৬০ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ২৩ ভাদ্র, ১৪২৯
বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২২
গরিবের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র
প্রশান্ত নন্দী চৌধুরী
প্রাক্কথন
আমাদের দেশে বিদ্যুতের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় ১৮৯৭ সালে কলকাতা শহরে। সেই নিরিখে ২০২২ ভারতে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের ১২৫তম বর্ষ। আবার এটা স্বাধীন দেশের ৭৫তম বার্ষিকী - খুব ধুমধাম করে আমোদিত পরিবেশে পালিত হচ্ছে অমৃত মহোৎসব। এই তথ্যে বোঝা যায় দেশ যখন পরাধীন ছিল তখনও বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হতো। কারা ব্যবহার করত? বড়োলাটের প্রাসাদে আর রাজন্যবর্গের সুরম্য অট্টালিকা আলোকিত করার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হতো। অল্প কথায় পরাধীন দেশে বিদ্যুৎ ছিল রাজা উজির আমির ওমরাহবৃন্দের বিলাস ব্যসনের পরিষেবা।
১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭ সাল - এই পঞ্চাশ বছর বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে খুব সীমিত স্বচ্ছল মানুষের জন্য। বড়ো শহরের কেন্দ্রস্থলে অথবা যে অঞ্চলে অবস্থাপন্ন মানুষেরা থাকেন, বাস করেন, সেখানে একটি ইঞ্জিন চালিত ডাইনামো বা জেনারেটর চালিয়ে এক আধ কিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ জোগান দেওয়া শুরু হলেও অধিক মাশুলের জন্য সব মানুষ তা ব্যবহার করতে পারতো না।
দেশ স্বাধীন হবার পরে একটি আইন পাশ করা হলো - সেই আইনের নাম বিদ্যুৎ (সরবরাহ) আইন, ১৯৪৮। দেশের সংবিধানে বিদ্যুৎকে রাখা হলো যুগ্ম তালিকায়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি করবে। ১৯৪৮ সালের আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী ছিল সেখানে দৃষ্টি দিলে দেখব - এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল - একটি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অনুন্নত দেশে দ্রুত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো সহ উৎপাদন, সংগঠন ও বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই আইনের পরিসরে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ অধিকার (সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি) এবং রাজ্যে রাজ্যে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি গঠন করা হলো। যেহেতু আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছিল প্রধান লক্ষ্য, তাই এই আইনে কোথাও বলা হয়নি যে, বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে বিদ্যুতের ব্যবসা করে লাভ করতে হবে। এই বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি তিন দশক কাজ করার পরে কত লাভ কত ক্ষতি করেছিল তার বিচারে না গিয়ে এক কথায় বলা যায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণে উন্নতির সাথে সাথে দেশের কৃষকেরা বিদ্যুদয়িত সেচের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষুধাতুর বুভুক্ষু নিরন্ন ভারতকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করে তুলতে পেরেছিল। আমদানি করা পচা চাল গমের পরিবর্তে ভারতীয় জনগণ খাদ্যে উদ্বৃত্ত জাতিতে পরিণত হলো। বর্তমান ভারতের খাদ্য নিগমের গুদামে দুই বৎসরের বেশি সময়ের খাদ্যশস্য মজুত আছে।
স্বাধীনতা-উত্তর তিন দশকে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটা ভূমিকা নিতে পেরেছে তার সঠিক মূল্যায়ন না করেই ১৯৮৫ সালে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে বলা হলো তোমাদের অন্তত তিন শতাংশ উদ্বৃত্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার থেকে ঋণের শর্ত অনু্যায়ী ভরতুকি বন্ধ করে উদ্বৃত্তের সংস্থানের কথা বলা হলো। এই সময়ের পরে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে ভারত সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রকে প্রাইভেট করার জন্য ডেকে আনা হলো - এনরন, অগডেন, এ.ই.এস.-এর মতো বিদেশি কোম্পানিগুলিকে। আর বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে অযোগ্য অপদার্থ আখ্যা দিয়ে সেগুলিকে তুলে দিয়ে কোম্পানি করার জন্য হরিয়ানা, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশকে গিনিপিগ করা হলো। রাজ্য সরকারের হাত থেকে বিদ্যুৎ মাশুল নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আইন প্রণয়ন করা হলো। তার পরের ধাপ বিদ্যুৎ বিল, ২০০০। বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩-এর কাহিনি অনেকেই জানেন। তাই সেগুলি সবিস্তারে আলোচনা না করে বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ থেকে বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২২-এ আসার আগে অতি প্রয়োজনীয় কথা না বললে আগ্রহী পাঠকের জিজ্ঞাসা থেকে যাবে।
বিদ্যুৎ আইন ২০০৩-এ কী ছিল?
অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার এই আইন করার জন্য ২০০০ সাল থেকে মোট ১০টি খসড়া করে - বিদ্যুৎ কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতায় এতগুলি খসড়া করতে হয়েছিল। সমালোচনার অবকাশ রাখে যে, সংসদের বাইরে আন্দোলন হলেও এই বিল পাশ করার সময়ে বিরোধী সাংসদগণের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বাসুদেব আচারিয়ার ভিন্ন নোট গৃহীত হয়নি।
বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে প্রাইভেট করে দেওয়া। এখানে প্রশ্ন আসে অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগে কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে খুব বড়ো পার্থক্য নেই। তাহলে স্বাধীনতার পরেই প্রাইভেট করে দেওয়া হলো না কেন? কেন বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি গড়ে তোলা হলো ? এই প্রশ্নের দুটি উত্তর - বিদ্যুৎ শিল্পটি একটি পুঁজি নিবিড় শিল্প। উৎপাদন কেন্দ্র থেকে গ্রাহকের দোরগোড়া অবধি অবকাঠামো, পরিকাঠামো গড়ে তুলে সংস্থাপন কাজটি অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাম্রাজ্যবাদের অপসারণের পরে বিদেশি পুঁজি অনিশ্চিত ক্ষেত্রে লগ্নি করতে আসবে না। আর দেশীয় পুঁজিবাদ তখন শৈশবে নয়, মাতৃগর্ভে। তাই এই পুঁজি বিনিয়োগ করতে হলো রাষ্ট্রকে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা জানে পুঁজিবাদকে বিকশিত করা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সে কাজ তারা গত ৭৫ বছরে করেছে। পৃথিবীর দশটি বৃহৎ পুঁজিপতির তালিকায় এখন ভারতের দুই জন আছে। এখন এই তাগড়া পুঁজিপতিদের হাতে দেশের গরিব মানুষের রক্তে ঘামে গড়ে তোলা উৎপাদন, সংবহন ও বণ্টন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য আইন পালটানোর দরকার। সেই কাজ শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। ২০০৩ সালে আইন পাশ। ২০০৩ থেকে ২০২২ অবধি সময়ের মধ্যে কী এমন হলো যে, কংগ্রেস-বিজেপি’র প্রিয় পাত্রদের হাতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া গেল না?
বাদ সাধল ২০০৪-এর ৬১টি বাম সাংসদ
২০০৩-এর আইন যথেষ্ট ছিল - বিদ্যুৎ পর্ষদ ভেঙে কোম্পানি করে ওই কোম্পানিগুলির শেয়ার পছন্দ মতো পুঁজিপতিকে নামমাত্র মূল্যে বেঁচে দেওয়া। কিন্তু প্রথম ইউপিএ সরকারের অস্তিত্ব নির্ভর ছিল ওই ৬১টি বামপন্থী সাংসদের সমর্থনের উপর। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের অন্তিম সংস্কার সম্ভব হলো না। পরন্তু ওই বিদ্যুৎ আইনের দুটি সংশোধনী ইউপিএ-১ সরকারকে পাশ করাতে হলো। যার ফলে গ্রাম-শহরের গরিব মানুষ এবং কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জীবনে এখনও বিদ্যুৎ পরিষেবা বজায় আছে। এই সংশোধনী দু'টির প্রথমটি বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ এর ৬নং ধারা। যে ধারায় বলা হয়েছিল গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব নেবে রাজ্য সরকার অথবা পঞ্চায়েত অথবা গ্রাহক সমবায় সমিতিগুলি। বামপন্থীদের দাবিতে ওই ধারা সংশোধন করে বলা হলো, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ওই পরিবর্তন প্রস্তাবের সাথে সাযুজ্য রেখে গৃহীত হলো রাজীব গান্ধী গ্রামীণ বিদ্যুৎ প্রকল্প। এখন রাজ্যের সমস্ত গ্রামে প্রায় একশো শতাংশ গৃহে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।
৬ নং ধারা ছাড়া আর যে ধারাটি সংশোধন হলো সেটি হচ্ছে ৬১(জি) ধারা। ওই ধারায় বলা হয়েছিল পারস্পরিক ভরতুকি কমানো এবং বিলুপ্ত করা হবে। বামপন্থীদের চাপে বিলুপ্ত কথাটি কেটে দিতে হলো। গ্রামের গরিব মানুষ সহ কৃষকেরা স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে এখনও বিদ্যুৎ পাচ্ছে - তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বামপন্থীদের। কংগ্রেস বা বিজেপি’র নয়। কিন্তু বামপন্থীদের ছোটো বড়ো কোনও নেতারাই এই কথা প্রচার করেন না। যার ফলে মানুষ জানতে পারেন না কারা গরিব মানুষের স্বার্থে কাজ করেন আর কারা পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করেন।
