৫৯ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ / ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
৬ ডিসেম্বর দিনটিতে শপথঃ দেশের ঐক্য-সংহতি-ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করবই করবো
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশজুড়ে হিংসা সংশয় এবং সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করে আরএসএস-বিজেপি ভারতের ঐক্য সংহতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে নষ্ট করতে চাইছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং রাজ্যে রাজ্যে মানুষের সংহতি-সম্প্রীতি চূর্ণ করতে চাইছে। বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে মানুষে মানুষে ঐক্যের মেলবন্ধনকে সুরক্ষিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। খেটে খাওয়া মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একাজ বামপন্থীদেরই করতে হবে। ৬ ডিসেম্বর দিনটি তাই শপথ নেবার দিন। কলকাতার ধর্মতলায় লেনিন মূর্তি প্রাঙ্গণে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় একথা বলেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ।
প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পর। সক্রিয়ভাবে দেশজুড়ে অস্থিরতার যে আবহ কায়েম করতে চাইছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আরএসএস-বিজেপি সরকার তাঁকে শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নয়, রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করার আহ্বান ধ্বনিত হয় এদিনের সভায়। সভার সূচনায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের দেশে সংঘটিত হয়েছিল। এই দিনটি সংবিধান প্রণেতা বি আর আম্বেদকরের জন্মবার্ষিকী। আরএসএস-বিজেপি তার হনুমান বাহিনীসহ সমস্ত বাহিনীকে নিয়ে এই দিনটিকে নির্দিষ্ট করেছিল সংবিধানের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করার জন্য।
দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, কচ্ছ থেকে কোহিমা আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী, বিভিন্ন বর্ণের, ধর্মের মানুষের মধ্যে অতীতে যে পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজ করত তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সংশয় ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হানাহানি এই সময়ে সংঘটিত হয়েছে। জাতিদাঙ্গা হয়েছে, দলিত মানুষদের আক্রমণ-হত্যা হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। যেভাবে এসব ঘটছে তা প্রমাণ করে দিয়েছে ৬ ডিসেম্বর অন্য দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
বিমান বসু নাগাল্যান্ডের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, বিজেপি-আরএসএস যখন মানুষের অধিকার হরণ করবার জন্য সব রকমের কর্মপ্রয়াস পরিচালনায় তৎপর থাকে, তখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যারা জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়, কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। আধা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে গুলি চালিয়ে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনার কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট নেই। গোয়েন্দা রিপোর্ট না থাকলে এই ঘটনা ঘটতে পারে না। এটা তখনই সম্ভব যখন আমাদের দেশে আরএসএস’র পরিচালনায় বিজেপি ফ্যাসিবাদী কায়দায় এই ধরনের ঘটনা ঘটাবার জন্য তৎপর থাকে।
তিনি বলেন, আমাদের শক্তি যাই থাক না কেন আমরা এই কথা বলতে চাই, ভারত ভূমিতে যারা বাস করেন তিনি যে ধর্মের যে জাতি, বর্ণ, জনগোষ্ঠীর মানুষই হোক না কেন - তারা ভারতবাসী। আমরা মানুষের ঐক্য-সংহতি সংহতি সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করার জন্য, আমাদের দেশের রাজ্যে রাজ্যে মানুষের সংহতিকে সুরক্ষিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। এখন বিজেপি-আরএসএস মথুরা বৃন্দাবনকে ঘিরে চক্রান্ত করছে বলে শোনা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সম্প্রীতির বন্ধন মজবুত করতে হবে। কৃষক আন্দোলন যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে এবং শ্রমিক আন্দোলন যে প্রস্তুতি নিচ্ছে বামপন্থীরা দেশের স্বার্থে সর্বশক্তি দিয়ে তার পাশে থাকবে।
এই সভায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস প্রসঙ্গে সূর্য মিশ্র বলেন, ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আদালতে মামলা হয়েছিল। সেখানে বিজেপি-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ওখানে তারা ঠিক কী করবেন? উত্তরে তারা বলেছিলেন, ওখানে কোনও গোলমাল হবে না। আমরা ভজন-পূজন করব। আপনারা জানেন ওখানে কি ভজন-পূজন হয়েছিল! ভজনের ভাষা ছিল, ‘অওর এক ধাক্কা দো, বাবরি মসজিদ গিরা দো’!
