E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৯ম সংখ্যা / ৯ অক্টোবর ২০২০ / ২২ আশ্বিন ১৪২৭

করোনা আবহে জার্মানিতে অতিদক্ষিণপন্থীদের ধ্বংসের উন্মাদনা

তপন মিশ্র


গত ২৪ সেপ্টেম্বর জার্মানির সালফেল্ড-রুডলস্টাড জেলার (Landstatd) নির্বাচিত জেলা আধিকারিক মার্কো ভোলফ্রামের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। মার্কো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (Sozialdemokratische Partei Deutschlands) বা এসপিডি-র দীর্ঘদিনের নেতা। কথা হচ্ছিল এখানকার অতিদক্ষিণপন্থী দলগুলির সাম্প্রতিক কাজকর্ম এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক সরকারের তৎপরতা নিয়ে। অবশ্যই এর একটা কারণ ছিল। একসময়ে যেমন জার্মানিতে সংক্রমণ কমেছিল তেমনই ইদানিং সময়ে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টি-মাস্ক (মাস্ক-বিরোধী)এবং অ্যান্টি-ভ্যাক (টিকা-বিরোধী) প্রচার দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

দক্ষিণপন্থীদের অ্যান্টি-মাস্ক আন্দোলন

জুন এবং জুলাই মাসে রুডলস্টাড শহরে অ্যান্টি-মাস্ক এবং আন্টি-ভ্যাক্সিন প্রচার ও একশ’ দেড়শ’ মানুষের র‍্যালি হতে দেখেছি। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। ১ আগস্ট জার্মান পুলিশ ও সংবাদসংস্থা এএফপি‍‌-র মতে বার্লিন শহরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমায়েত হয়। আয়োজকরা অবশ্য দাবি করে যে, ৫ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছে। জমায়েতকারীদের দাবি হলো - মাস্ক আমাদের দাস করে দিচ্ছে, তাই আমরা মাস্ক-মুক্ত হতে চাই। প্রসঙ্গত বলে রাখি, করোনা আবহে জার্মানির নিয়ম হলো - কোনো অফিস, শপিং মল, ছোট দোকান, বাস বা ট্রেন ইত্যাদিতে অর্থাৎ ঘেরা জায়গায় এবং মানুষের ভিড়ে মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

অ্যান্টি-মাস্ক গোষ্ঠীর মূল স্লোগান ছিল আমাদের ‘Day of Freedom’ অর্থাৎ মুক্তির দিন চাই। পাঠকদের মনে করিয়ে দিলে যোগসূত্র খুঁজতে সুবিধা হয়। ১৯৩৫ সালের হিটলারের নাজিবাহিনীর উপর তৈরি একটি প্রায় নির্বাক (সিনেমায় কোনো সংলাপ নেই কেবল কিছু স্লোগান ছাড়া) সিনেমার নাম ছিল Tag der Freiheit অর্থাৎ Day of Freedom। এই সিনেমায় নাজিবাহিনীর জমায়েতের মূল স্লোগান ছিল আমাদের চাই “ডে অফ ফ্রিডম”।

মিছিলের ঠিক পরে যখন বিভিন্ন দলের নেতারা এবং সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এই ঘটনার নিন্দা করে তখনই এএফডি থেকে তাদের কো-চেয়ার (Co-Chair) টিনো চুরুপাল্লা (Tino Chrupalla)-র বক্তব্য হলো প্রতিবাদ সঠিক হয়েছে। তাঁর মতে “I cannot recognise any wrongdoing, I followed the demonstration, which was peaceful. The people went on to the streets to defend their basic rights and their civil liberties, and that’s something one can only welcome”। মাস্ক পরলে যে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে একথা আপনি বিশ্বাস করেন না, আপনার হাসি পায়। কয়েকদিন আগে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রায় একই বক্তব্য ছিল। তিনি নিজে মাস্ক পরতেন না, বরং অন্য কেউ পড়লে উপহাস করতেন। পরিণাম আমাদের সবার জানা। বেচারা ট্রাম্প নির্বাচন প্রচারে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এখন সহানুভূতি ভোটের আশায় বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

থুরিঙ্গেনের বিগত দুই নির্বাচন ও রাজনীতি

গত জুন মাসের ২৭ তারিখে করোনা আবহে জার্মানির থুরিঙ্গেন রাজ্যের সালফেল্ড-রুদলস্টাড জেলাক্ষেত্র (Kreis)-এর নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের আগে ল্যাম্পপোস্টে মূলত তিনজনের ছবি সহ প্রচার দেখেছিলাম। এদের মধ্যে প্রথমজন হলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মার্কো ভোলফ্রাম (Marco Wolfram), দ্বিতীয়জন জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেলের দল খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (সিডিইঊ)-র মাইক কুভালোক (Maik Kowalleck) এবং অতিদক্ষিণপন্থী অলটারনেট ফর জার্মানি (এএফডি) দলের ব্রুনহিল্ড নওর (Brunhilde Nauer)। এএফডি পুর্বতন নাজিদলের ঐতিহ্য বহন করে। এখানকার ভোট হয় নীরবে। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে। যেমন কেউ চাইলে ঘরে বসে নেটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন কিংবা এক নির্দিষ্ট দিনে বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারেন।

