৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭
মসজিদ ধ্বংসের ফৌজদারি তথ্যপ্রমাণ উপেক্ষিত হয়েছে
গৌতম রায়
বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দ্বিতীয় পর্বের ৭৮৭নং অনুচ্ছেদে ’৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেখানে নামাজ পড়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে, সেই মসজিদ স্থানান্তরের হুকুম ’৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরকালে সংখ্যালঘুদের প্রচলিত আইনরক্ষার স্বীকৃতির বিরোধী।
নয়ের দশকে ‘জনমোর্চা’ বলে ফৈজাবাদ থেকে একটা স্থানীয় হিন্দি কাগজ বের হতো। ’৯৩ সালের ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি এক নাগরিক প্রতিনিধিদল অযোধ্যা ঘোরেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ সংগ্রহে। তাঁদের পাওয়া তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল ‘জনমোর্চা’তে। সেই বিবরণ এই মামলাতে দাখিল করা হলেও আদালত সেটিকে গ্রাহ্যই করে নি।
লক্ষ্মৌয়ের স্থানীয় পত্রিকা ‘জনমোর্চা’র সাংবাদিক সুমন গুপ্তের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, সাংবাদিকদের জন্যে গোলাপী রঙের বিশেষ কাপড় বিতরণের পরেই দস্যুরা মসজিদে চড়াও হতে শুরু করে।রামকথাকুঞ্জ থেকে একটা চাতালের উপরে চড়েন অশোক সিংঘল। করসেবকরা মসজিদটি ভাঙার কাজ শুরু করতেই অশোক সিংঘল সেই চাতাল বেয়ে চলে আসেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনের উপর ভিত্তি করেই দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনকে অমান্য মানে, সংবিধানকেও অমান্য।
সংখ্যালঘুর প্রচলিত আইন, তাঁদের ব্যক্তিগত আইনের পর্যায়টিও অন্তর্ভুক্ত। সেখানে শরিয়তের বিধিবিধানকে স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। কোরান, হাদিস, শরিয়ত কোথাও মসজিদ স্থানান্তরের সংস্থান নেই। সংবিধান বিরোধী এই রায় সংবিধান ধ্বংসের একটি পদক্ষেপ।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির যে ষড়যন্ত্র, সেটি কোনো তাৎক্ষণিক বিষয়ই নয়। লক্ষ্মৌয়ের নিম্ন আদালত মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাতে কোনো ষড়যন্ত্র, পূর্বপরিকল্পনা না পেলেও, সেই মামলাতেই মসজিদ ধ্বংসের গোটা কার্যক্রমটি অনুসন্ধানে গঠিত লিবেরহান কমিশনের যে প্রতিবেদন জমা পড়ে, সেখানেই গোটা বিষয়টিতে যে দীর্ঘ পরিকল্পনা আর ষড়যন্ত্র ছিল, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
লিবেরহান কমিশনের প্রতিবেদনে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রায় শেষ পর্বে (’৮৪ সালের জুন মাসে) ‘রামজন্মভূমি মুক্তি যোজনা সমিতি’ এবং ‘ধর্মস্থান মুক্তি যোজনা সমিতি’ গঠনের বিষয়টিকে সাম্প্রতিক অতীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের সূতিকাগার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনের ২৪.৬ অনুচ্ছেদে ’৮৪ সালের জুন মাসে দিগম্বর আখড়াতে এই সংগঠন তৈরির বিষয়টিকে মসজিদ ধ্বংসের সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্রের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করে বাবরি মসজিদ ধ্বংসেই যে ক্ষান্ত হবে না হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির, সেই ষড়যন্ত্র বিষয়েও দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। ‘ধর্মস্থান মুক্তি যোজনা সমিতি’ গঠনের যে প্রেক্ষিত বলা হয়েছে, সেখানেই রয়েছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কাশী, মথুরা ইত্যাদিতে মসজিদের উপর হামলা, ধ্বংস ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টি। ইতিমধ্যেই কাশীর জ্ঞানব্যাপী মসজিদ ঘিরে সঙ্ঘ-বিজেপি’র ষড়যন্ত্রের কথা আমাদের সামনে এসেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর (২০২০) লক্ষ্মৌয়ের নিম্ন আদালত যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলাটির রায় দেয়, তখনই সুপ্রিম কোর্টে মথুরার একটি মসজিদ ঘিরে মামলার শুনানি চলছিল। