৫৯ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ / ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
সবহারা মানুষের আস্থা অর্জনই শেষ কথা
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
কোন্ দেশ কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসটা ছড়িয়েছে সেই বিতর্কের চর্চা ও নাটক তো অনেক হলো। ভালোমন্দ মিশিয়ে অনেক অভিজ্ঞতাও হলো সবার। অপচয় দেখলাম, নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর গল্পও শুনলাম অনেক। বন্ধু-শত্রু চেনার ক্ষমতা যে অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন তাও দেখলাম সবাই। প্রকাশ না করলেও মানুষ মাত্রেরই মান-অভিমান তো হয়ই। মনোবিদরা বলবেন, যেটা করা দরকার করবেন, যেটা বলা দরকার বলবেন - বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করবেন না। মানুষের উপকারের জন্যে কিছু বলতে গিয়ে, মানুষের স্বার্থে কোনো লড়াইয়ের সাথি হয়ে লাঞ্ছিত, অপমানিত, অত্যাচারিত হলেও কিছু কিছু সময়ে যাদের জন্যে লড়াই তাদের পাশে পাওয়া যায় না। এমনও হয় নানান প্রচার-অপপ্রচারের ঢেউয়ে মানুষ ভুল পক্ষ বেছে নেন। ভুল পক্ষ বেছে নেবার মাশুল হিসাবে মানুষকে নানান আর্থিক, শারীরিক, মানসিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। এমনকী ভুল পক্ষকে বন্ধু ভাবার জন্যে প্রাণও যায় মানুষের হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, তবুও যারা মানুষের জন্যেই কাজ করবেন বলে শপথ নিয়েছেন তারা মানুষের পাশ থেকে সরে যান না, মানুষের উপরে আস্থা হারান না। নিজেদের ভুলগুলো চেনার চেষ্টা করে আরও বিজ্ঞানসম্মতভাবে মানুষের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে জনতার আদালতে তুলে ধরার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। শুধু ভোটে জেতা, ভোটে হারার উপরে মানুষের প্রতি ভালোবাসা যাদের নির্ভর করে তাদের কথা আলাদা। পৌরসভা, পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা দখল, দেশের দখল, বিশ্বের দখলদারী, বিশ্বের ব্যবসায়ের দখলদারী কার হাতে থাকবে সে নিয়েই শুধু যাদের মাথাব্যথা তারাই এক একজন (ভণ্ড) মানবপ্রেমিক সেজে বসে আছেন দেশে দেশে। ‘মান-অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়’ - গ্রাম সমাজে কথাটা খুবই চালু একটা কথা। প্রাণ বাজি রেখেও যারা মানুষের পাশে থাকেন তাদের ভাড়ার আজ শূন্য। তবু তারাই মানুষের দাবিগুলো নিয়ে পথে পথে, মাঠে-ঘাটে-হাটে সোচ্চার। সংকট আছে, সংকট বাড়ছে। মানুষ ভুগেছে প্রচুর, এখনো ভুগেই চলেছেন। তবুও, কিন্তু সংকটের সৃষ্টিকর্তাদেরই অনেক মানুষ এখনো ভগবান ঠাউরে চলেছেন। সমস্যার উৎসগুলোকে এখনো তলিয়ে ভাবার ও চেনার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে, একথা হলফ করে বলা যায়। মিথ্যার ব্যবসায়ীরা জানে যে, মিথ্যা থেকে সত্যে পৌঁছানোর পথটা বড়ো দীর্ঘ (যেমন, সাদ্দাম হোসেনকে মানব সভ্যতার শত্রু সাজিয়ে আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে সাদ্দামকে হত্যা করে সেই দেশে আমেরিকার পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পরে জনসমক্ষে এলো যে, সাদ্দামের বিরুদ্ধে সব অভিযোগই ছিল সাজানো মিথ্যা। ততদিনে ওই দেশের থেকে যা মধু খাবার তা খাওয়া হয়ে গেছে বিশ্বপ্রেমিক আমাদের অতি প্রিয় বড়োদাদা আমেরিকার)। তাই তারা নানা সময়ে নানা ছল-চাতুরী, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানুষের ঐক্যকে বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করতে সফল হয়। পেপারে, জার্নালে, ম্যাগাজিনে কী লেখা হবে কি লেখা হবে না, টিভিতে কী দেখানো হবে কি দেখানো হবে না, মানুষকে কোন্ সত্যিটা জানানো হবে কোন্টা হবে না, সব কিছু ঠিক হয় বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত পেপার, জার্নাল, ম্যাগাজিন, টিভি অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে। ওই বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা অনেক সময়ে নানান দপ্তরের মন্ত্রী কে হবেন সেই তালিকাও ঠিক করে পাঠিয়ে দেয় মন্ত্রীসভা গঠনের রাজনৈতিক কোর কমিটির হাতে। এভাবেই দেশে দেশে সরকার হয়ে ওঠে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল। ভোটে লড়াইয়ের খরচ যারা জোগাবেন, তাদের দাবি সরকারকে মানতে হবে - এটাই তো স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বোঝা যায়। ভোটে লড়াইয়ের খরচ জোগাড় করতে যাদের সাধারণ মানুষের কাছে হাত পাততে হয় না, তাদের কাছে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোনো কাজ করার আশা করা নেহাতই দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের মধ্যে একচেটিয়া ক্ষমতা দখলের লড়াই বেঁধে গেলে তখন দেশে নতুন কোনো দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয় - এটাও দেখা গেছে বিশ্বের নানা দেশে, নানা সময়ে।
তাই মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে, হাটে বাজারে-রাস্তায়-স্টেশনে আঁচল পেতে অর্থ সংগ্রহ করে, দলের সদস্যরা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে যারা দল চালান, যারা ভোটে লড়েন, তাদের বিরুদ্ধে বড়ো ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, হাজার বিঘের জমির মালিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সবক’টা দলের লড়াইয়ের অভিমুখ এক হয়ে যেতে দেরি হয় না আড়ালে বা প্রকাশ্যে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশে দেশে বড়ো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণবিহীন সরকার গড়ে ওঠার খবর আসছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই খবরগুলো ব্যবসায়ীদের বা সরকারের নির্দেশে আড়ালে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চলেছে। মানুষের কাছে থেকে, পাশে থেকে, সাথে থেকে যারা দিনযাপন করার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেন তাদের মানুষ সুযোগ পেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করেন না, ইতিহাসের নানা বাঁকে সেই সত্যই বারবার দেখা গেছে। আর যারা মানুষকে আগলে রাখেন, মানুষও তাদের আগলে রাখেন এটাও ঐতিহাসিকভাবে বারবার প্রমাণিত সত্য। গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের ভোটের জোরে ক্ষমতায় এসে, সমাজের আর্থিকভাবে শক্তিশালী মাতব্বরদের স্বার্থেই যারা চলতে শুরু করেন তাদেরও স্থান ঐতিহাসিকভাবেই পূর্বনির্ধারিত। সবহারা মানুষের আস্থা অর্জনই শেষ কথা, বাকি সব পরিবর্তন সাময়িক।