৬০ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ২৩ ভাদ্র, ১৪২৯
কলকাতায় এসএফআই’র দুরন্ত সমাবেশ দিল দুর্বার লড়াইয়ের বার্তা
কলেজ স্ট্রিটে এসএফআই-র সমাবেশ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার রক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু পঠনপাঠন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ছাত্রবিরোধী তথা জনবিরোধী নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং দেশ ও দেশের সংবিধান এবং শিক্ষা বাঁচাতে দুর্বার লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছে এসএফআই। ২ সেপ্টেম্বর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে এক উত্তাল ছাত্রসমাবেশ থেকে এই আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে।
শিক্ষা বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও স্লোগান দিয়ে দেশজুড়ে সর্বভারতীয় জাঠার ডাক দিয়েছে এসএফআই। দেশের বিভিন্নপ্রান্ত ঘুরে দু’টি জাঠা প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গে। সেই উপলক্ষেই এদিন কলেজ স্ট্রিটে সাম্প্রতিককালের নজির সৃষ্টিকারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে উপস্থিত এসএফআই’র সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহ দেশ রক্ষায় এবং দেশের সংবিধানকে বাঁচাতে আন্দোলনকে আরও দুর্বার করার আহ্বান জানান।
এদিন শিয়ালদহ, শ্যামবাজার, হাওড়া এবং সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার প্রভৃতি নানা জায়গা থেকে উত্তাল মিছিল এসে মেলে কলেজ স্ট্রিটে। শিয়ালদহের মিছিলে ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার সহ বিভিন্ন জেলার এসএফআই কর্মীরা। আর হাওড়ার মিছিলে অংশ নেয় হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, দুই বর্ধমান, বীরভূম সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার এসএফআই’র কর্মীরা। এছাড়া হুগলি জেলার এসএফআই কর্মীরা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সামনে থেকে আলাদা করে মিছিল করে সমাবেশে যোগ দেয়। স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের শ্বেত পতাকা সহ ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলগুলি থেকে ওঠে দুরন্ত স্লোগান। এই স্লোগানের পাশাপাশি গানে, কবিতায় আগামীদিনের লড়াইয়ের দুর্জয় বার্তায় কলকাতার রাজপথ যেমন স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল, তেমনি কলেজ স্ট্রিটও যেন আগামী লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্রের রূপ নিয়েছিল।
এদিনের সমাবেশের আগে পশ্চিমবঙ্গে আসা দু’টি জাঠা বিগত ১৫ দিন ধরে ২২টি জেলার ৩,২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কলেজ স্ট্রিটে আসে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ১৭০টি সভা সহ অসংখ্য ছোটো-বড়ো মিছিল, পথসভা সংগঠিত করে এসএফআই।
প্রসঙ্গত, ১ আগস্ট শ্রীনগর এবং কন্যাকুমারী থেকে এসএফআই’র দু’টি জাঠার সূচনা হয়। শিক্ষা, দেশ ও দেশের সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার সহ শিক্ষাকে সর্বজনীন করা, শিক্ষান্তে কাজ সুনিশ্চিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ রুখে দেওয়া, জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করা, লিঙ্গ বৈষম্য ও জাতপাতের বিভেদ দূর করা সহ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে দেশজুড়ে চলছে এসএফআই’র ‘মার্চ ফর এডুকেশন’ নামে জাঠা। সারাদেশ ঘুরে এই জাঠা আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হবে আহ্মেদাবাদে।
২ সেপ্টেম্বর পূর্বভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতের জাঠার সমাপ্তি সমাবেশ উপলক্ষে কলেজ স্ট্রিটের দখল নিয়েছিল আগামী লড়াইয়ের নির্ভীক অভিযাত্রী, এসএফআই’র অকুতোভয় সেনানীরা। শুধু কলেজ স্ট্রিট নয়, এদিন কলকাতা মহানগরীর রাজপথ আন্দোলিত হয়েছিল অগণিত লড়াকু ছাত্র-ছাত্রীর দুরন্ত মিছিলে।
এদিন শুধু বক্তৃতাই নয়, গান-কবিতা-আবৃত্তি ইত্যাদি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বর্ণময় হয়ে উঠেছিল সমাবেশস্থল। সমাবেশমঞ্চে ১৫ দিন ধরে জাঠায় অংশ নেওয়া স্থায়ী পদযাত্রীদের সংবর্ধনা জানানো হয়। এছাড়া সমাবেশ থেকে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে এসএফআই’র তৈরি ‘বিকল্প শিক্ষা নীতি’ প্রকাশ করা হয়।
বিমান বসু তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতির সমালোচনা করে বলেন, এই শিক্ষানীতি গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া থেকে ছিটকে দেবে। শিক্ষায় সরকারি দায় কমানোর জন্য এবং শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করার জন্য কেন্দ্রের এই শিক্ষানীতি। এই সর্বনাশা শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন করছেন বামপন্থীরা।
তিনি এ রাজ্যের প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান শাসকদল দুর্নীতির পাহাড় তৈরি করেছে। প্রতিটি নিয়োগ অথবা ছাত্র ভরতির ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা। চুরির দায়ে তৃণমূলের দু’জন শীর্ষ নেতা এখন জেলে আছেন। সাধারণ মানুষ এই দুর্নীতি থেকে রেহাই চাইছেন। তাই রাজ্যের শাসকদল যে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি করেছে তাকে ভাঙার দায়িত্ব ছাত্রদেরই নিতে হবে।
রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর কুৎসার জবাব দিয়ে বিমান বসু বলেন, বামফ্রন্ট আমলে পরীক্ষার মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গেই নিয়োগ হতো। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে বেশিরভাগ কলেজেই জিতবে এসএফআই। এই ভয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই ছাত্রদের দায়িত্ব হচ্ছে ক্যাম্পাসের বাইরে-ভেতরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা।
এদিনের সমাবেশে এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস বলেন, শিক্ষা নিয়ে মোদি-মমতার একই অবস্থান। কেন্দ্রের শিক্ষানীতিতে কোথাও ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি ব্যবহার করা হয়নি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও শিক্ষানীতি নিয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে না। এ থেকেই প্রমাণ হয় এই দুই দল একই পথের পথিক। কোনোভাবেই এই শিক্ষানীতি মানা হবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের সেনানীরা চায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্ব সরকার নিক। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সরকারি ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে বেসরকারি করার দিকে এগোচ্ছে। এখানে চাকরি বিক্রি হচ্ছে। আর কেন্দ্র রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা ইত্যাদি বিক্রি করে দিচ্ছে। এই চোরদের হাত থেকে রাজ্য ও দেশকে বাঁচাতে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়াও এদিনের সুবিশাল ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় নেত্রী দীপ্সিতা ধর, সংগঠনের রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমান, রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য, সংগঠনের ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক সন্দীপন দেব, আসামের এসএফআই নেত্রী সঙ্গীতা দাস।