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তিকে করায়ত্ত করে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশের অন্যত্র মসজিদ ধ্বংসের তাণ্ডবে যে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির মানুষের মাথা নিয়ে পৈশাচিক গেণ্ডুয়া খেলার মতো বীভৎসতায় মেতে উঠবে, এই পরিকল্পনা তাদের আটের দশকের সূচনা থেকেই আছে। সেই ষড়যন্ত্রের কথা লিবেরহান কমিশন খুব স্পষ্ট ভাষাতে বললেও, সেটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে লক্ষ্মৌয়ের নিম্ন আদালত।
ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরে, গোটা ভারত যখন শোকে মুহ্যমান, সেই সময়টিকেই যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের সব থেকে উপযোগী সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিল, লিবেরহান কমিশন তাঁদের প্রতিবেদনের ২৪.১০ অনুচ্ছেদে তা স্পষ্টভাবে বলেছে।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর, লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া যখন চলছে, ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিগম্বর আখড়াতে ইন্দিরার জীবদ্দশায় যে ‘রাম জন্মভূমি মুক্তি যোজনা সমিতি’ তৈরি হয়েছিল, সেটি এবং আরএসএস’র শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে স্থির হয় যে, সেই বছরেরই ২০ মার্চের ভিতরে ৫০ লক্ষ ক্যাডার বিশিষ্ট ‘রাম ভক্ত’ নামক একটি আধ্যাত্মিক (এই ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দটি ভিএইচপি’র কার্যবিবরণীতে আছে। স্বাভাবিকভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষ আধ্যাত্মিকতা বলতে যা বোঝেন, হিন্দুত্ববাদীদের ব্যবহৃত শব্দ কিন্তু সেই অর্থ নির্দেশ করে না) গোষ্ঠী তৈরি করা হবে।
এই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ’৮৬ সালের ৮ মার্চের ভিতরে যে কোনো উপায়েই হোক, অযোধ্যায় বিতর্কিত জমির তালা খোলাতেই হবে। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, প্রশাসন যদি ভালোভাবে তালা খুলে না দেয়, তাহলে ‘সন্ত’রা বলপূর্বক তালা খুলবে। এই সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে স্বঘোষিত ‘পরমহংস’ রামচন্দ্র দাস আত্মাহুতি দেবেন ’৮৫ সালের ১৮ এপ্রিল, যদি না প্রশাসন সে বছর রামনবমীর আগে তালা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই রামচন্দ্র দাস অবশ্য তারপরেও বহুবার আত্মাহুতির হুমকি দিয়ে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ চড়িয়েছেন। যদিও ওই ধরনের কোনো কাজ বাস্তবে কখনোই করেন নি। রাজীব গান্ধী পরবর্তীতে আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে যে ভয়ঙ্কর জটিলতা তৈরি করেছিলেন, তার পিছনে কি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং স্বঘোষিত ‘পরমহংস’ রামচন্দ্র দাসের হুমকির সাথে আপসের কোনো মানসিকতা কাজ করেছিল? রামজন্মভূমি মুক্তি যোজনা সমিতি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এই যৌথ ষড়যন্ত্রের কথা বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত হলেও, এইসব কোনো বিষয়ই নিম্ন আদালতের বিবেচনায় ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য হয় নি!