প্রসঙ্গান্তর হলেও উল্লেখ করা উচিত, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিন্দুমাত্র সংস্রব রাখেনি,মুচলেকা দিয়ে খালাস পেয়েছে - তারাই ঢাক ঢোল পিটিয়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালনের অবকাশে - আত্মনির্ভর ভারতের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেচে দিচ্ছে এবং এটাই জাতীয়তাবাদ - এটাই দেশপ্রেম বলে নতুন অভিধান রচনা করছে।
বিদ্যুৎ (সরবরাহ) আইন, ১৯৪৮-এর পরিবর্তন
পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন, ৫২ বছরের আইন অনুযায়ী চলে আসা দেশে বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রসারের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরেও বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি তুলে দেওয়ার জন্য অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার অজুহাত খাড়া করলো - বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি ২৬,০০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন-বণ্টনের হিসাবে লোকসান হলেও ওই বিদ্যুৎ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং জাতীয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে যে অসামান্য অবদান রেখেছে তার অর্থমূল্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ওই ক্ষতি নগণ্য। ইংরেজি প্রবাদ অনুযায়ী একটি কুকুরকে মারার জন্য কুকুরটি পাগলা হওয়ার অজুহাত খাড়া করার সাথে তুলনীয়।
মার্চ, ২০২২ এর শেষে হিসাবে দেখা যায় বিতরণ কোম্পানিগুলির দেনা রয়েছে ১.১ লক্ষ কোটি টাকা। আর ওই বিতরণ কোম্পানিগুলির সরকারের নিকট ভরতুকি ও বিল বাবদ পাওনা ১.৪ লক্ষ কোটি টাকা। তাহলে লোকসানে চলছে বিতরণ কোম্পানি নয় - সরকার। বিদ্যুৎ পর্ষদ তুলে দেওয়ার যুক্তি মানলে তো সরকারগুলিকেই তুলে দিতে হয়। এতেই প্রমাণিত হয় শুধুমাত্র মুদ্রার অঙ্কে ক্ষতি হিসাব করে বিদ্যুৎ পর্ষদ তুলে দেবার জন্য বিদ্যুৎ (সরবরাহ) আইন পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ প্রণয়ন কোনও যুক্তিসঙ্গত পন্থা ছিল না।
মোদি সরকার - আবার বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০১৪ প্রস্তাব
স্বাধীনতার পরে প্রণীত বিদ্যুৎ আইন পরিবর্তন করার ভাবনা এসেছিল ৫২ বছর পরের অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের রাজত্বে। ওই আইন ঠিক ছিল না, আবার এগারো বছরের মাথায় পরিবর্তন করতে হবে - এটা বুঝতে নরেন্দ্র মোদির লেগেছে ছয় মাস। পশ্চিমবঙ্গের এক বিদ্যুৎ গ্রাহক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মন্ত্রকে তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী প্রশ্ন পাঠায় বিদ্যুৎ আইনের সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং কী কী সংশোধন করতে হবে - এটা নিরূপণের জন্য সরকার কি কোনো সমীক্ষা করেছিল? কোনও বিশেষজ্ঞ টিমের দ্বারা পর্যালোচনা করার জন্য প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানীদের মত নিয়েছিল? বিদ্যুৎ দপ্তর সব প্রশ্নের একই উত্তর দিয়েছে, সেটি হচ্ছে - ‘না’।
ওই বিলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় সমন্বয় কমিটি (NCCOEEE) বিদ্যুৎ মন্ত্রকের নিকট বার বার আবেদন করে। মন্ত্রী ও তাঁর দপ্তর আলোচনা এড়িয়ে যায়। ২০১৫ এর নভেম্বরে কেরালার কোচিন শহরে বিদ্যুৎ মন্ত্রীদের সম্মেলন আহুত হয়। ওই সম্মেলন স্থল ছিল তিন দিকে সমুদ্রে বেষ্টিত একটি হোটেলে। কেরালা, তামিলনাড়ু সহ প্রায় ১৫০০০ বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ার সম্মেলন স্থল ঘেরাও করার পরে তৎকালীন মন্ত্রী আলোচনায় সম্মত হন। কোচিনে এবং পরবর্তীকালে দিল্লিতে কয়েক দফা আলোচনা হয়। কয়েকটি সংশোধনী গৃহীত হয়। কিন্তু ২০১৯-এ দ্বিতীয় বারের মোদি সরকার নতুন বিদ্যুৎ মন্ত্রী নিযুক্ত করে ওই সব পরামর্শ নস্যাৎ করে দেন।
বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০
সারা দেশে লকডাউন ঘোষিত হয় মার্চের শেষে। সারা দেশ গৃহবন্দি। ১৭ এপ্রিল নতুন বিদ্যুৎ বিল প্রকাশ করে ৫ মে-এর মধ্যে মতামত চাওয়া হলো - তাড়াহুড়োর বহর অনুমেয়। এরপর এলো বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২১ - যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল শুধু বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় মঞ্চ নয়, সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সংগঠনগুলি। সংযুক্ত কিষান মোর্চা তাদের এক বছর ব্যাপী ঐতিহাসিক সংগ্রামে তিনটি কৃষি আইনের সাথে বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবিতে অনড় থাকে। ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী সংযুক্ত কিষান মোর্চাকে লিখিতভাবে জানালেন - বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে আলোচনা না করে এই বিল সংসদে পেশ করা হবে না।
আরএসএস জন্মলগ্ন থেকে দেশের মানুষের সাথে শঠতা আর বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী মন্ত্রী বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল কোথাও প্রকাশ না করেও বলে চলেছেন বর্ষাকালীন সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাশ করানো হবে। সংসদ অধিবেশন শুরু হবার সময় যে কার্যসূচি দেওয়া হলো তার ৩৪টি বিলের মধ্যে এই বিল নেই। গত ২ আগস্ট বিদ্যুৎকর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় সমন্বয় কমিটি দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে একটি জাতীয় কনভেনশন ডাকে। বক্তা হিসাবে এই বিল বিরোধী দলগুলির সাংসদ, শ্রমিক-কৃষক ও শ্রমজীবী অন্যান্য সংগঠনের নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ করা হয়। ওই কনভেনশন থেকে ঘোষণা করা হয় - বিলটি সংসদে পেশ করার দিনে দেশ জুড়ে বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠনগুলি কর্মবিরতি পালন করে বিক্ষোভে শামিল হবেন।
২ ডিসেম্বর বিলটি কোথাও প্রকাশ না করে মন্ত্রীসভায় - অনুমোদিত হয়। ৩ আগস্ট বিলটি মুদ্রিত হলেও সাংসদদের নিকট কপি দেওয়া হয় না। ৩-৪ সংসদ চললেও সাংসদগণ বিলের কপি পাননি। ৫ আগস্ট বিকালে বিলটির কপি সাংসদগণের কাছে পাঠানো হয়। তখনও সংসদের কার্যসূচিতে বিলটি আসেনি। ৬ আগস্ট সংসদের ছুটির দিনে ৮ আগস্টের কার্যসূচিতে উল্লেখ করা হয় বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২২ লোকসভায় উত্থাপিত হবে। ওই বিলটি যখন উত্থাপিত হচ্ছে তখন ভারতের প্রায় দশ হাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, দপ্তরগুলিতে ১২ লক্ষ বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ার বিক্ষোভ করছেন। ওই দিন সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে একটি অতিরিক্ত কার্যসূচি প্রকাশ করা হয় - যেখানে লেখা ছিল বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২২ উত্থাপন, ভোটিং এবং পাশ করানো হবে। বিজেপি বাদে সমস্ত সাংসদ যখন এই তঞ্চকতায় ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ তখন মন্ত্রী ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মতো স্পিকারকে বলছেন - আমি বিলটিকে শক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানোর প্রস্তাব করছি।
কী আছে এই বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিলে? কেন এত বিরোধিতা?
