৬০ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ২৩ ভাদ্র, ১৪২৯
পুলিশি নৃশংসতা-আক্রমণ রুখেই প্রতিরোধের আগুনে আইন অমান্য
অপূর্ব চ্যাটার্জী
বর্ধমানে আইন-অমান্য আন্দোলনে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙছে জনতা।
৩১ আগস্ট, ২০২২ কার্জন গেটে, বর্ধমান শহরে এক অনন্য নজিরবিহীন প্রতিরোধের মেজাজ প্রত্যক্ষ করলেন রাজ্যবাসী। অতীতে নানা সমাবেশ, মিছিল প্রতিরোধ-প্রতিবাদের কর্মসূচি তা ১৯৬৮-র সাংগঠনিক প্লেনাম হোক, হরেকৃষ্ণ কোঙার, জ্যোতি বসু বা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরেরদিন ৭ ডিসেম্বর কার্জনগেটে কমরেড নিরুপম সেনের বক্তৃতা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে গত ১১ বছরে নানা সমাবেশ, মিছিল,আইন অমান্যের সাক্ষী থেকেছে এই কার্জন গেট এবং সংলগ্ন টাউন হল। কিন্তু এ যেন এক ব্যতিক্রমী চেহারার জনস্রোতের প্রতিবাদ - আইন অমান্য আন্দোলন। এক লড়াকু, আত্মপ্রত্যয়ী, বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। কেন এই আন্দোলন? এ হঠাৎ কোনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত হওয়া নয়। গত তিন-চার মাসে জেলাজুড়ে শ্রেণি ও গণফ্রন্টগুলির আন্দোলনের ছোটো ছোটো ঢেউ থেকেই এই বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়েছে।কেন মানুষের এই লড়াকু জানকবুল প্রতিরোধী মেজাজ?
২৩তম পার্টি কংগ্রেস এবং ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে, পার্টির নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারই বর্তমান পরিস্থিতির প্রধান ও অনিবার্য বিষয় হিসাবে সামনে এসেছে। পাটি কংগ্রেস ও রাজ্য সম্মেলনে চর্চা হয়েছে, আমাদের পার্টি ও শ্রেণি আন্দোলনের সামনে একদিকে তীব্র চ্যালেঞ্জ অন্যদিকে এক সম্ভাবনার মুখোমুখি। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ক্লেদাক্ত ব্যবস্থার ধারাবাহিক সংকটের পরিণতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে। গত ৮ বছরে দেশে করপোরেট-সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত ক্রমশ সংহত হয়েছে আর রাজ্যে ব্যতিক্রমী আঞ্চলিক দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস ফ্যসিস্টসুলভ সন্ত্রাসের পদ্ধতিতে স্বৈরাচারী একদলীয় বিকৃত শাসনব্যবস্থা চালাচ্ছে। এরা দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি,অপশাসনকে সর্বস্তরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। তাই,দেশে বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন করে পরাস্ত করাই প্রধান কাজ, পাশাপাশি রাজ্যে রাজনৈতিক লাইনের প্রধান কথা হলো বিজেপি ও তৃণমূল এই দুই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে পরাস্ত করো।
গরিব কৃষক, খেতমজুর, শ্রমজীবী জনগণ, মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, অসন্তোষ, অসম্মতি ক্রমশ বাড়ছে। পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনও নজরে আসছে। জনগণের মুডও পরিবর্তন হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে নিজ নিজ এলাকায় সুনির্দিষ্ট চেহারা ও গতি দিতে সচেতন সংগঠিত উদ্যোগের কাজে আমরা শামিল। এই প্রেক্ষাপটেই সংকল্পবদ্ধ সংগঠিত প্রতিরোধের জমি তৈরি হচ্ছে। জেলায় বেশ কিছু ঘটনা নজরেও আসছে। এ জন্য জনগণের সাথে সজীব সম্পর্ক স্থাপনে শাখাকে সক্রিয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনজীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত স্থানীয় সমস্যাগুলি তুলে ধরে - আদায়যোগ্য দাবিসমূহ না মেটা পর্যন্ত আন্দোলন চালানো। মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন এই চার হাতিয়ারকে শানিত করার কাজ একইসাথে চালিয়ে পরিস্থিতির