E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭

মৃত্যুর দিনে চে স্মরণে

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


জন্মগ্রহণ করেছেন (আর্জেন্টিনা), বিপ্লব করেছেন আর এক দেশে (কিউবা)। সফল বিপ্লবের পরে থেমে থাকেননি। চলে গেছেন পাশের দেশের বিপ্লবীদের পাশে। লড়াই করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছেন সেই দেশে (বলিভিয়া) ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়েই সারা পৃথিবীর সামনে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেনঃ “বলিভিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হিসাবে চে গুয়েভারা যুদ্ধের মধ্যেই নিহত হয়েছেন”। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেনঃ “কেবলমাত্র বিপ্লবই মানুষকে প্রকৃত সুবিচারের সন্ধান এনে দিতে পারে”। চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ডাক্তার হয়েও লোভনীয় জীবনের যাবতীয় লোভকে উপেক্ষা করে কিউবাতে অত্যাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে সরাতে বেছে নিয়েছিলেন জল-জঙ্গলের গেরিলা জীবন। হয়ে উঠেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোর লড়াইয়ের প্রধান সঙ্গী। সফল বিপ্লবের পরে কয়েক বছর দেশ গঠনের জন্য নানা ধরনের দায়িত্বে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি সফলভাবে তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে সফল হন। দেশের মধ্যে, দেশের বাইরে তিনি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সুস্থির, চিন্তাশীল ও বাস্তব বিবেচনায় ভরপুর ব্যক্তি হিসাবে একে একে পালন করেছেন জাতীয় ব্যাঙ্কের সভাপতি, কাস্ত্রোর মিলিটারি পরামর্শদাতা, রাষ্ট্রদূতের ও ১৯৬৫-তে শিল্প দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব। এই সময়ে তিনি বাণিজ্য ক্ষেত্রে দেশকে ক্ষতিকারক আমেরিকামুখী ঝোঁক থেকে মুক্ত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত করেন। সদ্য স্বাধীন কিউবাকে একটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ফিদেল যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই কাজে চে তাঁর প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন।

দেশ গড়ার কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সেই মানুষটাই ১৯৬৫ সালেই দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। তার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য স্বপ্ন-একটা সুসংহত, সমাজতান্ত্রিক মহাদেশ গড়ার স্বপ্ন। চে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে, সেনাবাহিনীর কমান্ডার পদে ইস্তফা দিয়ে এমনকি কিউবার নাগরিকত্ব ছেড়ে চলে গেলেন ‘বিশ্ববিপ্লবে’র প্রয়োজনে বলিভিয়া। সেখানে জঙ্গল থেকে লেখা চিঠিতে ফিদেলকে চে জানিয়ে দিলেনঃ তিনি আর থাকতে চান না কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির কোনো ‘সরকারি’ পদে। থাকতে চান না অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারকে হটিয়ে গড়া বিপ্লবী সরকারের জাতীয় ভূমিসংস্কার প্রতিষ্ঠানের শিল্প দফতরের প্রধানের পদে। থাকতে চান না জাতীয় ব্যাঙ্কের সভাপতি, শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী। জানালেন যে, তিনি মনে করেন, নিজের ভূখণ্ডে কিউবার বিপ্লবে তাঁর যতটুকু করণীয় ছিল, তিনি তা করেছেন। তিনি ওই চিঠিতে এও জানান যে, তাঁর মৃত্যুটা যদি হয় অন্য কোনো দেশে, তা হলেও তাঁর শেষ চিন্তাটা থাকবে এই মানুষগুলিকে (কিউবার জনগণ) নিয়ে। ফিদেলকে পরিষ্কার করে লিখে জানালেনঃ ‘‘আমাকে এখন অন্য দেশগুলি চাইছে (বিপ্লব সংগঠনের জন্য)। সেটা আমি কিউবায় থেকেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তুমি তা মানতে চাইলে না! তাই আজ আমার তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। একমাত্র তুমিই ভাল করে জানো, তাতে আমার যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনই দুঃখটাও কম হচ্ছে না। আমি অন্য দেশে বিপ্লব সংগঠনে যাচ্ছি বলে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু এই কিউবার মানুষগুলিকে ছেড়ে যাচ্ছি বলে আমার দুঃখটাও কম হচ্ছে না। তবে নতুন যে যুদ্ধক্ষেত্রে (অন্য দেশে বিপ্লব সংগঠনে) যাচ্ছি, সেখানেও আমি সেই মতাদর্শকেই কাজে লাগাব, যা আমাকে তুমি শিখিয়েছিলে। আর সেখানেও আমি তোমার কথাই তুলে ধরব। তুমি আমাকে যা শিখিয়েছো, তার জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। আর সেটা আমি আমার শেষ সময় পর্যন্ত মনে রাখব। সেগুলিকে প্রয়োগ করব কার্যক্ষেত্রে।’’

কিউবা ছেড়ে অন্য দেশে বিপ্লব সংগঠনের কাজে চলে যাবার পরেও অতীতকে নিয়ে তাঁর কোনো আফসোস তো ছিলই না, বরং গর্ববোধ ছিল প্রবল। পরিবারের সকলকে ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেলেও দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি গভীর প্রত্যয় থেকে ফিদেলকে জানিয়েছিলেনঃ “আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কোনো বৈষয়িক সম্পদ রেখে যাচ্ছি না, আমি তাদের জন্য কিছুই চাই না, এই কারণে যে, তাদের প্রয়োজনীয়তা ও শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র সব দেবে।”

আমরা জানি তাকে ন্যূনতম বিচারের সুযোগটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। গ্রেপ্তার করে তাঁর সঙ্গীদের সাথে তাঁকে একটা স্কুল ঘরে নিয়ে গিয়ে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই এলাকায় প্রচার করে দেওয়া হয়ঃ “এই স্কুলে যাদের এনে রাখা হয়েছে তারা স্ত্রীলোকদের ধর্ষণ করতে, শিশু চুরি করতে এবং বৃদ্ধ লোকদের হত্যা করতে এসেছিল”। বিচারের সুযোগ না দিয়ে হত্যা সংগঠিত করার এই ঘরানার সাথে বিগত কয়েক বছরে আমরাও পরিচিত। অথচ তাঁর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল “মানুষের মুক্তি অথবা মৃত্যু”।