ভি পি সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে লালকৃষ্ণ আডবানির তথাকথিত রথযাত্রা বহুল আলোচিত। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ’৮৫ সালের ২৩ অক্টোবর হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকে প্রসারিত করতে ‘রাম জানকী রথযাত্রা’র আয়োজন করেছিল।ইন্দিরার জীবদ্দশার একদম শেষপ্রান্তে যে ‘ধর্মসংসদ’ বাবরি ধ্বংসের অভিপ্রায়ে হয়েছিল, সেটিরই পুনরাভিনয় (দ্বিতীয় ধর্মসংসদ) হয় ’৮৫ সালে। পাঠক মনে রাখবেন, ইন্দিরা হত্যাজনিত পরিস্থিতিতে সেবার লোকসভার ভোট হয়। সেই ভোটে ইন্দিরা আবেগে স্বাধীনতার পরবর্তীকালের যাবতীয় রেকর্ড ম্লান করে দিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে। বিজেপি লোকসভায় মাত্র ২টি আসন পায়। ভোট রাজনীতিতে বিজেপি সেদিন সাফল্য না পেলেও আরএসএস’র সামাজিক প্রযুক্তির দৌলতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে তারা গোটা গো-বলয়ে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করছিল। এই শক্তিবৃদ্ধির তাগিদে যে সঙ্ঘ পরিবারের সামাজিক প্রযুক্তি, সেটাও সার্বিকভাবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রেরই একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
এই বিষয় দু’টিও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফৌজদারি মামলায় তথ্যপ্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, মহামান্য আদালতের কাছে এগুলির কিছুই ফৌজদারি অপরাধ বলে মনে হয় নি, মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র তো নয়ই।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে একদা সরসঙ্ঘচালক (তখন নন, পরবর্তীতে)কে এস সুদর্শন, রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা লিবেরহান কমিশনে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ উল্লিখিত হয়েছে (২৪.১৪)। তথাকথিত ‘সন্ত’দের মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে যুক্ত করবার কাজে এইসময় থেকেই একদম আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছিলেন সুদর্শন। এই সন্তদের মসজিদ ভাঙার কাজে সবরকমের সহযোগিতা করা হবে, এই প্রতিশ্রুতি আরএসএস তাদের শীর্ষ কমিটির কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। লিবেরহান কমিশন সেই কার্যবিবরণী তাদের প্রতিবেদনে দাখিল করে, এবং সেটি আদালতে পেশও করা হয়েছিল। তবে আদালতের কাছে এসব কোনো ষড়যন্ত্র অপরাধ বলেই গ্রাহ্য হয় নি।
বাবরি মসজিদকে কখনো মসজিদ বলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা স্বীকার করেনি, যদিও মসজিদটির জমি সংক্রান্ত বিবাদের মামলাতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে, ’৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে নামাজ হয়েছে। হিন্দিতে বিতর্কিত সৌধকে ‘ধাঁচা’ বলে। বাবরি মসজিদকে কৌশলগত কারণেই চিরদিন সঙ্ঘ-বিজেপি শিবির ধাঁচা বলে এসেছে।
রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বালা সাহেব দেওরস সঙ্ঘপ্রধান থাকাকালীন মসজিদ ধ্বংসের যাবতীয় ষড়যন্ত্র প্রধানভাবে পরিচালনা করেছিলেন কে এস সুদর্শন। এই সময়ে মসজিদের তালা খুলে, সেটিকে উন্মুক্ত করার জন্যে যে সময়সীমা হিন্দুত্ববাদী শিবির ধার্য করে দিয়েছিল, সেই গোটা প্রক্রিয়াটিকে সমর্থন করে প্রস্তাব আরএসএস নেয়। কেবল সমর্থনই নয়। প্রক্রিয়াটিকে সফল করতে কার্যকর সহযোগিতাও যে সঙ্ঘ করবে, সেই মর্মে প্রস্তাবও তারা নিয়েছিল। এই সমর্থন এবং সক্রিয় সহযোগিতার পাশাপাশি যাবতীয় হিন্দু সংগঠন এবং হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মানুষ যাতে মসজিদ উন্মুক্ত করার তথাকথিত কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে, সে জন্যে পৃথকভাবে কে এস সুদর্শন এবং স্বঘোষিত ‘পরমহংস’ রামচন্দ্র দাস পৃথকভাবে বিবৃতিও দিয়েছিল। সেই বিবৃতিগুলি লিবেরহান কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে মামলাতে অন্তর্ভুক্ত হলেও, সেসব কোনো ষড়যন্ত্র বলেই মাননীয় বিচারকের কাছে প্রতিপাদ্য হয়নি।
