৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭
জিনিসের দাম লাগামছাড়া মোদী-মমতা নির্বিকার
সুপ্রতীপ রায়
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যাগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি। খাদ্যশস্যসহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলির দাম বেড়ে চলেছে। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। গরিব মানুষদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন। এককথায় বলা যেতে পারে গরিব, নিম্নবিত্ত সহ আমজনতার এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি সমস্যা লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি।
মূলধারার মিডিয়াতে মূল্যবৃদ্ধির কারণ ও সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা হয় না। প্রকল্পের পর প্রকল্প, প্যাকেজ ঘোষিত হয়। কিন্তু জিনিসের দাম কমে না। দেশের অর্থনীতিতে সঙ্কট বাড়ছে। মোদী সরকার যে কর্পোরেটমুখী আর্থিকনীতি অনুসরণ করছেন তাতে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যাবে না বরং আর্থিক সঙ্কট বাড়বে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে। আমাদের রাজ্যের শাসক তৃণমূল জনবিরোধী আর্থিকনীতি নিয়ে চলেছে। এককথায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও খাদ্যপণ্যের দামবৃদ্ধির জন্য দায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতি।
মানুষের প্রকৃত আয় যদি বৃদ্ধি করা যেত তাহলে মূল্যবৃদ্ধিজনিত সমস্যা মানুষকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করত না। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় কমে চলেছে। ফলে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষকে বিপদে ফেলেছে। মানুষের প্রকৃত আয় না বাড়লেও টাকার দাম কমেছে। সরকার যাই বলুক মুদ্রাস্ফীতি তথা টাকার অবমূল্যায়নের নিরিখে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। এটাও ঠিক মানুষের প্রকৃত আয় বাড়লে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটবে।
পুঁজিবাদীব্যবস্থায় জিনিসের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পুঁজিবাদীব্যবস্থায় উৎপাদনব্যবস্থা পরিচালিত হয় মালিকের মুনাফার স্বার্থে। এই ব্যবস্থায় সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে কিছু থাকে না। পুঁজির মালিকের লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ। এই কারণে শ্রমিককে সর্বনিম্ন মজুরি প্রদান করা হয় এবং উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়। পুঁজিবাদীব্যবস্থাতে আমজনতার আয় বাড়ে না এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে। এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হলো নিম্ন মজুরি প্রদান ও পণ্য-পরিষেবার দাম বৃদ্ধি।
দামবৃদ্ধির ফলে লাভবান হচ্ছে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। মোদীসরকার ও বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থাগুলির মধ্যে অশুভ আঁতাত আছে। খাদ্যশস্যের দাম বাড়লেও যাঁরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন তাঁদের সঙ্কট কমেনা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকার ও কর্পোরেটদের চক্রান্তের ফলে মজুতদারি ও পণ্যবাজারে ফাটকাবাজি বাড়ছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি দ্রব্যমূল্য বাড়াচ্ছে। এই অর্থনীতি সরকারের ভূমিকাকে লঘু করে দিয়েছে। সরকারি বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে পুঁজির স্বার্থে মুক্তবাজারের নিয়মে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করার পথে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকবে না। সরকারি ভরতুকির প্রায় সবটা প্রত্যাহার করার অভিযান চলছে। বাজারের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হচ্ছে।
১৯৯১ সাল থেকে নয়া-উদার অর্থনীতি রূপায়ণের কাজ চলছে। এটির সমর্থক কংগ্রেস, বিজেপি উভয়েই। গত তিন দশকে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিথিল হয়েছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে বাতিল করা হতে থাকে। জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প ধারাবাহিকভাবে বন্ধ করা হচ্ছে।
বাজারের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে শাসকশ্রেণির আরও মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ শূন্যে নিয়ে চলে যাওয়া হচ্ছে। সদ্য লাগু হওয়া কৃষিআইনগুলির মূল কথা সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতা, কর্পোরেট সেবা, সরকারের দায়বদ্ধতা প্রত্যাহার। সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতার ফলে সমস্ত জিনিসের দাম আরও বাড়বে। মোদী সরকার সাধারণ মানুষকে দেশি বিদেশি বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত খোলাবাজারের হাঙরের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির জেরে বিপুল পরিমাণ বিদেশি পণ্যের উপর থেকে আমদানি শুল্ক হয় পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে না হয় কমিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে আমাদের দেশের বাজারে অনেক শিল্পপণ্য ও কৃষিপণ্য অবাধে ঢুকছে যা আমাদের দেশেই উৎপাদিত হয়। ফলে দেশের উৎপাদকরা বিপদে পড়ছেন। সঙ্কট বাড়ছে, সব অবাধ, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। জিনিসপত্রের দরদামও ঠিক হচ্ছে খোলাবাজারের নিয়মে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আছে বাজার-বন্ধু অর্থনীতি। যার মূল কথা - অবাধ মুনাফার জন্য বিনিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন ও বাণিজ্যে কর্পোরেট কর্তৃত্ব, আগামবাণিজ্যের আইনি স্বীকৃতি। বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ফাটকাবাজি ও মজুতদারিকে মদত দিচ্ছে। ফলে এই সরকারের আমলে জিনিসের দাম কমবে না। বরং বাড়বে।
