৫৯ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ / ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
৩০ নম্বর ওয়ার্ড
বেআইনি নির্মাণ নিয়ে নিস্পৃহ পুরসভা সুপেয় জল, সুনিকাশি, কাজের দাবিতে মুখর মানুষ চাইছেন শাশ্বতীকেই
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কলকাতার উন্নয়নের স্টিয়ারিং বাম দিকে ঘুরিয়ে দেবার বামফ্রন্টের যে আহ্বান তা সাড়া ফেলেছে জব চার্নক প্রতিষ্ঠিত এই শহরের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব প্রান্ত জুড়েই। প্রচারে পূর্ব কলকাতা ঘেঁষা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ে সিপিআই(এম) প্রার্থী শিক্ষিকা শাশ্বতী দাশগুপ্ত বলছেন, বাইরের চাকচিক্য বজায় রাখার লোকদেখানো পরিষেবা নয়, মানুষের পাশে থাকার কথা। মানুষ শুনছেন সায় দিচ্ছেন, পাল্টা প্রশ্ন করছেন তাঁকে। সব মিলিয়ে শিক্ষিকা হিসেবে সুপরিচিত শাশ্বতী সাড়া পাচ্ছেন মানুষের কাছ থেকে। মানুষ এখন পূর্ব অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে মাপছেন তাদের চাওয়া পাওয়ার ভাঁড়ারের পূর্ণতা অপূর্ণতা।
উত্তর কলকাতার ফুলবাগান থেকে খাল পোল আর উত্তরের রেল ব্রিজ থেকে নারকেল ডাঙ্গা নর্থ রোড সংলগ্ন প্রায় বিস্তীর্ণ এলাকা ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। এখানে মূলত নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। কারণ, ভৌগোলিক দিক থেকে এই ওয়ার্ডের প্রায় ৬০ শতাংশ জুড়েই বস্তি। দু’বছর পেরনো মহামারী প্রবলভাবে থাবা বসিয়েছে এখানকার বাসিন্দাদের রুজি রোজগারে। সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়েছে বিভিন্ন পুর সমস্যার ক্ষেত্রে ‘ম্যান মেড’ অবহেলা। ‘ম্যান ম্যাড’ শব্দটা অবশ্য তৃণনেত্রী এবং তাঁর দলবলের উদ্দেশে এখানকার বাসিন্দাদের ব্যঙ্গের লব্জ। কেন? তার মূল কারণ বেহাল নিকাশি, কাজের হাহাকার আর বেআইনি নির্মাণ আর সন্ত্রাস।
এখানে মূলত বস্তি এলাকায় এবং অন্যত্র খাজনার জমি বা কেনা জমিতে নির্মাণ হচ্ছে নিয়ম নীতির বালাই না রেখেই। তাই দুর্নীতির উৎস হিসেবেই এই ধরনের নির্মাণকে চিহ্নিত করছেন এলাকার মানুষ। অভিযোগ, এই পুরবোর্ডের আমলে জি প্লাস ফোর বা চারতলার অনুমোদনকে অনায়াসে নির্মাণের সময় ৬ তলা করে নেওয়া যাচ্ছে পুরসভার সঙ্গে বা পৌরপিতার সঙ্গে যোগসাজশে। স্বাভাবিকভাবেই অসম নির্মাণজনিত পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে নিকাশি থেকে পানীয় জল এবং পয়প্রণালীর উপর। বস্তিতে এবং দীর্ঘ এলাকাজুড়ে পরের পর ভার্টিকাল বা উল্লম্ব নির্মাণ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ ব্যবস্থাকে। তাই তুলনায় নিচু এলাকায় থাকা মানুষ লাগাতার শিকার হচ্ছেন জমা জলের সমস্যার। আবার তৈরি ফ্ল্যাটে জায়গা পাচ্ছেন না পুরনো বাসিন্দা - রয়েছে এমন অভিযোগও। কিন্ত সন্ত্রাসের জেরে মুখ খুলতে পারছেন না তারা। ক্ষোভ তাই সর্বস্তরেই। সেকথা তাঁরা বলছেনও বাম প্রার্থী শাশ্বতীকেই। কারণ বাম প্রার্থীর, প্রার্থীদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি।
সিপিআই(এম) প্রার্থী শাশ্বতী দাশগুপ্তের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত কুশল বিনিময়।
বাম আমলে তৈরি বাগমারি জলাধার থেকে জলের জোগানের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড বা সরকার এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি। তাই জল পেলেও লোকসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির জেরে জলের হাহাকার তীব্র হচ্ছে এলাকায়।
