৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭
জাত জালিয়াতির আড়ালে
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠিক কীভাবে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে! আমার আপনার আমাদের চারপাশে যা যা ঘটে চলেছে চিন্তা-বুদ্ধি-ভাবনা-দ্বন্দ্ব-দ্বিধা বোধ-কলম-কিবোর্ড তালগোল পাকিয়ে যেতে বাধ্য। যে দ্রুততার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পট বদল চলছে, তাতে মূল বিষয় খুঁজে বের করা অনেকটা সেই গেছোদাদা এখন ঠিক কোথায় আছেন সন্ধান পাওয়ার মতোই জটিল। রূপক হ-য-ব-র-ল পড়ে বেড়ে ওঠা মানুষের চোখের সামনে বাস্তবটাই এখন আস্ত এক হ-য-ব-র-ল। এর কোথায় মুড়ো, কোথায় পেটি, কোথায় ল্যাজা, ভেজে খাবেন, নাকি সরষে বাটা দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্ত। কোন্টা দেশীয় চক্রান্ত আর কোন্টা আন্তর্জাতিক তা নিয়ে আম আদমির দিনভর হাজারো খাবি খাওয়া। দিনের শেষে ঢেঁকুর তুলে বদহজম। মাথার চুল ছিঁড়েও যা থেকে নিষ্কৃতি নেই। মুক্তি নেই। তালেগোলে ছকে আটকে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে।
খুব বেশি পেছনে যাব না। মোটামুটি মার্চের শেষ দিক থেকে শুরু করা যেতে পারে। দাঁড়িপাল্লার একদিকে থাক করোনা সংক্রমণ, সরকারি ব্যর্থতা, লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিক, মানুষের রুজি হারানো, বেকার হয়ে যাওয়া, একমুঠো খাবারের জন্য লড়াই। অন্যদিকে থাকবে মধ্যপ্রদেশে বিধায়ক কেনা-বেচা করে সরকার বদল, রাজস্থানে সরকার বদলের চেষ্টা, মহারাষ্ট্রে সরকার বদলের চেষ্টা। করোনা মোকাবিলায় সরকারি নিস্ক্রিয়তা, তবলিগি জামাতের করোনা যোগ, কিছু কর্পোরেটের লাগাম ছাড়া মুনাফা বৃদ্ধি, বেশ কিছু মানুষের বিলিওনেয়ার হয়ে যাওয়া। চুপচাপ শ্রমআইন লঘু করে দেওয়া, কাজের সময় সীমা বাড়ানোর চেষ্টা, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি, বেশ কিছু ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির ঋণ মকুব, বিতর্কিত কৃষি বিল। আরও অনেক কিছু আছে। আর দাঁড়িপাল্লার দু’টো পাল্লা ভর্তি হয়ে যাবার পর ফাউ হিসেবে আছে চীনের আগ্রাসন, রাম মন্দিরের শিলান্যাস, বাবরি ধ্বংস মামলার রায়, চীনা অ্যাপ ব্যান ইত্যাদি। এতেও যদি মন না ভরে থাকে তাহলে বাকি মনোরঞ্জনের জন্য সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা, রিয়া চক্রবর্তীর জেল, কঙ্গনা রানাওয়াত, বলিউডে ড্রাগ। আর আছে হাথরস- টাথরসের মতো গোটাকয়েক ধর্ষণ! হাতে গরম উপাদানে ভর্তি মনোজগত। কোন্টা নিয়ে ভাববেন তা ভেবে ঠিক করাই বিষম ভাবনার বিষয়।
তবুও তো ভাবতে হবে। নিতান্তই ভাবতে না পারলে একটু একটু করে ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। একসময় মুসোলিনি, হিটলাররাও মানুষকে ভাবতে বাধ্য করতো যে, তাদের ভাবনাই মানুষের ভাবনা। তাদের কথাই শেষ কথা। প্রবল সেই ভাবনা বিরোধী ভাবনা মানুষ চুপি চুপি ভেবেছিলো, প্রকাশ্যে ভেবেছিলো, ভাবতে পেরেছিলো বলেই তো আজ তাদের স্থান আবর্জনায়। ইতিহাস তাদের কুখ্যাত বলেই মনে রেখেছে। হয়তো বর্তমান বর্তমানকেও ভবিষ্যৎ সেভাবেই মনে রাখবে। তাই আপাতত বোধহয় ভাবা প্র্যাকটিস করাতেই বেশি জোর দেওয়া দরকার।
