৫৯ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ / ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
ন্যায্য দাবি আদায়ে ও সংগঠনকে মজবুত করতে মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে
পার্টির দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সম্মেলনের আহ্বান
সম্মেলনের প্রথম দিন গঙ্গারামপুর শহরে পার্টির মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সময়ের প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দাবি আদায়ে গুরুত্ব দেবার পাশাপাশি সংগঠনকে মজবুত করতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সিপিআই(এম) দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা ২৩তম সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনায় এই বার্তাই ধ্বনিত হয়েছে। গত ৪-৫ ডিসেম্বর কমরেড হীরেন সাহা নগরে (গঙ্গারামপুর) কমরেড অপরেশ সাহা ও কমরেড ডিবু মুর্মু মঞ্চে (গঙ্গারামপুর রবীন্দ্র ভবন) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই সম্মেলনে ৩০ জনের জেলা কমিটি গঠিত হয়েছে। নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে নারায়ণ বিশ্বাস ফের সম্পাদক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া একজন স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। পরে আরও একজনকে জেলা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সম্মেলনে ১৭৯ জন প্রতিনিধি, ৫৬ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে ২৩ জন মহিলা এবং ১৬ জন ছাত্র-যুব উপস্থিত ছিলেন। পরিচিতি কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়কালে লড়াই-আন্দোলন করতে গিয়ে ৪৭ জন কমরেড কারাবরণ করেছেন। ৩৭ জনকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে এবং ৭০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের পুলিশ মিথ্যা মামলা রুজু করেছে। সম্মেলনে সবচেয়ে প্রবীণ প্রতিনিধি ছিলেন রঘুনাথ রায়, বয়স ৮০। সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন প্রতীক রায়, বয়স ২২।
এই সম্মেলন উপলক্ষে ৪ ডিসেম্বর গঙ্গারামপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রক্তপতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন শোভিত একটি বর্ণময় মিছিল শহর পরিক্রমা করে। মিছিলে অংশ নেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায় চৌধুরী, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুমিত দে প্রমুখ।
পতাকা উত্তোলন ও শহিদ বেদিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। মানবেশ চৌধুরী, রঘু রায়, রফিকুল ইসলাম, সায়নী নিয়োগী ও সুনীল কিস্কুকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করে।
৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষের জীবনবোধকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করতে হবে বামপন্থীদের। এই কাজে সিপিআই(এম) কর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, তেভাগা আন্দোলনের মাটি দিনাজপুর। অতীতে অনেক রক্ত ঝরানো বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ইতিহাস লেখা হয়েছে এখানে। এখনও লড়াইয়ের অনেক উপাদান রয়েছে। প্রয়োজন কেবল তাকে খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে সময়োপযোগী করে নেওয়া। তাহলেই রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের জন্য সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে শক্তিশালী করা সম্ভব।
তিনি বলেছেন, নির্বাচনে বামপন্থীরা কোনো আসন না পেলেও গরিব মানুষের লড়াই থেমে থাকবে না। সব অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোষণের বিরুদ্ধে এগিয়ে নিতে যেতে হবে। দেশের ও রাজ্যের শাসক শ্রেণি জানে তাদের মাত্রাহীন শোষণে একমাত্র বাধা দিতে পারে কমিউনিস্টরাই। মুষ্টিমেয় মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে সিপিআই(এম)। তাই গরিব মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করতে জাতির নামে, ভাষার নামে, অঞ্চলের নামে, ধর্মের নামে ভাগ করা হচ্ছে।