বস্তুগত উপাদান এবং শ্রেণি ও গণফ্রন্টগুলির আন্দোলনে রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমাদের জেলা পার্টি তৎপর এবং উদ্যোগী। এ সময়ে জেলা, এরিয়া কমিটিগুলিতে সাংগঠনিক সভা এবং অধিকাংশ শাখাগুলিতেও তা সম্পন্ন হয়েছে। পার্টি সদস্যদের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক মান উন্নয়নের কাজকে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার ভ্রান্তি অতিক্রমেও এ সময় আমরা সক্রিয়। নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত পার্টি এবং দক্ষ শাখা সম্পাদক গড়ে তোলার লক্ষ্যে জেলায় ছটি ভাগে ভাগ করে শাখা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছে, শাখা গুলিতেও চর্চা হয়েছে। পার্টির সদস্যদের ছটি বিষয়ে শিক্ষিত ও পুনশিক্ষিত করার জন্য জেলায় পাঁচটি ভাগে প্রায় ২৮০ জনকে নিয়ে গত ২৭,২৮ আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টি কি ও কেন এবং পাটি কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। পাটি কংগ্রেসের ও রাজ্য কমিটির সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ সমস্ত পার্টি সভ্যের কাছে সময় ভিত্তিক বাস্তবায়ন ও অংশগ্রহণের জন্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আজকের পরিস্থিতিতে সংগ্রাম ও সাংগঠনিক কাজের প্রধান অভিমুখ সক্রিয় পার্টি শাখা, বুথ পার্টি টিম ও কমিটি গড়ে তোলা এবং সেগুলির সাংগঠনিক সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে তাকে প্রতিরোধেস্তরে উন্নীত করা। কৃষক-খেতমজুর-অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মই এক্ষেত্রে বড়ো ভিত। জেলায় এ কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এ সময়ে জনগণের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে একদিকে জেলা জুড়ে গণঅর্থসংগ্রহ অভিযানে নামা হয়েছিল অন্যদিকে স্থানীয় ইস্যুগুলিকে নিয়ে পঞ্চায়েত ও পৌর এলাকায় আন্দোলন সংগ্রামও হয়েছে। বিশেষত জূলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আমাদের জেলায় বিভিন্ন গণফ্রন্ট ও পার্টির উদ্যোগে নানা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। জেলা বামফ্রন্টের উদ্যোগে ৬ আগস্ট স্টেশন থেকে কার্জন গেট পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড়ো মিছিল সংগঠিত হয়েছিল।ছাত্রফ্রন্ট এ সময়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি, অরাজকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। অ্যাডমিট কার্ড ও মার্কশিটের জন্য বেআইনিভাবে একটি কোম্পানিকে কোনো টেন্ডার ছাড়াই নিছক চুক্তির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ২২ কোটি টাকার চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। চরম ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের - পরীক্ষার ফলাফল, সার্টিফিকেট ২০১৯ থেকে অধরাই রয়ে গেছে। কোম্পানি রেজাল্ট সম্পূর্ণ করতে পারিনি - ফাইনাল সিট তৈরি হয়নি - বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন হয়নি, ন্যাক মূল্যায়ন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে - দূরশিক্ষা বিভাগের অযোগ্যতা ও পরিচালনগত ত্রুটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তার অনুমোদন তিন বছর হলো প্রত্যাহার করেছে। গত ১৬ আগস্ট ছাত্ররা আন্দোলনে বাধ্য করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডেপুটেশন নিতে ও পরবর্তীতে উপাচার্য ছাত্রফ্রন্টের জেলা নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় বসতে।