গ্রামের নামটা বেশ সুন্দর। চাঁদপা। প্রায় ৬০০ পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। ঠাকুর আর ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত। যার অর্ধেকের বেশি ঠাকুর, কিছু ব্রাহ্মণ এবং গোটা ১৫ ঘর দলিত। এক নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদন অনুসারে, যে গ্রামে দলিতরা দোকানে গিয়ে টাকা দিলে সেই টাকায় জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। যে গ্রামে দোকানে গিয়ে কোনো দলিত কোনো বিস্কুটের প্যাকেটে হাত দিলে সেই বিস্কুট ফেরত হয়না। ওই দলিতকে সেই বিস্কুট কিনতে বাধ্য করা হয়। কারণ দলিতের ছোঁয়ায় বিস্কুট অশুদ্ধ হয়ে যায়। আত্মনির্ভর হবার দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলা, আচ্ছে দিনের ভারতে, রামরাজ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলা উত্তরপ্রদেশের হাথরসের এই গ্রামেই ১৯ বছরের দলিত মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে।
রাজবীর সিং দিলের-এর নাম আমরা অনেকেই জানিনা। জানা সম্ভবও নয়। ৫৪২ সংসদীয় কেন্দ্রের মধ্যে তিনি কোন্ কেন্দ্রের সাংসদ তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবু বলি। যে পাঁচ বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে হাথরস লোকসভা কেন্দ্র তার মধ্যে ইগলাস (সংরক্ষিত) বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এই রাজবীর সিং দিলের ২০১৭ সালে বিজেপি বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে তিনি হাথরস কেন্দ্র থেকে বিজেপি’র মনোনয়নে সাংসদ হবার পর এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আরএসএস ঘনিষ্ঠ রাজ কুমার সহযোগী। সে যাই হোক। ২০১৭-তে ফিরি।
রাজবীর সিং দিলের, যিনি বিজেপি’র দলিত প্রার্থী, তিনি যখন উচ্চবর্ণের বাড়িতে প্রচারে যেতেন তাঁকে মাটিতে বসতে হতো। চা পানের জন্য তিনি নিজের সঙ্গে সবসময় একটা স্টিলের গ্লাস রাখতেন। কারণ, জাঠ অধ্যুষিত ইগলাসে উচ্চবর্ণের কোনো বাড়িতে দলিতের জন্য চায়ের কাপ বরাদ্দ নেই। এমনকি প্রচারে বেরিয়ে তাঁকে তার থেকে বয়সে অনেক ছোটো জাঠ গ্রাম প্রধানের পা ছুঁয়ে ভোট প্রার্থনা করতে হতো। এটা আমার কথা নয়। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭-র টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে এরকমই লেখা আছে। হ্যাঁ। রাজবীর সিং দিলেরও একজন বাল্মীকি জাতের মানুষ। যে বাল্মীকি জাতের ১৯ বছরের মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে চাঁদপা গ্রামে। মানুষের জাত থাকলেও, যৌনাঙ্গের নিশ্চয়ই জাত থাকেনা। তাই যে দলিতের ছোঁয়া লাগলে জল ছিটিয়ে শুদ্ধ হতে হয়, সেই দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করা যায় অনায়াসেই। তখন বোধহয় স্পর্শদোষ কাজ করেনা।
এ তো গেল দলিতদের কথা। এবার একটু উচ্চবর্ণের কথাও শুনে নিতে হবে তো। বারাবাঁকির বিজেপি নেতা রঞ্জিত বাহাদুর শ্রীবাস্তব। এই ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “এঁদের মৃতদেহ আখ, ভুট্টা, বাজরা খেত, নর্দমা বা জঙ্গলেই পাওয়া যায়। ধান বা গমের খেতে এদের দেহ মেলে না কেন? এঁদের মরার জায়গা ওটাই।’’ প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক রাজবীর সিং পেহেলবান-এর বাড়িতেই এই ধর্ষণের ঘটনায় ধৃত চার উচ্চবর্ণের যুবকের সমর্থনে সভা বসে। যার বক্তব্য অনুসারে, এখানে কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো ধর্ষণ হয়নি। বালিয়ার বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র সিং জানিয়েছেন - “একজন বিধায়কের পাশাপাশি আমি একজন শিক্ষক। ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো কেবল সংস্কার দিয়ে বন্ধ করা যাবে, সুশাসন বা অস্ত্র দিয়ে নয়।’’ ওই গ্রামের কিছু ঠাকুর সন্তানদের হুমকির ভিডিয়ো তো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিষয়টিতে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক চক্রান্তের গন্ধ পেয়েছেন। যদিও রাতের অন্ধকারে পরিবারের বিনা অনুমতিতে কার নির্দেশে মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হলো সে প্রশ্নের উত্তর পাঁচ পুলিশকর্মী সাসপেন্ড হবার পরেও পাওয়া যায়নি।