আভাস রায় চৌধুরী আরও বলেন, শুধুমাত্র দুর্নীতি, বেনিয়মের বিরুদ্ধে আর নতুন দাবি জানাতে ডেপুটেশন দিয়েই গরিব মানুষের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া শেষ হয় না। এই লড়াইকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে। লড়াইয়ে আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করতে হবে। তাহলেই জয় অনিবার্য। দেশের কৃষকরা কেন্দ্রের বর্তমান লুটেরা সরকারের বিরুদ্ধে তা করে দেখিয়েছেন। কৃষকদের সম্মিলিত লড়াই আর ধৈর্য্যের কাছে হেরে গেছে শাসক শ্রেণি। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন আর সংগ্রামই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, যেখানেই বিজেপি বিরোধী শক্তি খেটে খাওয়া গরিব মানুষকে নিয়ে আন্দোলন করে শক্তিশালী হচ্ছে, সেখানেই তাদের ভাগ করতে যাচ্ছে তৃণমূল। লক্ষ্য শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করা। দুই দলই একই শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে। তাই গরিব মানুষের হকের আন্দোলনে বাধা দেয়, ভয় দেখায়। ওদের লক্ষ্য এক। আগামী দিনে আরও বড়ো ধাক্কা দেবে। তাকে প্রতিহত করেই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখনও অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁরা আমাদের উপর বিশ্বাস রাখেন। তাঁদের ভরসা দিতে হবে। এই সম্মেলন মঞ্চ থেকেই তা শপথ নিতে হবে। পঞ্চায়েত, পৌরসভায় দেদার লুট চলছে। বাধা দিয়েই তা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দুনিয়া, দেশ ও রাজ্যে একই লুট অব্যাহত। শিল্প ধ্বংস হচ্ছে। শ্রমিকের কাজ চলে যাচ্ছে। বেকার যুবক-যুবতীরা কাজ পাচ্ছেন না। সম্পদ বিক্রির সরকারকে বদল করতেই হবে।
সম্মেলনে খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী সম্পাদক নারায়ণ বিশ্বাস। ১১টি এরিয়া কমিটি এবং বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন। প্রতিবেদনের ওপর প্রতিনিধিদের আলোচনায় সংগঠনকে মজবুত করার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বিএসএফ’র ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সীমান্তের গ্রামে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আতঙ্কে কৃষকরাও। এর বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদের কথা উল্লেখ করেছেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, বেশ কিছু এলাকায় কৃষক বিক্ষোভ, আন্দোলনে সারের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও তাঁরা উল্লেখ করেছেন, বালুরঘাট, হিলি, বংশীহারি থেকে কালিয়াগঞ্জ রেলপথ সম্প্রসারণের দাবিতে গণআন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, তাঁদের প্রতি সরকারের অবহেলার কথা।
সম্মেলনে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, ফসলের ন্যায্য দাম, মহিলাদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি ১০টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
সম্মেলনের উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, পার্টির কাজে গতি আনতে তরুণদের হাতে নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিটি বুথে লড়াই-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই বুথগুলিকে দুর্গে পরিণত করতে হবে। এটা কঠিন কাজ, কিন্তু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই কমিউনিস্টদের কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে এলাকাভিত্তিক অনেক ইস্যু আসবে। সেগুলিকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করে সফল করতে হবে। তাহলেই যেসব মানুষেরা ভুল বুঝে শত্রু শিবিরে গেছেন, তারা ভরসা পাবেন, ফিরে আসবেন। সমাজ বদলের লক্ষ্য আমাদের।
তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থা মানুষের নজর ঘোরাতে ঘন ঘন কৌশল বদল করে। সত্যকে আড়াল করার সবরকম চেষ্টাও করে। আগামীতেও করবে। পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করাই তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। এই জেলার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই আদিবাসী, তফশিলি ও সংখ্যালঘু। দেশের শাসক শ্রেণি তাদের জন্য কোনো কর্মসূচি নেয়নি। এই মানুষদের স্বার্থে কমিউনিস্টদেরই লড়াই-আন্দোলন করতে হবে।
এছাড়াও সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুমিত দে। তিনি বলেছেন, করোনাকালে প্রায় দু’বছর স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হয়েছে। মানুষের রোজগারের ক্ষেত্র বদলে গেছে। এক নতুন শ্রেণি বিন্যাস হয়েছে। যাকে কোনো রকমেই আড়াল করা যাবে না। এই সময়ে নিজেদের ত্রুটি ঢাকতে, ক্ষোভ সামাল দিতে সরকার যে প্রকল্প চালু করেছে তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু গরিব মানুষকে এই মুহূর্তে সেখান থেকে সরানো যাবে না। এই কর্মসূচিতে পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। মানুষকে বোঝাতে সময় লাগবে। নিজেদের অবস্থানগত দিক স্পষ্ট করেই জোরালো আন্দোলন করতে হবে।
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অচিন্ত্য চক্রবর্তী।