বারংবার ডেপুটেশন দেওয়া হলেও আবার কাউন্সিলর সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করছেন। কারণ তার সে দায় নেই, তার হাতে আছে মুখ বন্ধ করার উপায়। এলাকার পুরসভা পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির দশা বেহাল। অভিযোগ, বাম আমলে জনস্বাস্থ্য ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গরিব এবং নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে বিকেন্দ্রীকৃত চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা এখানে এখন তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাতে। এমনকি বড়ো স্তরের হেল্থ সেন্টারটি ধুঁকছে।
তৃণমূলের পুরনো কাউন্সিলরের কাছে গিয়ে কাজ চাইতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এমন ঘটনাও বলছিলেন নারকেল ডাঙ্গা পোস্ট অফিসের কাছে থাকেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ। তার স্বামী টিউশন করেন। বাড়িতে কিশোর বয়সী সন্তান ক্লাস নাইনের ছাত্র। ছেলের টিউশন ফি মাসে ২ হাজার। লকডাউনের পরিস্থিতিতে প্রবল চাপে থাকা অবস্থায় স্নাতক এই গৃহবধূ ছোটোখাটো কাজের আরজি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অন্য কাজ তো দূরের কথা, ১০০ দিনের কাজ পর্যন্ত কাউন্সিলর দেননি। শাশ্বতীর কাছে তিনি তার দুঃখের কথা বলছিলেন। শাশ্বতী তাকে বললেন কলকাতা পুরসভায় ২৮ হাজার শূন্যপদের কথা। বামফ্রন্ট পুরবোর্ড ক্ষমতায় এলে তা পূরণ করার কথা যোগ্যতার ভিত্তিতে। বলছিলেন বামপন্থীদের ‘আমি নয় আমরা’ ভিত্তিক উন্নয়নের ভাবনার কথা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন ওই গৃহবধূ। এমন অবস্থা এই ওয়ার্ডের অন্যত্রও।
মানুষের আরও অভিযোগ রয়েছে এখানকার উন্নয়নের বিভিন্ন কাজ বা প্রকল্পের ক্ষেত্রে দল বেছে পরিষেবা দেবার। অসহায় মানুষের হাতে পৌঁছচ্ছে না বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা। ধুঁকছে এমনকি পুরসভার স্কুলও। শিক্ষার অধিকারের মতো অধিকারকেও সংকুচিত করা হচ্ছে। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ সচেতন মানুষ।
৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তিগুলোতে যেমন রয়েছে জঞ্জাল এবং অপরিচ্ছন্নতা তেমনি রয়েছে বেকারি আর দারিদ্র্যের করুণ কাহিনি। কিছু কিছু ঘরে অবশ্য ছোটোখাটো কাঠের কাজ মেশিন চালিয়ে চললেও মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য সিইএসসি কোম্পানির বাড়তে থাকা বিদ্যুৎ বিল লাভের মুখ দেখতে দিচ্ছেনা এইসব ছোটো ব্যবসায়ীদের। বস্তির প্রবেশ পথগুলোতে রয়েছে বিদ্যুৎবাহী তারের অবিন্যস্ত ব্যবস্থা। যা বিপদের ইঙ্গিত। মহেশ বারিক লেন, অটলবিহারী বোস লেন, কাঁকুড়গাছি ডি ব্লক এসমস্ত বস্তিতে হোসিয়ারি শিল্প সহ অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছোটো ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মালিকের ঠিকমতো দিন গুজরান হয় না, তো তার কর্মচারীদের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। চাই বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা। নারকেলডাঙ্গা মেইন রোড থেকে স্যার গুরুদাস ব্যানার্জি রোড এলাকায় কোথাও জল জমুক এটা আর চাইছেন না মানুষ। তাই বৃষ্টির মধ্যেও প্রচারে থাকা শাশ্বতীর জন্য খুলে যাচ্ছে অনেক বন্ধ দরজা, যেখানে টালির চালে নিম্নচাপের ধীরগতির বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ স্পষ্ট বাম প্রার্থীর প্রতি মানুষের অব্যক্ত সমর্থনের বার্তার মতোই।