সকলেই জানেন ভারতের সংবিধানে বিদ্যুৎ যুগ্ম তালিকার বিষয়। রাজ্য ও কেন্দ্রের অধিকার স্পষ্ট। এটাই আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি। এই বিলের প্রস্তাব অনুযায়ী রাজ্যের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মোবাইল পরিষেবায় যেমন একই এলাকায় একাধিক কোম্পানি কাজ করে - তেমনই একই এলাকায় একাধিক বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি কাজ করবে। মানুষ পছন্দ মতো কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে। বলা হচ্ছে - এটা কোনও নতুন বিষয় নয়। বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩-এও এটা ছিল। যেটা গোপন করা হচ্ছে সেটা হলো - মোবাইল কোম্পানিগুলি নিজস্ব সঞ্চার ব্যবস্থা ব্যবহার করে একই এলাকায় কাজ করে। তাদের টাওয়ার থেকে ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা এমনকী ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড ভিন্ন ভিন্ন। গ্রাহক পরিষেবার গুণগত মান নিজস্ব প্রযুক্তি ও রক্ষণাবেক্ষণ মানের উপর নির্ভর করে। বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ এও বলা হয়েছিল একই এলাকায় একাধিক কোম্পানি তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। অর্থাৎ নতুন যে কোম্পানি আসবে তাকে বিনিয়োগ করতে হবে। এখানে সেটি সম্পূর্ণ গোপন করে বলা হচ্ছে বর্তমান নেটওয়ার্কে যে কেউ ঢুকতে পারবে - অর্থাৎ তাকে কোনও বিনিয়োগ করতে হবে না। ৩৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী দেশের বিদ্যুদয়িত এলাকার ৯৯ শতাংশ মালিকানা রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত বিতরণ কোম্পানির - রাজ্য সরকারগুলির সম্মতি ব্যতিরেকে সেই নেটওয়ার্কে আদানি আম্বানি, টম, ডিক, হ্যারি ঢুকে পড়বে? রাজ্য সরকারের ক্ষমতা একটি বাড়ির গেটের দারোয়ানের থেকেও কম থাকবে? এটাই যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন?
এবার আসা যাক লাইসেন্স দেবার প্রক্রিয়া নিয়ে। বলা হয়েছে, কোনও এলাকায় বিদ্যুৎ বণ্টনের ব্যবসা করতে হলে ওই এলাকার বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে আবেদন করতে হবে যদি ৬০ দিনের মধ্যে আবেদনের নিষ্পত্তি না হয় তাহলে ধরে নেওয়া হবে লাইসেন্স দেওয়া হয়ে গেছে। এই গোঁয়ারতুমি তো পাড়ার দাদাগিরির মতো। বিদ্যুৎ শিল্পের মতো ঝুঁকিবহুল বিতরণ ব্যবস্থায় “শ্যাম বাবুদের গোয়ালা”ও বণ্টনের লাইসেন্স পেয়ে যাবে? এ তো “শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে”র চেয়েও অবিমৃশ্যকারিতা। “এরিয়া অব সাপ্লাই”কী হবে? একটি রাজ্য বা তার কয়েকটি বা একটি জেলা বা একটি পৌরসভা বা পৌরনিগম এলাকা? এমন বিধিনিষেধ না থাকায় শুধুমাত্র লাভজনক গ্রাহক ঘনত্বের এলাকায় বেশি মুনাফার জন্য একাধিক কোম্পানি আসবে, আর গ্রামে কেউ যেতে চাইবে না। বলা হয়েছে সমস্ত বণ্টন কোম্পানিকে, সর্বজনীন বণ্টনের বাধ্যবাধকতা পালন করতে হবে। যেহেতু গ্রামীণ এলাকার সমগ্রটাই রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন কোম্পানির। তাই লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা - নেটওয়ার্ক উন্নয়ন দূরের কথা - রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও উঠবে না। সবটাই গ্রামীণ এলাকা বলে সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশ পারস্পরিক ভরতুকী দিয়েও গার্হস্থ্য গ্রাহককে যে দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে সেটা তার সাধ্যের বাইরে। তেমনি হবে কৃষি কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকের অবস্থা। সরকারের ভরতুকি দেবার সামর্থ্য থাকবে না। তাই গ্রামগুলিতে লাইন থাকলেও বিদ্যুৎ প্রবাহের নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ এই বিলে বলা আছে বিতরণ কোম্পানি - উৎপাদন কোম্পানি বা সংবহন কোম্পানির প্রাপ্য মেটাতে না পারলে পেমেন্ট সিকিওরিটি ধারা প্রয়োগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এবং বন্ধ করে দেবে লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার। আমাদের কৃষক বন্ধুরা এটা বুঝেই এই বিলের বিরোধিতা করেছিলেন।