আরএসএস’র শাখা সংগঠন, ‘অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা’ লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ঃ আদালতের রায়েই রামজন্মভূমির গোটা কমপ্লেক্স, যেটা সরকার তালাবন্ধ করে রেখেছে, সেটা উন্মোচিত হবে (তখনও কিন্তু আদালতের কোনো রায় আসেনি। তাহলে আদালতের সিদ্ধান্ত তালা খোলার পক্ষে আসবে, এটা আগাম কী করে জানল এবং সেই জানাকে কিভাবে নিজেদের কার্যবিবরণীর অন্তর্ভুক্ত করল ‘অখিল ভারতীয় প্রতিনিধিসভা’)। রামজন্মভূমি ঘিরে যেসব নিষেধাজ্ঞা আছে, সে সবই উঠে যাবে। যদিও মন্দির নির্মাণের কাজ এখনো অসম্পূর্ণ, তবুও পুরোমাত্রায় পূজার্চনার কাজও শুরু হয়ে যাবে। স্বাধীন দাবি উঠেছে যে, রামজন্মভূমির গোটা চত্বরের ভিতরে যেসব বিদেশি নিদর্শন আছে, সেই সমস্ত নিদর্শনগুলিকেই মন্দির চত্বরের বাইরে নিক্ষেপ করতে হবে। সেই দাবি অনুযায়ীই সমস্ত কিছু হবে। এভাবে গোটা রামজন্মভূমিকে পরিষ্কার এবং পবিত্র করে তোলা হবে। প্রাচীন রামজন্মভূমি মন্দির, যেটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, তার অতীত ঐতিহ্য এভাবেই পুনরুদ্ধার করা হবে। তবেই শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে রাষ্ট্রের যে ক্রন্দন, তার প্রতি সঠিক মর্যাদা দেখানো হবে।
অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা, আরএসএস’র এই শাখা সংগঠনটির কার্যবিবরণীর উদ্ধৃত অংশটি আদালতে পেশ করা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কার্যবিবরণীতে মহামান্য আদালত ন্যূনতম ষড়যন্ত্র দেখতে পাননি। ফলে যাবতীয় অভিযুক্তেরা বেকসুর খালাস পান।
রাজীবের প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই ’৮৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তথাকথিত সন্তদের একটি সন্মেলন হয় লক্ষ্ণৌতে। সেই সম্মেলনে ’৮৬-র ৮ মার্চের ভিতর অযোধ্যার বিতর্কিত সৌধের তালা খোলানোর জন্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদি না নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালা খুলে দেওয়া হয়, তাহলে তালা ভেঙে সৌধে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গোটা সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পনা মাফিক ’৯৬ সালের ২১ জানুয়ারি জনৈক উমেশচন্দ্র পান্ডে অযোধ্যার মুনসেফ কোর্টে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার আবেদন জানান। ’৪৯ সালের ১৬ জানুয়ারি যখন মসজিদের দরজা ভেঙে সঙ্ঘকর্মীরা ধাতু মূর্তি রেখে আসে, তারপর সেটিকে অপসারিত করবার জন্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর মূলত তাঁরই উদ্যোগে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে তালা দেওয়া হয়েছিল।
অযোধ্যার বিভিন্ন আদালতে, লক্ষ্ণৌ হাইকোর্টে বাবরি মসজিদ ঘিরে বহু মামলা চললেও, ওই উমেশচন্দ্র পান্ডে কোনো মামলার সাথেই জড়িত ছিলেন না। তাই মসজিদের তালা খোলা সংক্রান্ত তাঁর আবেদনটি কিভাবে মুন্সেফ কোর্ট গ্রহণ করল সেটা ঘিরে আইনজ্ঞ মহলের সংশয় আছে। ২১ জানুয়ারি, ’৮৬, পান্ডে আবেদন করেন, আর কোর্ট শুনানির দিন ধার্য করে তার মাত্র কয়েকদিন পর ১ ফেব্রুয়ারি। আশ্চর্যের বিষয় এই আবেদনে সাড়া দিয়ে মুনসেফ কোর্টের বিচারপতি কোর্টরুমে এক হনুমানের আসার গল্পের অবতারণা করেন। সেদিন কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের নারায়ণ দত্ত তেওয়ারি। মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে সেদিন না উত্তরপ্রদেশের সরকার, না কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। জ্যোতি বসুসহ বামপন্থীরা সেদিনের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিম্ন আদালতের রায়ের ভিত্তিতে বাবরি মসজিদের তালা না খুলতেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিম্ন আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যথাযথভাবে আপিলের পরামর্শ দিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবুর সেদিন প্রধান যুক্তিই ছিল, নিম্ন আদালতে আবেদনকারী উমেশচন্দ্র পান্ডে যেহেতু বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত কোনো মামলার সঙ্গে যুক্ত নন, তাই মসজিদের তালা খুলে দেওয়া নিয়ে পান্ডের আবেদন নিম্ন আদালতের বিবেচনাতেই আসতে পারে না। বলা বাহুল্য, রাজীব গান্ধী সেদিন কর্ণপাত করেননি জ্যোতিবাবু’র পরামর্শে।