কর্পোরেটচালিত সরকারের নয়া-উদারবাদী নীতিসমূহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে অন্যতম কারণ। ফাটকাবাজিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে - যা মূল্যবৃদ্ধির আর একটি কারণ। কর্পোরেটকে লুট করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে মোদী সরকার। খুচরা ব্যবসায়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ছোটো ব্যবসায়ীদের অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করে বলেছিল - এর ফলে জিনিসের দাম কমবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা উল্টো।
মজুতদার ও কালোবাজারিদের পকেট ভরাতে বাজপেয়ী সরকার (যে মন্ত্রীসভায় মমতা ব্যানার্জি মন্ত্রী ছিলেন) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে লঘু করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাম্প্রতিক কৃষিআইনে মোদী এই আইন সংশোধনের নামে কার্যত তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আরও দাম বাড়বে।
১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দামের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। গত তিন দশকে উদারবাদী নীতির পথে এই ক্ষমতাকে শিথিল করে দেওয়া হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্যকে অবাধ করার নামে বাজপেয়ী সরকার এ কাজ করে। ২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার এক নির্দেশ জারি করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে লাইসেন্সিং, বিশেষত খাদ্যসামগ্রীর চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও মজুতসীমা ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়। ২০০৩ সালে ভারত সরকার বনস্পতি, ডাল, আটা, ময়দা, গুড় প্রভৃতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণবিধি তুলে নেয়। এগুলির মধ্য দিয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে ধারাবাহিকভাবে লঘু করা হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বাজারসর্বস্ব নীতির প্রতি বিশ্বস্ত বিজেপি। তাই বাজপেয়ী সরকারের আমলেই আগামবাণিজ্য নীতি চালু করা হয়। যা মূল্যবৃদ্ধিকে অবশ্যম্ভাবী করে তালে। আসলে আগেই জিনিস কেনার জন্য চুক্তি করে রাখা হয়। পরবর্তীতে যখন বাজারে সেই জিনিস বিক্রি করা হয় তখন তা থেকে ভাল পরিমাণে লাভ হয়। এটিই হচ্ছে আগাম বাণিজ্য। ফলে ফাটকাবাজির রমরমা বাড়ছে। আগামবাণিজ্যের ফলে মজুতদারি বেড়েছে। আগামচুক্তির মধ্য দিয়ে মজুত বাড়িয়ে তোলা হয়। স্মরণে রাখা দরকার ১৯৫২ সালের আইনে এই ধরনের চুক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। এনডিএ সরকার তা তুলে দেয়। ফলে বিগত বছরগুলিতে ফাটকাবাজি বেড়েছে। ফরওয়ার্ড কন্ট্রাক্ট ও ফিউচার কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে গুদামে বিপুল পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
মোদী সরকারের খাদ্যনীতি বাজারে যাবতীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এই সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যশস্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে খাদ্যশস্য কিনে মজুত করার সুযোগ করে দিয়েছে। এরা বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। কৃষিপণ্যের আগামবাণিজ্য নীতির মধ্যে দিয়ে কর্পোরেটদের মুনাফা বৃদ্ধির ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামবৃদ্ধির ব্যবস্থাকে পাকা করেছে।
গরিব মানুষের উপর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপানো হচ্ছে। মোদীর বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং মুক্তবাজারের অর্থনীতিতে কালোবাজারি, মজুতদার ও ফাটকাবাজদের পৌষমাস। ফলে খাদ্যসামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের লুট ও মুনাফার জন্য দাম বাড়ছে। গরিবের ন্যূনতম খাদ্য পাওয়াও আগামীদিনে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
গণবণ্টন ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ফলে আক্রান্ত গরিব মানুষেরা। বিগত পাঁচবছরে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে মোদী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকার খাদ্যবণ্টনের দায় অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে। রেশনে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের পরিমাণও কমানো হয়েছে। কমানো হয়েছে ভরতুকি। কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছে খাদ্যশস্য সরকারের কাছে বিক্রি না করে খোলাবাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করতে অর্থাৎ মোদী সরকার মজুতভাণ্ডার কমিয়ে ব্যবসায়ীদের মজুতদারিতে সাহায্য করেছে।
গণবণ্টন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে খোলাবাজারের উপর চাপ ক্রমশ হালকা হচ্ছে। স্বভাবতই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। গণবণ্টনের তিনটি বিষয়ঃ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, যথাযথ সংগ্রহ ও যথাযথ বণ্টন। তিনটি ক্ষেত্রেই সরকার ব্যর্থ। প্রসঙ্গত, ভারতে গণবণ্টন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান বামপন্থীদেরই।
পেট্রোপণ্যের দামের বৃদ্ধি বা হ্রাসের উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমাদের দেশের পরিবহণ ব্যবস্থা প্রধানত তেলের উপর নির্ভরশীল। আবার জিনিসপত্র উৎপাদনেও তেলের ভূমিকা আছে। ফলে পেট্রোপণ্যের মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু সেই তেলের মূল্য অযৌক্তিকভাবে মোদী সরকার ঘনঘন বাড়িয়ে চলেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে ভারতে পেট্রোলিয়ামজাত জিনিসের দাম বেশি। তেলের দাম বাড়ার ফলে জিনিসের দাম বাড়ে।
পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধি করে সরকার রোজগার করে। আসলে দেশের বাজারে পেট্রোপণ্যের দামের একটা অংশ থেকে ভারত সরকার বহিঃশুল্ক ও অন্তঃশুল্ক বাবদ আয় করে। পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের মানুষের উপর বাড়তি পরোক্ষ কর চাপিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেসের’ সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও ‘সেস’ আরোপ করে। বিদেশ থেকে আমদানি করা অশোধিত তেলের উপর আমদানি শুল্ক চাপানো হয়। আবার দেশের অভ্যন্তরে তেল পরিশোধনের পর অন্তঃশুল্ক বা উৎপাদন শুল্ক চাপানো হয়। দেশের অভ্যন্তরে উত্তোলিত তেলের উপরও ‘সেস’ বসানো হয়। আর এর সমস্ত বোঝাটাই বইতে হয় জনগণকে।
মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো দেশের কৃষিতে অনিশ্চয়তা। কৃষি উৎপাদন, মূল্যস্তর নির্ধারণ সবকিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাজারের উপর। কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সার কারখানাগুলিতে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সারের উপর ধারাবাহিকভাবে ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে। আমদানি করা সারের দাম বাড়ছে।
বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার নীতি মোদী সরকার অনুসরণ করে চলেছে। ফলে এটি দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিজেপি সরকারের নীতির ফলে বেসরকারি বৃহৎ ব্যবসায়ীরা বিরাট মজুত গড়ে তুলে কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করছে - যার ফলে বাজার মূল্য ঊর্ধ্বমুখী, বাজারে আগুন। চাষের খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনই খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ছে তীব্রগতিতে।
জিনিসের দাম বেড়ে চললেও সরকার নির্বিকার, নীরব দর্শক। সংসদেও এ বিষয়ে সরকার কোনো উত্তর দেন না। যদিও সংবিধানের ৭৫(৩) ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্টের কাছে ও পার্লামেন্ট মারফত জনগণের কাছে প্রতিটি মন্ত্রীই সমষ্টিগতভাবে দায়বদ্ধ।
খাদ্যশস্যের দামবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের দামও লাগামছাড়া। প্রয়োজনীয় ওষুধ সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে নেই এমন দেশগুলির মধ্যে ভারত সামনের সারিতে। ওষুধের দামের উপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ রাখতে রাজি নয় কেন্দ্র। ফলে আগামীদিনে আরও দাম বাড়বে ওষুধের। ভয়াবহ দাম বাড়ছে বিদ্যুতের। গোটা বিদ্যুৎব্যবস্থা বেসরাকারিকরণের পথে। বিদ্যুতের উপর সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার থাকবে না।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। চালের দাম বেড়ে চলেছে। আলু, সবজি সবই ঊর্ধ্বমুখী। রাজ্য সরকার বড়ো ফড়েদের হাতে লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। চাল সংগ্রহের কাঠামোই ভেঙে দিয়েছে সরকার। মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে থাকেন বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা। এটা ঠিক পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াচ্ছে কেন্দ্র। কিন্তু বাড়তি দামের উপর বিক্রয়কর থেকে মুনাফা বাড়াচ্ছে মমতা সরকার। কেরোসিনের দাম রেশন, খোলাবাজার সর্বত্র বাড়ছে।
রাজ্য সরকার উদ্যোগ নিলে যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কিছুটা রোধ করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের মানুষকে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা থেকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্য ন্যায্যদামে কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে তা রেশন দোকানগুলির মাধ্যমে বাজারের দামের থেকে অনেকটাই কম দামে বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমবায় প্রতিষ্ঠান, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা ছিল। আবার রাজ্য সরকারও সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করত। ২০০৯ সালের ১ মার্চ থেকে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিপিএল ভুক্তদের জন্য রেশন দোকানের মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ভরতুকি দিয়েছিল ৪৫০ কোটি টাকা।
বামফ্রন্ট সরকার ২০০৮ সালে লিটার প্রতি পেট্রোলে ২ টাকা ১২ পয়সা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ১ টাকা ৩৮ পয়সা মকুব করেছিল। কেরোসিনেও ভরতুকি দিত। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসভাড়া যাতে বৃদ্ধি না হয় তারজন্য বামফ্রন্ট সরকার ভরতুকি দিত। এমন কি আলুর মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে বামফ্রন্ট সরকার ভরতুকিতে কম দামে আলু বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল।
বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। নয়া-উদারবাদী নীতি পরাস্ত হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই এই নীতির বিরূদ্ধে ধৈর্যশীল, ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলাই বিকল্প পথ।