কর্মচারী-অধ্যাপক-আধিকারিক-শিক্ষক ফ্রন্টও এই আন্দোলনে তীব্রতা আনতে সাহায্য করেছেন। যুবফ্রন্টও কাজের দাবিতে ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাস্তায় - গত ২২ আগস্ট এই কার্জন গেটেই এই সময়ের মধ্যে তারা সব থেকে বৃহৎ ও স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ সংগঠিত করেছে - মীনাক্ষি মুখার্জি বক্তৃতা করেছেন। তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ট্রেড ইউনিয়নফ্রন্ট এই সময়ে তাদের বিভিন্ন ইউনিয়নগুলির নিজস্ব দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে নানা সমাবেশ, ডেপুটেশন, আন্দোলন ও সম্মেলনে শামিল হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দাবি আদায় করতেও সমর্থ হয়েছে। জেলায় কৃষক ও খেতমজুর ফ্রন্টও ১০০ দিনের কাজের দুর্নীতি সহ নানা স্থানীয় ইস্যুতে পঞ্চায়েত দপ্তর গুলিতে অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি চালাচ্ছে - এখনো অবধি ৬৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে - কোথাও দীর্ঘক্ষণ অবরোধ হয়েছে, কোথাও দুদিন ধরে পঞ্চায়েত অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলায় একটি জিপিতেই ৬৮ লক্ষ টাকার দুর্নীতি সামনে এসেছে। রেগার প্রশ্নে ৪ক ফর্ম পূরণে বাধ্য করা হচ্ছে - মানুষের মেজাজ পাল্টাচ্ছে। শুধুমাত্র সরকারের উপভোক্তা তকমায় বেঁচে থাকা নয়, নিজের গতরের পরিশ্রমে নায্য মজুরির পাওয়ার লড়াই জোড়দার হচ্ছে।কৃষি ও কৃষকের অবস্থা শোচনীয়। আমাদের জেলায় আদানিগোষ্ঠী কৃষি ক্ষেত্রকে দখল করতে মরিয়া হয়ে নেমেছে। মূল্যবৃদ্ধি ও জিএসটি-র আগুনে মানুষ হাঁসফাঁস করছে।বেকারদের কাজ নেই। রাজ্যে কোনো শিল্প-কারখানার তৈরির সম্ভাবনা নেই। রাজ্যে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। এসব থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ও পরিচিতি রাজনীতির সত্তাকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থের ইস্যুগুলির ভিত্তিতে জেলা জুড়ে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে ৩১ আগস্ট আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই কর্মসূচি গ্রহণের আরও তাৎপর্য এ কারণে ১৯৫৯ সালে এই দিনে কঙ্কালসার, ভুখা পেটের মিছিলে নিরীহ ৮০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল-ভূখা পেটের যন্ত্রণা নিরসনে বামপন্থীদের লড়াই তখনো ছিল - আজও নিরবিচ্ছিন্নভাবে জারি আছে। পরবর্তীতে নানা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বামপন্থীরা মেহনতি মানুষের যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল - সেই অধিকার বর্তমানে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়নে এদের কোনো হুঁশ নেই। করপোরেটের সম্পদ, সম্পত্তি বাড়াও আর বালি-কয়লা-গরু পাচার করে, তোলা তুলে ফ্লাটে ফ্লাটে পাহাড়প্রমাণ টাকা মজুত করো। তাই এই দিনটিতে ‘‘গ্রাম থেকে নবান্ন - দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা ভাঙতে’’, মূল্যবৃদ্ধি রুখতে, কাজের দাবিতে, বিভাজনের বিরুদ্ধে ধাক্কা দিতেই এই আইন অমান্য আন্দোলন।
প্রকৃত অর্থে ৩১ আগস্ট কার্জন গেটে কী ঘটেছিল? পার্টি জেলা কমিটি আগেই অনুভব করেছিল যে এক বৃহত্তর গণজমায়েত হতে চলেছে। তাই সিদ্ধান্ত হয় বর্ধমান স্টেশন ও বড়নীলপুর মোড় - দুটি জায়গা থেকে জমায়েত ও সংক্ষিপ্ত সভা করে মিছিল নিয়ে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে কার্জন গেটে আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করা হবে। আগের দিনই আমাদের বর্ধমান শহরে দুই এরিয়া কমিটির নেতৃত্ব ও কর্মীরা গোটা শহরকে লাল পতাকায় সাজিয়ে তুলেছিলেন। বেলা বারোটার মধ্যেই জেলা প্রশাসন বহুস্তরীয় ব্যারিকেড তৈরি ও হাজারের বেশি পুলিশ জড়ো করে। বেলা ৩টের মধ্যে দুটি স্থানেই ব্যাপক জমায়েত