এই জেলার জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৩ হাজারের মতো। ভোট পড়ে মাত্র ৪১.৪ শতাংশ। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভোটের হার ছিল ৫৮.৫ শতাংশ, সিডিইউ ২৩.৭ শতাংশ এবং এএফডি’র ভোট ছিল ১৭.৮ শতাশ। নির্বাচনে বামদল এসপিডি-কে সমর্থন করে। জেলাটি অনেকদিন ধরে সিডিইউ’র দখলে ছিল। ভোটের হিসাবে দেখলে অতিদক্ষিণপন্থীদের ভোট কমেছে। কিন্তু গত ২০১৯ সালের থুরিঙ্গেন রাজ্যের নির্বাচনে পূর্বের তুলনায় ওদের ভোট ছিল অনেক বেশি। নির্বাচনের পর থুরিঙ্গেন রাজ্যে দেখা যায় যে, বাম (ডি লিঙ্কে) এবং এএফডি’র শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং জার্মানির বর্তমান চেয়ারপার্সন আঙ্গেলা মার্কেলের সিডিইউ দলের শক্তি হ্রাস পেয়েছে। পরে অবশ্য বামপন্থীরা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, সিডিইউ এবং পরিবেশরক্ষার পক্ষে লড়াই করা দল দা গ্রুন (Die Grune) অর্থাৎ গ্রিন পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এএফডি-কে বাইরে রেখে সরকার গড়তে সক্ষম হয়। এখন এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বামদলের। তবে আমাদের দেশের বামদলের সঙ্গে এখানকার ডি লিঙ্কের তুলনা করবেন না। ডি লিঙ্কের সালফেল্ড দপ্তরে কথা বলে সেটার কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল।

ওইয়ামার রিপাবলিকের ঐতিহ্য

ভোলফ্রামের সঙ্গে সেদিনের আলোচনায় ওইয়ামার রিপাবলিকের কথা তুললাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, এই শহর অর্থাৎ রুডলস্টাড থেকে ওইয়ামার শহরের দুরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটারের মতো। সেখান থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে বুখেনওয়াল্ডে ওইয়ামার রিপাবলিকের স্মৃতিসৌধ। লকডাউনের আগেই ওখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে অন্য প্রসঙ্গ। গত বছর ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ওইয়ামার রিপাবলিকের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান হয়, যারা মূল উদ্যোক্তা ছিল এসপিডি সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি। এসপিডি নেতা ভোলফ্রাম সেই ঐতিহ্যের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এবছর বুখেনওয়াল্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মুক্তির ৭৫ বছর পূর্তির কর্মসূচি বড়ো করে পালনের কথা ছিল। সোভিয়েত বাহিনীর উদ্যোগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে এই মুক্তি আসে। কিন্তু করোনার জন্য লকডাউনের কারণে এই কর্মসূচি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে পালন করা হয়।

এদেশে যে দু’টি বামপন্থী দল ওইয়ামার রিপাবলিকের ঐতিহ্য বহন করে এবং এখনো মার্কসবাদের চর্চা করে তাদের খু্ঁজে পাওয়া বড়ো দুষ্কর। তারা হলো ১৯৮২ সালে তৈরি দ্য মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টি অব জার্মানি (German: Marxistisch-Leninistische Partei Deutschlands, MLPD), যাদের কিছুটা হলেও দু-একটি দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ওইয়ামার রিপাবলিকের মূল কারিগর এবং নাজিবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে যারা প্রাণপণ লড়াই করে তাদের দল, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির দেখা পাওয়া ভার।

এএফডি’র তাণ্ডবের উৎস কি?

এই একটাই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম এসপিডি, গ্রিন পার্টি এবং দ্য লেফট এই তিন দলের কাছে। যে কথা ভোলফ্রামের কথায় ছিল অন্যরা তারই পুনরাবৃত্তি করল। ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি এবং বিশেষ করে সিরিয়া থেকে যে শরণার্থী এসেছে তাদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি সরকার নিয়েছিল এবং অতিদক্ষিণপন্থীরা বাদ দিয়ে অন্যরা তা সমর্থন করেছিল। সেই নীতির বিরুদ্ধে ওদের আগ্রাসী প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বিরোধী অবস্থান এবং জার্মান জাতীয়তাবাদকে প্রচারের আলোকে নিয়ে আসা। পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আমেরিকার ট্রাম্প সরকার এবং আমাদের দেশের সরকারের মতো একই অবস্থান জার্মানির অতিদক্ষিণপন্থীদের।