খরচ জনগণের, মুনাফা পুঁজিপতিদের
৫৬ ইঞ্চির বিশ্বগুরু - শীর্ষকটিকে বাস্তবায়ন করছেন প্রাক্ পদক্ষেপে যার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা কর্মীদের লড়াই জয়ী হতে পারেনি। বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের লড়াই এখনও পরাস্ত হয়নি - তার জন্য বড়ো কৃতিত্ব কৃষক বন্ধুদের সার্বিক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। ইস্পাত কর্মীরা এখনও লড়াইয়ের ময়দানে আছেন। কয়লা কর্মীরাও বুক ফুলিয়ে আছেন।
আত্মনির্ভর ভারতের নামে জাতীয় সম্পদ নর্দমায় ঢালার পাইপ লাইনে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন-সংবহন ব্যবস্থাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সবই হচ্ছে জনগণের অর্থে পুঁজির সেবা।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে একই এলাকায় একাধিক কোম্পানি বিদ্যুৎ দিতে এলে প্রয়োজন আরও বিনিয়োগ। করোনা কালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বরাদ্দ করেছিলেন সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকা। বিগত বাজেটে বরাদ্দ করেছিলেন ৩.০৬ লক্ষ কোটি টাকা। এর সিংহভাগ ব্যয় হবে। বর্তমান মিটারের পরিবর্তে স্মার্ট মিটার। বর্তমান মিটারগুলির দাম ৫০০/৬০০ টাকা। এর পরিবর্তে বসাতে হবে স্মার্ট মিটার যার দাম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বর্তমান আইন অনুযায়ী ওই মিটার পালটানোর দায় গ্রাহকের উপরে চাপানো চলবে না। কেন্দ্রীয় সরকার ৩১ মার্চ, ২০২৫ সময় সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে সব প্রচলিত মিটার পালটে স্মার্ট মিটার করতে হবে। এই ব্যয়ের দায়ও যাতে নতুন আসা কোম্পানির উপরে না পড়ে তার জন্য ব্যয়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার তুলে নিয়েছে - জনগণের করের টাকায়। পুঁজিবাদের ঘোড়াকে ঝড়ের বেগে চালানোর জন্য ঘোড়ার জিন ও চাবুক কিনে দেওয়ার দায়ও ভারতের জনগণের।
শেষ হবে সর্বজনীন বিদ্যুৎ যুগ
এই বিলের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিফিকেশনের বা বিদ্যুদয়নের যুগ শেষ হবে - আসবে ডি-ইলেক্ট্রিফিকেশনের যুগ বা অবৈদ্যুতিকীকরণের যুগ। এখনও কুড়ি বছর আগে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে রাতে বিদ্যুৎ থাকত না। এটা গল্প নয়, বাস্তব।
এই বিল পাশ হলে আবার ফিরে আসবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হাহাকার। খাদ্য স্বয়ম্ভর দেশে আবার শুরু হবে খাদ্য সংকট।
পথ খোলা আছে একটাই। সে পথ মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের। এই লড়াইতে মোদি বাহিনীকে পরাস্ত করতে হলে সাথে চাই সব স্তরের বিদ্যুৎ গ্রাহককে। সেই রণধ্বনি নিয়ে বিদ্যুৎ কর্মী ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠনগুলি ২ নভেম্বর সমবেত হবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসীতে। সেদিনের সমাবেশ শুধু বিদ্যুৎ কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার ফেডারেশনের সদস্যদের। আহ্বান হবে সব স্তরের গ্রাহককে ২৩ নভেম্বর দিল্লিতে সমবেত হবার। স্লোগান হবে “রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ক্ষেত্র বাঁচাও - ভারত বাঁচাও”।
“বিদ্যুতের অধিকার মানবিক অধিকার
এ অধিকার ছাড়ছি না - ছাড়ব না”।