উত্তরপ্রদেশের মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশই দলিত। প্রায় সবটাই হিন্দুও বটে। যার মধ্যে আছে জাঠভ-চামার, পাসি, ধোবি, কোরি, বাল্মীকি, খটিক ইত্যাদি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪১ ধারা অনুযায়ী ২৬.১০.২০১৭-র পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে মোট ১,২৮৪ টি চিহ্নিত তপশিলি জাতি আছে। সবথেকে বেশি কর্ণাটকে। ১০১টি। ওডিশায় ৯৫টি। তামিলনাড়ুতে ৭৬। কেরালায় ৬৯। উত্তরপ্রদেশে ৬৬। উত্তরাখণ্ডে ৬৫। অন্ধ্রপ্রদেশে ৬১। পশ্চিমবঙ্গে ৬০। ২০১৬ সালের হিসেব অনুসারে উত্তরপ্রদেশে ৬-১০ বছর বয়সী তপশিলি জাতির মহিলা সংখ্যা ২৮,৪৮,৮৮৩। ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সী মহিলা সংখ্যা ১৪,১৫,৯৭৪। ১৪-১৫ বছর বয়সী ৯,৭৯,১২৮। ১৬-১৭ বছর বয়সী ৮,২৮,৮১২। ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী ১৯,৮২,৬৮৪। এঁদের মধ্যে বাল্মীকি জনসংখ্যা ১৩,১৯,২৪১। যার মধ্যে মহিলা ৬,২৯,১০১। শুধুমাত্র মহিলাদের সংখ্যাগুলো ইচ্ছে করেই বললাম। ২০১১ সালের জনগণনার হিসেব মতো উত্তরপ্রদেশের ৯,৯৫১ টি গ্রামে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি তপশিলি জাতির মানুষ বাস করেন। ১৭,৪২৯ গ্রামে বাস করেন ৪০ শতাংশ বা তার বেশি তপশিলি জাতির মানুষ। হাঁড়ির একটা চাল টিপেই তো মা মাসিমারা ভাত হয়েছে কিনা বুঝতে পারেন। ঠিক তেমনই একটা হাথরস, উত্তরপ্রদেশ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশে দলিতদের অবস্থাটা ঠিক কীরকম তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। খতরে মে হিন্দু? নাকি খতরে মে দলিত? নাকি খতরে মে শ্রমজীবী মানুষ? সে বড়ো জটিল প্রশ্ন।
একদিকে যখন হাথরসের নৃশংস ধর্ষণের ঘটনায় রাজ্যে রাজ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হচ্ছে, বিদেশে প্রতিবাদ হচ্ছে তখনই এই ঘটনাকে উচ্চবর্ণ বনাম দলিত সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। আর এই সময়েই দেশের অন্য প্রান্তে পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ একাধিক রাজ্যে তুলকালাম বিক্ষোভ চলছে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন কৃষক সংগঠন সহ একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দল এই প্রতিবাদের অংশীদার। রেল লাইনের ওপর বসে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চালাচ্ছেন কৃষকরা। যার জেরে বাতিল করে দিতে হয়েছে বহু ট্রেন। মোট ৩১টি কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে শামিল। ১ অক্টোবর থেকেই রেললাইন আটকে ধাবলান (পাতিয়ালা), সুনাম (সাঙ্গরুর), বুদ্ধলাদা (মনসা), গিদ্দেরবাহা (মুক্তসার), বর্নালা, ভাটিন্ডা, ফরিদকোট, গুরুদাসপুর, রূপনগর, ফিল্লোর, সামরালা এবং মোগাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চলছে। প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। শুধু পাঞ্জাবেই ৩৩ জায়গায় রেললাইনে অবরোধের পাশাপাশি কৃষকরা ২৪ জায়গায় পেট্রোল পাম্পের বাইরে, ৯টি টোল প্লাজার উপরে, ৪ টি শপিং মল, একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প ও একটি খাদ্যশস্যের গুদাম ছাড়াও বেশ কিছু কর্পোরেট অফিসের বাইরে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। বিক্ষোভ চলছে বেশ কিছু বিজেপি নেতার বাড়ির বাইরে। মিডিয়ার একটা বড়ো অংশ অবশ্য ‘নেশন ওয়ান্টস টু নো’ বলে চিল্লাতেই ব্যস্ত। মিডিয়ার ‘এন্টারটেনমেন্ট সেকশন’টা খুব ‘পপুলার’ তো। তাই টিআরপি রাখতে ওটুকু করতেই হয়। তা বেশ।
