৬০ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ২৩ ভাদ্র, ১৪২৯
নগরায়ণের গতি প্রকৃতি
অশোক ভট্টাচার্য
বলা হয়ে থাকে একবিংশ শতাব্দী নগরায়ণের শতাব্দী। কিন্তু সেই নগরায়ণ উন্নত দেশগুলিকে কেন্দ্র করে নয়। এই দেশগুলির উৎপাদনভিত্তিক শিল্পকে কেন্দ্র করেও নয়। এই নগরায়ণ প্রসারিত হচ্ছে ক্রমেই উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলির শহরাঞ্চলে। নিম্নের সারা বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতির একটি চিত্র থেকে অনেক কিছু বোঝা যেতে পারে।
সাল | বেশি উন্নত দেশ | কম উন্নত দেশ | অনুন্নত দেশ |
২০২১ | ১২৭.১ | ৬৫৬.৬ | ১০৮.৮ |
২০৩৫ | ১২৯.৮ | ৭৫৫.০ | ১৪৮.১ |
২০৫০ | ১২৯.৬ | ৮৩৮.৩ | ১৯৫.৪ |
(জনসংখ্যা-কোটিতে)
এই চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছেড বেশি উন্নত দেশগুলি থেকে কম উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হবে কয়েকগুণ বেশি। ২০২১ সালে ৫৪ শতাংশ মানুষ সারা বিশ্বের শহরাঞ্চলে বসবাস করত। ২০৫০ সাল নাগাদ সেই হার বৃদ্ধি পেয়ে হবে ৬৮ শতাংশ। তার অধিকাংশই বৃদ্ধি পাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির শহরাঞ্চলে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে আরও কতগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তা হলো, কম উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিই ক্রমেই তরুণ প্রজন্মের দেশে পরিণত হবে। উন্নত দেশগুলি হবে প্রবীণ নাগরিকদের দেশ। ওপরে উল্লেখিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি অব্যাহত থাকলে উন্নয়নশীল দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ হবে তরুণ প্রজন্মের। সেখানে উন্নত দেশগুলিতে এই হার হবে ১৬ শতাংশ। একইভাবে মধ্যবিত্ত মানুষের হার ও সংখ্যার দিক দিয়েও উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলি থাকবে ওপরের দিকে। এই তরুণ প্রজন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষদের নিয়ে একটি নতুন ভোগ্যপণ্যের বাজারের (consuming section of society) সৃষ্টি হচ্ছে। যাতে, ভারত চীন সহ অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলি থাকবে একটি সুবিধাজনক অবস্থায়।
এই শতাব্দীতে সারা বিশ্বে, বিশেষকরে শহরাঞ্চলে সামাজিক অর্থনৈতিক ও জনবিন্যাসগত একটি বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ একবিংশ শতাব্দীতেই গ্রাম থেকে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেশি। এমনকী ভারতেও যে হারে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই হারে গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যদিও ভারত এমন একটি অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ, যে দেশ এখনও নগরায়ণের গতি বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে বহু উন্নত দেশ তো বটেই, এমনকী বহু উন্নয়নশীল দেশেরও পেছনে রয়েছে। এক সময়ে নগরে বসবাসকারী মানুষের হারের দিক দিয়ে চীন ছিল ভারতের থেকেও পিছিয়ে। সেই দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করে শহর বা নগরে। এমনকী ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়ার শহরে বসবাসকারী মানুষের হার ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে, যা ভারতের থেকে অনেক বেশি। আফ্রিকা মহাদেশের বহু দেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বা হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, যে কারণে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে নগরায়ণ প্রসার লাভ করেছিল, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সেই একই কারণে নগরায়ণ সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রথমত, দেশগুলিতে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে নগরায়ণ প্রসার লাভ করেছিল। যার একটি ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে নগরায়ণ উৎপাদনভিত্তিক শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে হচ্ছে না। এই নগরায়ণ হচ্ছে মূলত কৃষির অলাভজনকতা ও গ্রামীণ অতিরিক্ত কৃষি শ্রমিকের চাপ বহন না করতে পারার ফলে শহরের দিকে অভিবাসী হওয়াতর মধ্য দিয়ে। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের অতিরিক্ত কৃষি শ্রমিকরা যুক্ত হতো উৎপাদনভিত্তিক শিল্পে রোজগারের সাথে। একবিংশ শতাব্দীতে গ্রাম থেকে শহরে মানুষরা অভিবাসী হচ্ছে, তবে তারা উৎপাদনভিত্তিক শিল্পে নয়, যুক্ত হচ্ছে প্রথা বহির্ভূত বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের সাথে। এই কারণে এর থাকে না কোনো ইতিবাচক ভূমিকা। যদিও অর্থনীতিতে প্রথা বহির্ভূত বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