ভোলফ্রাম স্বীকার করেন যে, জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের শক্তি হ্রাস হচ্ছে এবং কোনো কোনো অংশে অতিদক্ষিণপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ২০২০-র নির্বাচনে মানুষ করোনা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বর্তমান ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা চাইছে। গ্রিন দল এবং বামদলের মত হলো শরণার্থীদের আশ্রয়দানের ফলে জার্মানির কোনো ক্ষতি হয়নি। এর ফলে যেমন মানবতা রক্ষা পেয়েছে তেমনই বেশকিছু ক্ষেত্রে মানবসম্পদের অভাব কিছুটা হলেও মিটেছে। দক্ষিণপন্থীদের আশঙ্কামতো তেমন কোনো সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়নি। ভোলফ্রামের মতে এবারের আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের হার হবে এবং পৃথিবীর সমস্ত অতিদক্ষিণপন্থীদের নিরুৎসাহিত করবে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি যে, এখানকার অনেক বয়স্ক মানুষ রয়েছেন যারা চার্চে যাওয়া দরকার মনে করেনা। পূর্বতন পুর্ব জার্মানি বা জিডিআর (German Democratic Republic) যাকে এখানকার ভাষায় ডিডিআর (Deutsche Democratic Republic) বলা হয়, প্রায় সমস্ত চার্চই সেই সময়কার। তখনও চার্চে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না, এখনও নেই।

এখানকার ভাষায় জার্মানির থুরিঙ্গেন রাজ্যে এখন রেড-রেড-গ্রিন এর সরকার চলছে। সরকারের করোনা আক্রান্তদের চিহ্নিত করা, তাদের আলাদা করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করার সুফলও লক্ষ করার মতো। জার্মানি সহ বেশ কিছু দেশকে সেঙ্গেন কান্ট্রি বলা হয়, যাদের মধ্যে যাতায়াত অবাধ। করোনা আবহে ছুটি কাটানোর জন্য বা অন্য কোনো কারণে একদেশ থেকে অন্যদেশে যেমন জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া বা পোল্যান্ড বা এমন কোনো দেশে যাতায়াত করলে যাওয়ার সময় কোনো বাধা না থাকলেও ফেরার সময় বর্ডারে জানাতে হবে। ঘরে ফিরে করোনা পরীক্ষা করা এবং করোনার লক্ষণ না থাকলেও ৭ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। দেশের মধ্যে এমনকি নিজের শহরে কেউ কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে খাবারের সঙ্গে আপনার কাছে এক কাগজ আসবে। সেটাতে আপনাকে আপনার নাম, ঠিকানা, কোথা থেকে আসছেন, কোথায় যাবেন সবটাই উল্লেখ করতে হবে। রেস্টুরেন্ট মালিকের দায়িত্ব তা সঠিক জায়গায় পৌঁছানো। ট্রেস করার এই পদ্ধতির অভিনবত্ব নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।

একথা মানতেই হবে যে, পরিবেশরক্ষার ক্ষেত্রে এই রাজ্যের মানুষ ও প্রশাসন অত্যন্ত সচেতন। থুরিঙ্গেন রাজ্যকে জার্মানির গ্রিন হার্ট বলা হয়। পাহাড়, নদী এবং অফুরন্ত অরণ্যসম্পদ এ রাজ্যের ভূষণ। সঙ্গে সঙ্গে অনেক কলকারখানাও। এই সবুজ বজায় রাখা সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ভোলফ্রাম মনে করেন যে, প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকার সরে আসা এক বড়ো অপরাধ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, গ্রিন পার্টির সঙ্গে কথা বলে মনে হলো যে, পরিবেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার শুভ উদ্যোগ এদের থাকলেও পরিবেশরক্ষার বিষয় ব্যতিরেকে আরও অনেক কিছু বিষয় যে রাজনীতির বিষয় হওয়া দরকার সেই চিন্তার ঘাটতি এদের আছে। এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সে পরে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের যারা পরিবেশ আন্দোলনে সোচ্চার কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনে বিমুখ তাদের ইয়োরোপের গ্রিন পার্টির চড়াই উৎরাই থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ইতিমধ্যে অন্তত জার্মান গ্রিন দল বুঝতে পেরেছে যে, অতিদক্ষিণপন্থীরা মানবতার বিপদ। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অতি দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সংগঠিত করতে যে দেশব্যাপী উদ্যোগ দরকার তার অভাব স্পষ্ট। একথা পরিষ্কার যে, এই কাজ যারা করতে পারতেন সেই বামপন্থীদের অভাব অনুভূত হচ্ছে সর্বস্তরে।