আলোচনার ঠিক এই জায়গায় এসেই বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের রাধারাণী মাহেশের মেলায় হারিয়ে যান। এবং একবার না। বারবার। আপনি যতই জানুন না কেন যে কপালকুণ্ডলা মাহেশের মেলায় হারিয়ে যাননি। ওটা রাধারাণী উপন্যাস। তবুও সেটা নিয়ে যতক্ষণ ভাববেন, সমালোচনা করবেন, ততক্ষণে হয়তো তার থেকে ঢের বড়ো একটা বিষয় চোখ এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে। একটা গুরু আলোচনাকে লঘু করতে আমি চাইছি না। তবু এ প্রসঙ্গ টানলাম কারণ, মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এক পরিচিত ছক। অতীত, বর্তমান, কেন্দ্র, রাজ্য - কোনোখানেই ব্যতিক্রম নেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে চাঁদপা - কতটুকুই বা দূরত্ব। একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ‘সাজানো ঘটনা’, ‘ছোটো ঘটনা’য় রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নেবার কথা নয়। তবু এ প্রসঙ্গও বাদ দিলাম। থাক।
কিন্তু বিষয়টা শেষমেষ দাঁড়ালো কী? কাস্ট পলিটিক্স নাকি ক্লাস পলিটিক্স? হাথরস কাণ্ড নাকি কৃষি বিল বিরোধী আন্দোলন। দ্বন্দ্ব আছে বা নেই। সত্যি বলছি এত গুরুগম্ভীর বিষয়ে মতামত দেওয়া সহজ নয়। তবে আলোচনাটা যখন ভারত কেন্দ্রিক তখন ভারতের বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে আলোচনা করা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। ১৯৯৭ সালে পি সুন্দরাইয়া স্মারক বক্তৃতায় সীতারাম ইয়েচুরি এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন - শ্রেণি বনাম বর্ণ - এই জাতীয় ভ্রান্ত ধারণাকে দূরে সরানো দরকার। কেউ কেউ বলে থাকেন কমিউনিস্টরা যেহেতু সমাজে শ্রেণি বিভাগে বিশ্বাস করে তাই তাদের বর্ণের দিকে নজর দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু শ্রেণি এবং বর্ণের মধ্যে এই ধরনের যান্ত্রিক বিভাজন শুধু যে অমার্জিত ভাবনা তাই নয়, তা আমাদের ভারতীয় বাস্তব পরিস্থিতি থেকেও বহু দূর। আমাদের দেশের বর্ণ স্তর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। বহু বছর ধরে বর্ণ ও বর্ণের মধ্যে সমস্ত সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা সত্ত্বেও, দলিত বা পিছিয়ে পড়া বর্ণের উপর নিপীড়নের বিষয়ে মূল কাঠামোটি এখনও অব্যাহত। এই সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে দিয়েই ভারতে শ্রেণিবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।... সুতরাং প্রশ্নটি কোনও শ্রেণি বনাম বর্ণের নয়। আমাদের সমাজে সর্বাধিক শোষিত শ্রেণিই অনেকাংশে সর্বাধিক সামাজিক নিপীড়িত এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই শ্রেণি-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একে অপরের পরিপূরক।
লেখার একদম শুরুতে ভেবেছিলাম কীভাবে লেখাটা শুরু করবো। লিখতে লিখতে বিষয়টা এমনই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, এখন ভাবছি কীভাবে শেষ করবো। উপসংহার টানাটা কিছুটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শেষ করি। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সমাজ’ গ্রন্থের ‘সমুদ্রযাত্রা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন - ‘আমরা কি নিজের কর্তব্যবুদ্ধির বলে মাথা তুলিয়া বলিতে পারিনা - পূর্বে কী ছিল এবং এখন কী আছে তাহা জানিতে চাহি না, সমাজের যাহা দোষ তাহা দূর করিব, যাহা মঙ্গল তাহা আবাহন করিয়া আনিব।...’