এই প্রসঙ্গেই ভারতের নগরায়ণের গতি-প্রকৃতি বা কিছু পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যের দিকে আসা যেতে পারে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতে যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই তুলনায় শহর বা নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, অনেক উন্নয়নশীল দেশ থেকেও অনেক কম। যেভাবে ভারতে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ৪০ শতাংশ শহরবাসী হতে ভারতকে আরও দুই দশক অপেক্ষা করতে হবে। যদিও ভারতে মেট্রো বা মেগাসিটির সংখ্যা স্বাধীনতার পর অনেকগুলি বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষুদ্র ও সেন্সাস বা অ-বিধিবদ্ধ শহরের সংখ্যা। ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল, এই ১০ বছরে ভারতে অ-বিধিবদ্ধ বা সেন্সাস শহরের সংখ্যা ১৩৬২টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৮৯৪টি। ঐ সময়ে ভারতের মোট শহরের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০০টি। যার ৫০ শতাংশই অ-বিধিবদ্ধ বা সেন্সাস টাউন। ভারতের মোট শহরে জনসংখ্যার (urban population) ৪২.৬ শতাংশ-ই ছিল দশ লক্ষের অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহর বা মেট্রো শহরের। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, বেঙ্গালুরু ব্যতীত ভারতের কোনো মেট্রো মূল শহরের জনসংখ্যা সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে তা পেয়েছে নগরপঞ্জি বা urban oglo meretion এলাকার। মেট্রো শহরগুলিতে আর আগের মতো উৎপাদনভিত্তিক শিল্পায়ন হচ্ছে না। এই শহরগুলি থেকে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পগুলি হয় শহর থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে, অথবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই সমস্ত স্থানে বিকশিত হচ্ছে পরিষেবাভিত্তিক বা উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক, আর্থিক, রিয়াল এস্টেট, তথ্য-প্রযুক্তি কেন্দ্র। যেখানে গ্রাম থেকে অভিবাসী হওয়া উদ্বৃত্ত কৃষিশ্রমিকদের প্রয়োজন হয় অনেক কম।
দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো শহরগুলিতে লম্বালম্বিভাবে নগরায়ণ না হয়ে, হচ্ছে আড়াআড়িভাবে। এর মধ্য দিয়ে শহরের আশেপাশে যাকে পেরি আরবান এরিয়া বলে, সেখানে আপনগতিতে নগরায়িত হয়ে যাচ্ছে মূলত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কার্যাবলিকে কেন্দ্র করে। ভারতের নগরায়ণের কাছে এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। ভারতের অর্থনীতিতে বা মোট গার্হস্থ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শহরগুলির অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষি ক্ষেত্র থেকে ভারতের গ্রামাঞ্চলে অ-কৃষি ক্ষেত্রে বেশি হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে ভারতে অ-কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান ছিল ১৯.২ শতাংশ, ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৩৭.৫ শতাংশ।
ভারতের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কয়েকটি পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যের। গ্রামে কৃষকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল এই ১০ বছরে ৯ কোটি শহুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রায় ৪০০০টি সেন্সাস টাউন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা এক সময়ে গ্রামীণ মানুষ ছিল। ভারতে বড়ো বড়ো শহর বা মেট্রো শহরগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সামান্য। শহরগুলিতে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধির হার অনেক কম, ফলে শহরগুলি গ্রামাঞ্চলের অতিরিক্ত শ্রমবাহিনীকে আকর্ষিত করতে পারছে না।
অন্যদিকে, ভারতে নগরায়ণের প্রসার লাভের ক্ষেত্রে অভিবাসন বা মাইগ্রেশন গত ১০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে খুবই সামান্য। বরং গ্রামগুলির চরিত্র পরিবর্তন হয়ে নগরায়িত হয়েছে; মহানগর থেকে নগর পুঞ্জির জনসংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, সেন্সাস টাউন বা বিধিবদ্ধ শহরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পেরি আরবান এলাকা বা আরবান ফ্রিঞ্জ।
শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ১০ বছরে সেন্সাস টাউনগুলির অবদান সবচাইতে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০১ থেকে ২০১১ সাল - এই ১০ বছরে মূল শহুরে জনসংখ্যা কিন্তু হ্রাস পেয়েছে। ছিল ২৪.১৭ শতাংশ, হয়েছে ২৩.১১ শতাংশ। যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে তা সেন্সাস টাউনগুলির অবদান। পশ্চিমবঙ্গে সবচাইতে বেশি নগরায়িত জেলা হাওড়া, ২০১১ সালে এই জেলার ৫০.৩৬ শতাংশ মানুষের বসবাস করত শহর এলাকায়। ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৬৩.৩৮ শতাংশ। অথচ হাওড়া জেলার শহরবাসীর ৩০.৫৫ শতাংশে ছিল অ-বিধিবদ্ধ শহরগুলির অবদান। অন্যদিকে বিধিবদ্ধ শহরগুলির অবদান ৩৪.৪১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে হয়েছিল ৩২.৮৪ শতাংশ। হাওড়ার উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক অ-বিধিবদ্ধ শহরবাসী যুক্ত হয়েছে হাওড়া জেলার মোট শহর বা নগরবাসীর সাথে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের পর আরও অনেকগুলি গ্রামীণ এলাকা চরিত্রগত পরিবর্তন হয়ে অ-বিধিবদ্ধ বা সেন্সাস টাউনে যেমন পরিবর্তিত হবে, তেমনি অন্তত ৮০টি অতীতের বিধিবদ্ধ শহর ডি-ক্লাসিফাইড হয়ে পুনরায় গ্রামীণ ব্যবস্থাতে পরিবর্তিত হওয়ার পথে যাবে।
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে একটি বিপরীতমুখী নগরায়ণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সাথে যুক্ত থাকে নগরায়ণের কারণ। ভারতে তা হচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি না পেয়েও, অনেকগুলি এলাকা নগরায়িত হয়ে যাচ্ছে। নগরায়ণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও বস্তি - এই তিনটি বিষয় সম্পর্কিত। এর সাথে সম্পর্কিত কর্মসংস্থান সৃষ্টিও। নগরায়ণ হচ্ছে, বস্তিবাসীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান, বিশেষকরে অ-কৃষি ক্ষেত্রে রোজগার বৃদ্ধি সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছে ভারতের নগরায়ণ।