সূর্য মিশ্র বলেন, বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ঐতিহ্য ভেঙে তৃণমূল এরাজ্যে বিজেপি’কে ডেকে এনেছে। আর বিজেপি’র দাক্ষিণ্য ছাড়া তৃণমূলের পক্ষে নিজেদের নির্বাচনী প্রতীকটাও রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হতো না।
এদিন ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙার পরে জ্যোতি বসুর ভূমিকা ও বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জ্যোতি বসু বিজেপি’কে অসভ্য বর্বর বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে পরে প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাজপেয়ী তাঁকে প্রশ্ন করায় বসু বলেছিলেন, অভিধানে এর চেয়ে ভালো কী শব্দ আছে বিজেপি সম্পর্কে তা আমার জানা নেই, আপনি আমাকে জানিয়ে দেবেন কী শব্দ প্রয়োগ করা যায়। বাজপেয়ী আর কিছু বলতে পারেননি। আর এরাজ্যের এখন যিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি বাজপেয়ীকে বাড়িতে ডেকে মালপোয়া খাইয়েছিলেন। গুজরাটের গণহত্যার পরেও বিজেপি’র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফুল পাঠিয়েছিলেন তিনি।
সূর্য মিশ্র বাবরি ধ্বংস সংক্রান্ত লিবেরহান কমিশনে জ্যোতি বসু’র সাক্ষ্য সংক্রান্ত বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন, জ্যোতি বসু বলেছিলেন ‘এটা শুধুমাত্র একটা মসজিদ ভাঙার ঘটনা নয়, আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার যে মৌলিক কাঠামো তাকেও ভেঙে দিয়েছে ওরা’। এরপরেও ওখানে ভূমি পুজো হয়েছে, রাম মন্দিরে পূজায় অংশ নিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের রাজ্যপাল এবং ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আমরা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমরা বলতে পারি ন্যায় পায়নি মানুষ।
সূর্য মিশ্র বলেন, মোদী সরকার যাতে আর ফিরে আসতে না পারে তার জন্য মাঠে ময়দানে, খেতে, কারখানায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র লড়াই গড়ে তুলতে হবে বামপন্থীদের। এটা শুধু নির্বাচনী লড়াই নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার শপথ নিতে হবে। বাংলার বুকে একাজ বামপন্থীদেরই করতে হবে।
সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি বলেন, ৬ ডিসেম্বর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এই দিনটি ভারতের ইতিহাসে আমরা কালো দিন বা কালা দিবস হিসেবে পালন করি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঐক্য-সংহতিকে অটুট রাখার দিকে লক্ষ্য রেখে বাবাসাহেব আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। এই সংবিধানকেও লঙ্ঘন করছে মোদি সরকার। সংসদকে বোবা করে রাখা হচ্ছে, লোকসভাতে গণতন্ত্র নেই। দেশটাকে কর্পোরেট সাম্রাজ্য পরিণত করে দেশের সম্পদ বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর সরকার। দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় মানুষ তখন চুপ করে থাকে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা যে মানুষ চিরকাল সহ্য করেন না। আমাদের দেশে সেই শিক্ষা কৃষকেরা দিয়েছেন এই সরকারকে। দেশে সংবিধান এবং স্বাধীনতা আক্রান্ত যা প্রতিহত করতে পারে বামপন্থী শক্তি।
ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, মসজিদ ভেঙে ফেলার জন্য এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে নষ্ট করতে। দেশের মানুষকে ধর্মের নামে লড়িয়ে দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ থেকে কলকারখানা বিক্রিতে সুবিধে হয়। তাই জল জমি জঙ্গল থেকে আজকের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রকেও বেচে দিতে বিজেপি তাদের রাজনীতির মাধ্যমে দেশে অস্থিরতা তৈরির মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার হরণ করার চেষ্টা করছে। শ্রমিক কৃষক ঐক্যবদ্ধভাবে এই ধর্মের নামে দেশটাকে টুকরো করার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। এটাই আমাদের আজকের লড়াই।
আরএসপি নেতা নওফল মহম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, বামপন্থী দলগুলো যখন রুটি রুজির লড়াই করছে তখন তা ভাগ করতে উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী শক্তি তা ভেস্তে দিতে চায়। শ্রমিককে তার অধিকার ভুলিয়ে দিতে চায়। ভুলিয়ে দিতে চায় তার ভুখা পেটের কথা। আমাদের তাই আজ সংবিধান বাঁচাতে হবে। দ্বেষ-মুক্ত দেশ গঠনের শপথ নিতে হবে।
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আরএসপি’র সর্বভারতীয় সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। কলকাতা ছাড়াও রাজ্যের অন্যত্র মিটিং মিছিল অবস্থানের মধ্যদিয়ে প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।