E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭

তৃণমূলের মতো বিজেপি-ও অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ


রাজ্যের প্রচারমাধ্যমগুলির এযাবৎকালের শিরোনামে তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তৃণমূলের উভয়গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়ে আসছে। রাজ্যবাসী এসবের সঙ্গে এখন যেমন পরিচিত, অতীতে তেমনই কংগ্রেস দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সংবাদপত্রের শিরোনাম দখল করে থাকত। বিগত শতাব্দীর ৭০ দশকে এই অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল ব্যাপকভাবে প্রকট হয়েছিল। কংগ্রেসের দাপুটে নেতা ও বিধায়ক নেপাল রায় প্রকাশ্য দিবালোকে কংগ্রেস কর্মীদের দ্বারা খুন হয়েছিলেন। অপর এক নেতা ও বিধায়ক চণ্ডীপদ মিত্রকে যুব কংগ্রেসীরা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। এইরকম অজস্র নজির আছে। বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস অতীতের কংগ্রেসের এই ঐতিহ্যকে(!) বহন করছে।

রাজ্যের এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতীয়স্তরের প্রচারমাধ্যম কংগ্রেসের বা বর্তমানে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি বিজেপি-কে একটি ঐক্যবদ্ধ দল হিসাবে জনমানসে হাজির করার চেষ্টা করে। বিজেপি একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টি, ধার্মিকদের দল ইত্যাদি প্রচার করে জনমত নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বা অতিঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা আরও একদম এগিয়ে শৃঙ্খলার মাপকাঠিতে বামপন্থী এবং বিজেপি-কে একাসনে বসানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ কখনো কখনো আবার বিজেপি-কে বামপন্থীদের থেকেও শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টির শিরোপা দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না।

সংবাদমাধ্যমের শংসাপত্র পাওয়া বিজেপি’র এই রাজ্যে বর্তমান হাল কী? রাজ্যনেতৃত্বের শীর্ষস্তর থেকে শুরু করে নিম্নস্তর পর্যন্ত মতানৈক্য, প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদান থেকে শুরু করে গোলাবারুদ নিয়ে মারামারি পর্যন্ত সবকিছুই রাজ্যপার্টি প্রত্যক্ষ করছে। বিজেপি আহুত দলীয় কনভেনশনে দলীয় পতাকা নিয়ে বিজেপি’র লোকজনই ভন্ডুল করে দিচ্ছে। চেয়ার টেবিল ভাঙছে। অপরপক্ষের নেতাদের কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করছে, এমনকি শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও বিজেপি’র অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পুলিশকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, এক গোষ্ঠীর নেতৃত্ব অপর গোষ্ঠীর লোকজনদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাস্তা অবরোধ, বন্‌ধ করে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এই প্রশ্নে বিজেপি তৃণমূলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

বিজেপি এরাজ্যে বিশাল শক্তিশালী দল নয় বা রাজ্যের শাসনক্ষমতার ধারে কাছেও নেই। বিগত লোকসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু আসন পাওয়ায় এরাজ্যের ভবিষ্যৎ শাসকদল হিসেবে নিজেদের ভাবতে শুরু করেছে। রাজ্যের কিছু কিছু সঙ্ঘ-বান্ধব প্রচারমাধ্যম এবং কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী তাদের মদত দিয়ে চলেছে, এর পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনে রাজ্যের জনগণের তিতিবিরক্ত মনোভাবকে তারা ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, একটি নেতিবাচক উপাদানও এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল রয়েছে। তৃতীয়ত, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সর্বভারতীয়স্তরে বিজেপি’র সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়াবাড়ি প্রভৃতির মাধ্যমে এই রাজ্যেই নিজেদের তৃণমূল কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের মাত্রা যত বৃদ্ধি পাবে, বিজেপি’র গণভিত্তি তত শক্তিশালী হবে, এটাই তাদের ধারণা।

আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের মারামারি সংঘর্ষের পিছনে আর্থিক দুর্নীতি, এলাকা দখল, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ প্রভৃতি রয়েছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ তৃণমূল কংগ্রেসের ছোটো মাঝারি বড়ো নেতারা আত্মসাৎ করেছে। বিজেপি’র নেতাদের ধারণা ক্ষমতাদখল করতে পারলে প্রচুর অর্থের অধিকারী হওয়া যাবে। বিভিন্ন গোষ্ঠী এখন তাই ক্ষমতায় আসার আগেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করছে। তাই বাড়ছে সংঘর্ষের সংখ্যাও।

সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে বেশ কিছু ব্যক্তি ক্ষমতা ও অর্থের লোভে বিজেপি-তে গিয়ে যোগদান করেছে। এদের মধ্যে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারা নতুন দলে গিয়ে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত হিসাবে জনগণের সামনে দেখাতে বিজেপি’র সাহায্য পাচ্ছে। কারণ এদের অনেকের বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করছে। এইসব তদন্তকারী সংস্থার রোষানল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে এখন তারা বিজেপি-কে মুক্তিদাতা বলে মনে করছে।

বিজেপি সম্পর্কে আরেকটি মিথ ছিল, বিজেপি’র নেতারা ক্ষমতালোভী নয়। তাও এখন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দলের সাংগঠনিক রদবদলে এই রাজ্যের প্রাক্তন বিজেপি সভাপতিকে তার সাংগঠনিক পদ সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছে। সেই জায়গায় বসানো হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে সদ্য পদত্যাগকারী এক ব্যক্তিকে। একে কেন্দ্র করে সদ্য অপসারিত সাধারণ সম্পাদক হুমকি দিয়েছেন। শুধু শীর্ষস্তরেই নয়, অন্যান্য স্তরেও নেতৃত্ব বদলকে কেন্দ্র করে মতানৈক্য রাজপথের সংঘর্ষে পরিণত হচ্ছে। এমনকি অর্থের বিনিময়ে সংগঠনের পদ কেনাবেচা হচ্ছে। এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে একথা স্পষ্ট করেই বলা চলে, বিজেপি আলাদা ধরনের পার্টি বলে যে মিথ বা কল্পকথা চালু করা হয়েছিল, তা এখন রসিকতায় পরিণত হয়েছে।

আসলে বিজেপি দেশের অন্য পাঁচটি বুর্জোয়া জমিদার দলের মতন একটি দল। এদের ক্ষেত্রে বড়ো বিপদ হলো, দলটি চরম দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত আরএসএস দ্বারা পরিচালিত। ফলে দেশের বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, যুক্তরাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে এক চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। সেই অর্থে এদের ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স’ বা অন্য ধরনের দল বলা যেতে পারে। আর সেই কারণেই এদের বিরুদ্ধে লড়াইও ভিন্নমাত্রায় হতে বাধ্য। এ লড়াই শুধু অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্তরেই নয়, মতাদর্শ, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাস্তরেও করতে হবে। এদের সম্পর্কে কিছু মানুষের ভুল ধারণা আছে, তাকে অতিক্রম করেই ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলা বর্তমান সময়ে একান্ত জরুরি।