াস গ্রহণ করছে, যে আচার অনুষ্ঠান দীর্ঘকাল মুক্ত চিন্তার সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। আরণ্যকই উপনিষদের পথ প্রস্তুত করল, দার্শনিক অনুমানের যে বীজ বেদের মধ্যে ছিল তাকে পুনরুজ্জীবিত করল এবং এর ফলে উপনিষদ সমস্ত দর্শনের উৎসে পরিণত হলো।
● ধর্মসূত্র - সাধারণ জনগণের মধ্যে আদর্শবাদ বা আদর্শের প্রচার শাসকশ্রেণির উদ্দেশ্য ছিল না। আসল উদ্দেশ্য ছিল, জনগণের মনের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা বা তাদের বশে রাখা এবং কোনরকম গুরুতর হুমকি ছাড়াই শ্রেণিশোষণ অব্যাহত রাখা। জনগণের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য কিছু সার্বজনীন আচরণবিধি চালু করার প্রয়োজন হয়। বেদ, উপনিষদ অধ্যয়ন ও চর্চা পুরোহিতশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধর্মসূত্র ও আচরণবিধি সমাজের সমস্ত শ্রেণি ও জনগণের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ধর্মসূত্রকে সেই সময়কালের সংবিধান বলা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মসূত্রকে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা বা অবাধ্যতা এমনকী মৃত্যুদণ্ডের মত গুরুতর শাস্তির কারণ হতে পারে। সেইজন্যই ধর্মসূত্রকে বৈদিক কর্তৃত্বের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। ধর্মসূত্রকে ‘স্মৃতি’ বলেও অভিহিত করা হয়। স্মৃতির অর্থ হলো, সমস্ত কিছু স্মরণে রাখতে হবে। কোনভাবেই ভুলে যাওয়া, উপেক্ষা করা বা লঙ্ঘন করা যাবে না। ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ ‘শ্রুতি’ বা বেদের নির্যাসকে ধারণ করে এই ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতির রচনা করা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, নারদ স্মৃতি, গৌতম স্মৃতি, মনুস্মৃতি এইগুলি হলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
● মনুস্মৃতি - একে মনুসংহিতাও বলা হয়। বেদের নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। মনুসংহিতা বা ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই হলো মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক সমাজে অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আনুমানিক প্রায় ১০০ খ্রিস্টাব্দে মনুস্মৃতি রচিত হয়। বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দুই হাজার সাত শত শ্লোকে সংবলিত এই গ্রন্থটি পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে যে শ্লোকগুলি উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসাবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোনো মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পরে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। বলা হয়, মনু অর্থাৎ প্রথম মানুষের সৃষ্টি, তাই মনুস্মৃতি।
● বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী শক্তি মনুস্মৃতির প্রতি গভীর আস্থা পোষণ করে ও শাসনকর্ম পরিচালনার প্রধান ভিত্তি মনে করে। ভারতীয় সংবিধানের পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদীরা পরম শ্রদ্ধায় মনুস্মৃতিকে সংবিধানের বিকল্প ঘোষণা করেছে। সেইজন্যই মনুস্মৃতি নিয়ে কিছুটা বিশদ আলোচনা জরুরি।
(ক্রমশ)