হতে শুরু হয়। বড়ো নীলপুর মোড়ের সমাবেশে বেলা তিনটে কুড়ি নাগাদ, একমাত্র বক্তা আমাদের পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বক্তৃতা করেন। দুটি জায়গাতেই আমাদের জেলা নেতৃত্বের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। স্টেশনে অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক সহ অন্য নেতৃত্ব ছিলেন। বড়নীলপুর মোড়ে রাজ্য সম্পাদক ছাড়াও পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায় চৌধুরী ও অঞ্জু কর, আমাদের জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন সহ নেতৃত্ব ছিলেন। পৃথা তাও এখানে জমায়েতে অংশ নেন। প্রশাসন আমাদের কর্মসূচির যাত্রাপথ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত ছিল।
ইতিমধ্যেই স্টেশন থেকে পুলিশ লাইন লালঝান্ডার জনস্রোতে ভেসে গেছে। ঠিক পৌনে চারটের সময় বড়ো নীলপুর মোড় থেকে পার্টির রাজ্য ও জেলা সম্পাদকদের নেতৃত্বে আমাদের মিছিল শুরু হয় - ৫/৭ মিনিট পর স্টেশন থেকেও মিছিল এগুতে থাকে। ঘৃণাভরে মানুষ ‘চোর ধরো জেলে ভরো’ স্লোগান দিতে থাকে। ঠিক সাড়ে চারটা নাগাদ সবে প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে দ্বিতীয় ব্যারিকেড ধাক্কাধাক্কি করতেই পুলিশ অহেতুক টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়তে শুরু করে। নেতৃত্বও তখন সবে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। মহম্মদ সেলিম নিজে মাইকে ঘোষণা করেন - টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে আমাদের ছত্রভঙ্গ করা যাবে না, কর্মীদের প্ররোচনায় পা দিতে নিষেধ করেন। এতদসত্ত্বেও পুলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়তে থাকে, নির্বিচারে বেধড়ক লাঠি চালাতে শুরু করে। নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে - বয়স্ক, মহিলা কাউকেই রেয়াত করেনি। কার্জনগেটে বিধায়ক সহায়তা কেন্দ্র সহ আশেপাশের কিছু বাড়ির ছাদ থেকে সিভিক ভলান্টিয়ার, তৃণমূল কর্মীরা মিছিল লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হওয়ায় মানুষ প্রতিরোধ করতে শুরু করেন। এরপর পুলিশের আক্রমণ রুখেই প্রায় এক ঘণ্টা আক্রান্ত মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। কার্জন গেটে হেরিটেজ আইন ভেঙে স্থানীয় বিধায়ক সহ প্রশাসন বিশ্ববঙ্গ লোগোর যে ‘‘ব’’ টাঙিয়েছিল - সেই লোগো টেনে উপড়ে ফেলে আক্রান্ত মানুষ। তৃণমূল সরকারের সাফল্যের খতিয়ান দিয়ে মমতার ছবিসহ রাস্তার ধারে দেওয়ালে যা লাগানো ছিল সেগুলিও ছিঁড়ে দেয়। নানা দিক থেকে আক্রান্ত মানুষের মেজাজের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে আন্দোলনে।
মানুষের এই মেজাজ দেখেই তৃণমূল এবং তার দলদাস পুলিশ আতঙ্কিত। কমরেডদের এই বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। কিন্তু জেলা পুলিশ কর্তাদের বেপরোয়া, নৃশংস আক্রমণে চার শতাধিক কমরেড সহ পথচারী সাধারণ মানুষ আহত হন। কারো মাথা ফাটে, কারো হাত পা ভাঙে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় যখন কার্জন গেটে কমরেডদের ফিরে যাওয়ার ঘোষণা হয়েছে এবং তখনো পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে - লাঠিচার্জ করছে। কার্জন গেট সংলগ্ন পেট্রোল পাম্প, বাদামতলা, বিসি রোডে দোকান বা বাড়িতে ঢুকে আশ্রয় পাওয়া মানুষের উপরও পুলিশ আক্রমণ চালায়। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায় চৌধুরী, ছাত্রফ্রন্টের জেলা সম্পাদক অনির্বাণ রায় চৌধুরী, মহিলা ফ্রন্টের জেলা সম্পাদক সুপর্ণা ব্যানার্জি, শ্রমিকনেত্রী পৃথা তা, পার্টি জেলাকমিটির সদস্য বিন কাসিম শেখ ও জনা মুখার্জি সহ ১৭৩জন আমাদের নেতা ও কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সন্ধ্যা ৬-১৫-তে রাজ্য সম্পাদক জেলা দপ্তরের সাংবাদিক সম্মেলন করেন ও সঠিকভাবে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিশ চোরেদের পাহারায় কিংবা কনভয় করে বেআইনি সম্পদ পাচারে বা ভিআইপিদের দেখভালে যতটা পারদর্শী কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের ম্যানেজমেন্টে ততটাই অপটু। গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা প্রটোকল এবং আইন রয়েছে তা কোনোটাই পুলিশ মানেনি। ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো ঘোষণা ছিল না, মিছিল কোথাও আটকানো হয়নি। শুরুতেই কেন টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ? পুলিশের এই বেপরোয়া আক্রমণ কার নির্দেশে? তৃণমূল মহাকরণ দখল করতে গিয়েছিল কিংবা বিধানসভা ভাঙচুর করেছিল - কিন্তু আমরা জেলা শাসকের দপ্তর দখল করতে যাইনি।আইন অমান্যে গ্ৰেপ্তারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রিজন ভ্যান ও বাস রাখা উচিত ছিল। পুলিশ-ই প্ররোচনা দিয়েছে - অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই দেখেছেন কি অন্যায়, অমানবিকভাবে পৃথা তা, মেহুলি সহ মহিলা কমরেডদের চুলের মুঠি ধরে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়েছে। মহিলা থানার ভিতরে খুন ও রেপের হুমকি দেওয়া হয়েছে।এমনকি উর্দি পড়ে পুলিশ তৃণমূল কর্মীর ভাষ্য বলেছে। আভাস রায়চৌধুরীকে গ্রেফতারের সময় এক পুলিশ বলছে সিপিআই(এম) আর ক্ষমতায় আসবে না। আভাস রায় চৌধুরী সঠিকভাবেই বলেছেন - "আমরা কেউ বালি বা গোরু চুরি করে ধরা পড়িনি। মানুষের পক্ষে লড়াইয়ের ময়দান থেকে আমাদের তুলে আনা হয়েছে। সরকার বিরোধী লড়াইকে ওরা ভয় পাচ্ছে।"
এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পরিকল্পিত মামলা রুজু করা হয়েছে - তার মধ্যে একটিতে বর্ধমান থানার আইসি ৫৭ জনের বিরুদ্ধে অপরটিতে এক তৃণমূল কর্মী ১১৯ জনের নাম সহ দু-আড়াই হাজার কর্মী, সমর্থকের বিরুদ্ধে। রাজ্য সম্পাদকসহ আমাদের অনেক নেতৃত্বের নামে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এদিন অনেক রাতে মহিলাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। রাতে জেলার বিভিন্ন থানায় পুরুষ কমরেডদের আটকে রাখা হয়।পরের দিনে কিছু জনকে ছাড়া হলেও ৭ জনকে পুলিশ হেফাজতে ও ৩৪ জনকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। একই ঘটনায় দুটি এফআইআর সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু সিজেএম এই বক্তব্যকে সায় দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেছেন। পরবর্তীতে আরও পাঁচজনকে রাতের বেলায় গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়। এর মধ্যে দুজনকে ছেড়ে দিলেও এই লেখা অবধি দুজন পুলিশ হেফাজতে ও ৪২ জনকে জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর আবার শুনানি হবে। গ্রেপ্তার হওয়া কমরেডদের মনোবল অটুট, দৃঢ়।
১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনে পুলিশ লাঠি পেটা করে ৮০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেও লাল ঝান্ডাকে শেষ করতে পারেনি। তৃণমূল-বিজেপি-মাওবাদী মিলে ষড়যন্ত্র-হামলা করে রাজ্যে সরকার বদলেছে এবং মিথ্যা মামলা, হত্যা, হামলা চালিয়েও লাল ঝান্ডার মিছিলকে আটকানো যায়নি। যখন রাজ্যের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়, জনগণের জীবন জীবিকা মারাত্মক সংকটের মুখে তখন তৃণমূলের নেতাদের সম্পদের পাহাড়। মানুষ এই অরাজকতা কখনোই মেনে নেবে না। তাই মানুষকে রক্ষা করতে এই প্রতিরোধের আন্দোলনের মেজাজ আরও তীব্রতর হবে। হামলা, হিংসা, আক্রমণ করে কেউ বামপন্থীদের গতি রুদ্ধ করতে পারবে না। আমরা এগুবোই।