E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭

রেললাইন এবং কৃষিআইন

অমিতাভ রায়


চালু হয়ে গেল নতুন কৃষিআইন। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হতে চলেছে নতুন রেললাইন। না, লাইন নতুন নয়। পুরনো লাইনেই চলবে নতুন ধরনের ট্রেন। আরও ভালো করে বললে বলতে হয় নতুন রকমের মালগাড়ি। কোনোটির নাম কলা স্পেশাল কোনোটা আবার আম স্পেশাল। এছাড়া থাকবে পেঁয়াজ স্পেশাল, সবেদা স্পেশাল।

আগস্ট মাসেই পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। দেশের সকলের মুখে মাস্ক পরিয়ে কোনো প্রচার না করে নিঃশব্দে পেঁয়াজ আর কলা বোঝাই একটি মালগাড়ি মহারাষ্ট্রের কোলাপুর এবং দেবলালি থেকে বিহারের মুজফ্‌ফরপুরে পাঠানো হয়। এই বিশেষ মালগাড়িতে অন্য কোনো পণ্য ছিল না। পরীক্ষা সফল হওয়ার পর সম্ভবত নতুন কৃষিআইন যাচাই করার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষলগ্নে নানারকম ফল, শাকসবজি নিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে একটি বিশেষ মালগাড়ি দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেয়। এবং ঠিকমতো দিল্লি পৌঁছে যায়। নিজেদের সাফল্যে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে তড়িঘড়ি, দোসরা অক্টোবর জাতীয় ছুটির দিনেই রেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে পরবর্তী কর্মসূচি। অর্থাৎ ছক আগেই কাটা ছিল। শুধু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে একটু চিন্তা ছিল বলে আগেভাগে ঘোষণা করা যায়নি। এখন আর কোনো অসুবিধা নেই।

● রেল কর্তৃপক্ষ বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে, এখন থেকে নিয়মিত কতগুলি স্পেশাল মালগাড়ি কোন্ কোন্ পথে চলবে।
● মহারাষ্ট্রের নাসিক এবং জলগাঁও থেকে মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করবে পেঁয়াজ ও কলা স্পেশাল মালগাড়ি। গন্তব্য দিল্লি। প্রতি বছর মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নিয়মিত চলবে এই স্পেশাল ট্রেন।
● আম স্পেশাল চলবে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত চলবে আম বহনকারী বিশেষ মালগাড়ি।
● রপ্তানির জন্য শুধুমাত্র কলা নিয়ে চলবে অনন্তপুর থেকে মুম্বাই।
● গুজরাটের সুরাট, ভালসাদ, নওসারি থেকে দিল্লি পর্যন্ত চলবে সবেদা স্পেশাল। সবেদা মরশুমি ফল বলে এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে সবেদা স্পেশাল।
● উত্তর প্রদেশের দাদরি ও কানপুর থেকে রপ্তানির জন্য মাংস বোঝাই প্রোটিন স্পেশাল গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের সমুদ্রবন্দরগুলিতে পৌঁছে যাবে।

ফিরতি পথে মালগাড়ির ওয়াগনগুলি কি ফাঁকা ফিরবে? কিছু বলা হয়নি।

সকলের অজান্তে পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজ আর কলা বোঝাই যে বিশেষ মালগাড়িটি মহারাষ্ট্রের কোলাপুর এবং দেবলালি থেকে বিহারের মুজফ্‌ফরপুর পাঠানো হয়েছিল তার সঙ্গে একটি যাত্রীবাহী কামরা সংযুক্ত ছিল। যে কৃষকরা পণ্য বিক্রি করেছেন তাঁরাই ছিলেন এই কামরার যাত্রী। পণ্য পরিবহণ নিয়ে কোনো প্রতারণা হচ্ছে না এটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো মালগাড়ির সঙ্গে যাত্রীবাহী কামরাটা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেপ্টেম্বরের শেষলগ্নে নানারকম ফল, শাকসবজি নিয়ে যে বিশেষ মালগাড়ি দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেয় তার সঙ্গে অবিশ্যি কোনো যাত্রীবাহী কামরা জুড়ে দেওয়া হয়নি।

প্রাথমিক পর্যায়ের সাফল্যের পর রেল কর্তৃপক্ষ এখন কৃষিপণ্য পরিবহণ নিয়ে আরও বিশদ পরিকল্পনার রূপরেখা ছকতে শুরু করেছে। রেল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে ছোটো ছোটো গ্রাম-গঞ্জ থেকে কৃষি পণ্য সংগ্রহ করে বড়ো স্টেশনে নিয়ে আসার কথা ভাবছে। সেখান থেকে সরাসরি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অঙ্কে কোনো ভুল নেই। দু'হাজার কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে এক টন কৃষিপণ্য ট্রাকে করে পাঠাতে যা খরচ হয় রেলের মাধ্যমে পাঠালে তার থেকে অন্তত এক হাজার টাকা কম খরচ হবে। কৃষিপণ্য দ্রুত পচনশীল। ট্রাকে পাঠালে সাধারণত গড়ে তিরিশ শতাংশ পণ্য খারাপ হয়ে যায়। মালগাড়িতে সময় কম লাগায় অপচয় নিশ্চয়ই কম হবে। কৃষকের জন্য নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় প্রস্তাব।

নতুন কৃষিআইন আর রেলের বিশেষ মালগাড়ি চালানোর পরিকল্পনা এইখানে এসে মিলে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের ছোটো চাষি শহর চেনেন না। এতকাল তাঁরা কষ্টেসৃষ্টে গঞ্জের বাজারে অথবা মান্ডিতে তাঁদের ফসল নিয়ে আসতেন। গোরুর গাড়ি, ট্রাক্টর বা ট্রাকে চড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতে আনা পণ্যের দাম পরতায় না পোষালে বস্তা ভর্তি আলু, পেঁয়াজ, টম্যাটো বা ঝাঁকা ভর্তি শাকসবজি ওখানেই রাস্তার উপর ফেলে রেখে কৃষক বাড়ি ফিরতেন। ফিরতি পথের গাড়ি ভাড়া বাঁচত।

নতুন কৃষিআইন সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে বলে প্রচার চলছে। এপিএমসি নেই বলে মান্ডিতে ফসল নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। মিনিমাম সার্পোট প্রাইস (এমএসপি) অর্থাৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকায় ক্রেতা অথবা তার প্রতিনিধি কিংবা কমিশন এজেন্ট বা ফড়ে সরাসরি খেতে অথবা বাগিচায় পৌঁছে গিয়ে কৃষক অর্থাৎ উৎপাদকের সঙ্গে দরাদরি করতে পারবে। দামে পোষালে আগামী মরশুমের জন্য দাদন ধরিয়ে দেওয়া যাবে। সবমিলিয়ে রেললাইনে মিশে গেল নতুন তিনটি কৃষিআইন।

এই পরিসরে প্রশ্ন উঠতেই পারে নতুন জমানায় ক্রেতার ভূমিকায় কারা খেতে বাগিচায় উপস্থিত হচ্ছেন? তাঁদের কাছে কত পুঁজি আছে? এই মরশুমের যাবতীয় ফসল একলপ্তে নগদ টাকায় কিনে নেওয়ার পর পরের মরশুমের দাদন ধরিয়ে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ক’জন ক্রেতার আছে?

পুঁজির আগ্রাসী দাপটে দেশের যাবতীয় উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থা যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী করায়ত্ত করে নিয়েছে তারাই এখন সমস্ত কৃষিজ পণ্যর মালিক হতে চায়। উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্যাবসায় মুনাফা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। দেশে কাজছাড়া এবং কাজহারা মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। নিরন্ন মানুষের চাহিদা সীমিত। কাজেই বাজার সঙ্কুচিত। এই পরিস্থিতিতেও কৃষিক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কমেনি। দেশের সত্তর শতাংশের বেশি কৃষিজীবী মানুষের নিরলস পরিশ্রমের ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষিজ পণ্যের অবদান এতটুকুও কমেনি। ন্যায্য মূল্য তো দূরের কথা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-র থেকে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করতে হলেও অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েনি। প্রথমত কৃষিজ উৎপাদন কমেনি। এবং চাহিদাও কমেনি। নিরন্ন মানুষও সবকিছু বাদ দিয়ে চাল ডাল আনাজ কিনতে চেষ্টা করে। দাম বাড়লেও কিনতে বাধ্য। পেটে দানাপানি না পড়লে প্রাণ বাঁচবে কী করে? মানুষের এই সঙ্কট পুঁজির নজর এড়ায়নি। পাশাপাশি কৃষিজ উৎপাদনের ধারাবাহিক অবদান সম্পর্কে মুষ্টিমেয় বিনিয়োগকারী ওয়াকিবহাল। কাজেই আর দেরি নয়। এই তো সঠিক সময়। সামাজিক দূরত্বের অজুহাতে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সামাজিক সংহতি। সামগ্রিকভাবে দেশের খনিজ–কৃষিজ-বনজ সম্পদ লুটে নেওয়ার জন্য পুঁজি এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সবকা বিকাশ স্লোগান দিয়ে পুঁজির বিকাশ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে সক্রিয়। প্রয়োজনে গলার জোরে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে সংসদীয় ব্যবস্থার রীতিনীতি উপেক্ষা করে পাশ করানো হচ্ছে নতুন আইন। রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো যেমন রেল, বিমান এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা অর্থাৎ বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দরকে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তেমন দরকার হলে সেগুলিকেও গোষ্ঠীপুঁজির হাতে তুলে দিতে আপত্তি নেই। পুঁজির বিকাশে রাষ্ট্রের উৎসাহ এতটাই বেশি যে কৃষিমন্ত্রকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রেল কর্তৃপক্ষ কর্মসূচি তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে। পুঁজির এই সর্বগ্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে সর্বাত্মক জন আলোড়ন। অন্যথায় অনাগত সময় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে।