৫৯ বর্ষ ১৭ সংখ্যা / ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ / ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
গ্রিক বর্ণমালা করোনা-নামাবলি এবং কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ ইত্যাদি...
পল্লব সেনগুপ্ত
শেকসপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে একটি প্রবচন-হয়ে-যাওয়া সংলাপ আছেঃ ‘‘নামে কি বা আসে যায়? গোলাপে যে–নামে ডাকো সৌরভ বিলোয়।’’ নাটকের নায়ক-নায়িকার প্রেমালাপে এমন কথাবার্তা বেশ মানিয়ে গেলেও, বাস্তবজীবনে কিন্তু নাম-টাম নিয়ে অনেক সময়েই জটিলতার সৃষ্টি হয়। তেমন একটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে এই বিশ্বজোড়া করোনা হামলার পরিপ্রেক্ষিতেও।... ক’দিন আগে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার উপলক্ষ্য হলো নামের সমস্যা! যে ভয়ঙ্কর অসুখ ইতিমধ্যেই এই পৌনে দু’বছর সময়ের মাঝে পৃথিবীর সাড়ে ছাব্বিশ কোটিরও বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে এবং তার পরিণামে আধ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন চলে গেছে, সেটার পরিপ্রেক্ষাতেও যে পাঁড়-কমিউনিস্ট বিদ্বেষী কোনো কোনো মানুষ গায়ের জ্বালা মেটাতে নিত্য-চরিত্র- বদলকারী করোনা ভাইরাসদের কী-কী নামে উল্লেখ করা হবে, সেই নিয়ে ঝগড়া বাধাতে উন্মুখ - এমনটা দেখে হাসবো, না কাঁদবো, বুঝছিনে ভাই! অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত বিদ্রুপসিক্ত ছড়া - ‘‘তার পিছনেও কমিউনিস্টি’’ যে কতটা ভুয়োদর্শনের ফল, তার প্রমাণ আবারও পাওয়া গেল এই বাবদে!
ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে বিতং না দিয়ে বললে হবে না। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা’ (World Health Organisation তথা WHO) করোনা ব্যাধি যবে থেকে মনুষ্যজাতির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তার বীজানুরা (‘ভাইরাস’) বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসকদের প্রতিরোধ এড়াতে নিজেদের রূপান্তরিত করে চলেছে - তখন থেকেই সেই রঙ বদলুদের এক-একটা নামে চিহ্নিত করছে। করোনা-বীজানুরা খুব তাড়াতাড়িই নিজেদের সংহারক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই এমন কিছু বদল ঘটাচ্ছে নিজেদের অন্যসব কিছুর, যাতে বিশ্বের বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। তো, এই নিত্য ভেকবদলকারী বীজানুরা প্রায় ‘টিএমসি > বিজেপি > টিএমসি’ এই ‘‘ছন্দে-ছন্দে কত রঙ বদলায়’’ - মার্কা লোকজনের মতোই অতি দ্রুত কাজ সারে। ফলে, তাদের এক-এক মক্কেলকে চিহ্নিত করতেই WHO (‘হু’) গ্রিক বর্ণমালার অক্ষরগুলির নাম ব্যবহার করছে।
সেই সূত্রেই করোনা যবে থেকে মানুষের ঘরের দুয়ারে এসে কড়া নাড়তে শুরু করছে, তখন থেকেই ‘হু’ একটা করে নামে চিহ্নিত করছে রঙ-পালটানো ভাইরাসদের। শুরু হয়েছিল গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর ‘আলফা’ দিয়ে, তার ক্রমে-ক্রমে নামাবলীর দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে আলফা-বিটা-গামা-ডেলটা-এপসিলন-জেটা-এটা-থেটা-আইওটা-কাপ্পা-ল্যাম্বড়া-মু... ইত্যাদি, ইত্যাদি। সাধারণভাবে (খবরের কাগজের পরিভাষায় এরা করোনার প্রথম ওয়েভ (তরঙ্গ) তা ওই ‘মু’ অবধি কোনও সমস্যা হয়নি। তথাকথিত ‘থার্ড ওয়েভ’-এর মধ্যে সবগুলো নচ্ছারই বেশ এঁটে-সেঁটে গিয়েছিল! ঝামেলাটা পেকে উঠল অতি সম্প্রতি; পুরাণকথার রক্তবীজ রাক্ষসের বংশের মতো নতুন গজানো (বা, তিনু > বিজু > তিনু - মার্কা!) চকিতে চেহারা-বদলানো বীজানুটিকে নিয়ে, যার নাম দেওয়া হলোঃ ‘ওমিক্রন’। এটা এই চতুর্থ তরঙ্গের দলভুক্ত এবং বিশ্বের এগারোটি দেশে (যার মধ্যে ভারতও আছে বলা হচ্ছে) এর আবির্ভাব ঘটেছে এ অবধি (৪.১২.২০২১)।
কিন্তু এই বারেই শুরু হয়েছে খিট্কেল। এডওয়ার্ড ওরফে ‘টেডি’ ক্রুজ নামক কোনও এক রিপাবলিকান পার্টিভুক্ত মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ‘হু’-কে কাঠগড়ায় তুলেছেন এই বলে যে, কেন তাঁরা ‘মু’-র পরবর্তী দুটি অক্ষর ‘নু’ এবং ‘ক্সি’-কে টপকে গিয়ে ‘ওমিক্রন’ নামটা ব্যবহার করলেন এই নয়া ভেকধারী ভাইরাসটির?
এই টেডি বিয়ার (থুড়ি, ‘ক্রুজ’) নামক স্যামচাচাটির বক্তব্য খুব চাঁছাছোলাঃ (‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় তাঁর উক্তি যা উদ্ধৃত হয়েছে, সেই অনুসারে অনুবাদ করে দেওয়া গেল) ‘‘যদি ‘হু’ চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে এতটাই ভয় পায়, তাহলে এই দুনিয়াজোড়া মহামারীর মারকাটারি হামলার সময়ে, তাদের ওপর লোকে ভরসা রাখবে কী করে?’’
কী ভাবছেন, এই টেডি-সাহেব ‘‘ধান ভানতে শিবের গীত’’ গাওয়ার মতো বেকুবি বুক্নি দিচ্ছেন? না, মশাই না! ওঁর আক্রোশের কারণটা খুব প্যাঁচসুলুকি! ‘মু’-এর পরবর্তী ‘নু’ এবং ‘ক্সি’ অক্ষর দুটোকে ভাইরাসের লিস্টি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কেন, এই নিয়ে ‘হু’ একটা ব্যাখ্যা যা দিয়েছে, তারই সূত্রে টেডির অমন প্যাঁচপয়জারি। ‘হু’ অবশ্য এক বিবৃতিতে বলেছে যে, ‘নু’ নাম দিলে ‘নিউ’ (অর্থাৎ ‘নতুন’)-এর সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলবার একটা আশঙ্কা থেকে যায়; আর ‘ক্সি’-কে নেওয়া হয়নি তার কারণ, ওটি চৈনিক সমাজে একটি খুবই সুপরিচিত ‘পদবী’। ‘হু’-র মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ তাঁদের ওই সিদ্ধান্তের সমর্থনে আরও বলেছেন যে, ‘এই সংস্থার (‘হু’) ঘোষিত একটি নীতি হচ্ছে, কোনও সাংস্কৃতিক, সামাজিক, জাতীয়, স্থানীয়, জীবিকাকেন্দ্রিত বা জাতিগত পরিপ্রেক্ষিতে কারুকে ক্ষুণ্ণ না করা; কারুর সম্মানহানিকর কিছু ঘটেছে - এমন ভাবনা যাতে প্রশ্রয় না পায় - সেই বিষয়ে সতর্ক থাকা। ব্যস, ওই ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই টেডি সাহেবের মনে জমে-থাকা কমিউনিস্টদের সম্পর্কে বিদ্বেষ, চীনের প্রতি মার্কিনি হিংসে - সব ফেটে বেরোল। যেহেতু চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখ্য নেতার নাম ক্সি জিনপিং - তাই করোনার এই নতুন ভাইরাসটির নাম ‘ক্সি’ না দেওয়াতে তিনি মনে করলেন, চীনা কমিউনিস্ট নেতার নামের সঙ্গে করোনা-বীজানুর নামের বানানটা পাছে এক হয়ে যায়, তাই ‘হু’ এমনটা করেছে। টেডি স্যামচাচা বিশাল এক বিষ-ওগ্রানো বক্তিমে ঝাড়লেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তার খানিকটা ছেপেছেও খবরের মধ্যে - যার অনুবাদ করে দিয়েছি এখনই।
‘হু’-র বক্তব্যে যুক্তি এবং সৌজন্যবোধ দুটোই আছে। ঘটনাচক্রে গ্রিক বর্ণমালার অন্তর্গত ‘ক্সি’ এবং চীনের অন্যতম প্রচলিত পদবী ‘জি’ (যার বানান চৈনিক বর্ণমালা অনুসারে ‘ক্সি’) যেহেতু রূপগত এবং উচ্চারণগত দুইভাবেই সমরূপ - তাই স্বাভাবিক কারণেই ‘হু’ ওই বিশেষ হরফটিকে বাদ দিয়েছে করোনা নামাবলী থেকে। এতে রাগারাগি, গালিগালাজের কী আছে?
ধরুন, গ্রিক বর্ণমালার ওই চতুর্দশতম অক্ষরটির নাম যদি ‘ক্সি’ না হয়ে ‘ট্রাম্প’ হতো, কিংবা ‘বুশ’ বা ‘নিক্সন’ - এবং সেই অক্ষরকে ঠিক এই কারণেই ‘হু’ এড়িয়ে যেত, তাহলেও টেডি শ্রীমান - এমন কথাই বলতেন? কিংবা গ্রিক অক্ষরটি যদি কোনো ভারতীয়র নাম বা পদবীর সমরূপী উচ্চারণে প্রযুক্ত হতো, তাতে কি আমরা অস্বস্তিতে পড়তাম না?
আসলে বিশ্বজোড়া (মার্কিন দেশে তো বটেই!) যে নব্য-নাৎসিরা কিংবা নয়া-ম্যাকার্থিবাদীরা প্রকাশ্যে এবং অন্তরীক্ষে কমিউনিজমের-কমিউনিস্টদের নিকেশ করার জন্য আবার আড়ে-হাতে লেগেছে, টেডি বয়ের এই বিষোদ্গারও সেই দুনিয়াজোড়া ষড়যন্ত্রেরই একটা আচম্কা বিস্ফোরণ ছাড়া কিছুই নয়।
এরকমটা তো আমাদের দেশেই দেখছি। সদ্য-সদ্যই এই রাজ্যের শাসকদলের মুখপত্রে কমিউনিস্টদের ‘ডীপ ফ্রিজ’ থেকে বার করে ‘মিউজিয়ামে’ পাঠাবার কথা বলা হয়েছে! আরে ভাই কমিউনিস্টরা অত সহজে খতম হয় না - কমিউনিজমের আদর্শ তো নয়ই।
১৯৭৭ সালে ভোটে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয়ের পর ক্ষিপ্ত হয়ে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী কমিউনিস্ট নেতাদের ‘‘হরপ্পা মহেঞ্জোদড়ো’’ যুগের লোক বলে আক্রোশ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারপর সেই কমিউনিস্টদের নেতৃত্বেই চৌত্রিশটা বছর এই রাজ্য পরিচালিত হয়েছে। একবার লোকসভায় একমাত্র তৃণমূল সদস্য হিসেবে এরাজ্য থেকে গিয়েছিলেন শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭২ সালে বিধানসভায় মাত্র ৯ জন কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন। ভোটের বাক্সে এমনটা হয়ই। বিশেষ করে যদি ভোটটা সঠিকভাবে না হয়! যথাকালে পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসের ভস্মস্তূপ থেকে আবার কমিউনিস্টরা সজীব হয়ে উঠে আসে। এখন যেমন আসছে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের নানা অঞ্চলে, লাতিন আমেরিকায়।
তাই আমেরিকার টেডি ক্রুজরা কিংবা এখানকার টেডিবয়রা যা-ই বলুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না! তবে হ্যাঁ, এই কারোনা ভাইরাসের নামকরণ নিয়ে কমিউনিস্ট বিরোধিতার যে-কুনাট্যরঙ্গটি পরিবেশিত হয়েছে, তাতে হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তবে করোনা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার জন্য চীনকে দায়ী করার একটা অপচেষ্টা তো বেশ কিছুদিন ধরেই চলেছে - এবং ‘হু’ সেটা না মানায়, তারও সপিণ্ডকরণ হয়েছে। তাই এবারের ব্যাপারটা কিছু নতুন নয়! চীন এবং উহান শহর - যেখানে করোনার প্রথম আক্রমণ হয় - নিয়ে লেখা একটা সায়েন্স ফিকশন - যা লেখা হয় বহু বছর আগে। মার্কিন লেখক ডিন কুনৎসের ‘দ্য আইজ অব ডার্কনেস’ বইটিকেও হাস্যকরভাবে প্রমাণ হিসাবে বলা হয়েছে কিছু আগেও! এই বইয়ের প্রথম সংস্করণে (১৯৮১) অবশ্য চাপানো হয় রাশিয়া এবং সে দেশের গোর্কি শহরের ওপর - কারণ তখন রাশিয়াই ছিল আমেরিকার বৃহত্তম শত্রু। আর ১৯৮৯-এর দ্বিতীয় সংস্করণে দেশটা বদলে হলো চীন এবং শহরটা হলো উহান। বলাই বাহুল্য, এই বইটিও জর্জ অরওয়েলের কুখ্যাত ‘১৯৮৪’ উপন্যাসেরই সমগোত্রীয়, পাঁড় কমিউনিস্ট বিরোধী! এই বইয়ের মধ্যে যে মারণব্যাধির ভাইরাসকে চিত্রিত করা হয়েছে, তার নাম উহান-৪০০! প্রথম সংস্করণে ছিল, গোর্কি ৪০০! আসলে কতকগুলো মহামারীকে কোনো কারণ থাক বা না থাক বিশেষ-বিশেষ নামে চিহ্নিত করা হয় বহুকাল ধরেই। যেমন, এশিয়াটিক কলেরা, স্প্যানিশ ফ্লু, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাল ডিজিজ, জিকা এপিডেমিক, ইবোলা প্যানডেমিক ইত্যাদি, ইত্যাদি। বৈজ্ঞানিক মহলে অবশ্য এই খবরের কাগুজে নামায়ন মানা হয় না। ঠিক সেই কারণেই ‘হু’ ওই ‘ক্সি’ অক্ষরটিকে বাদ দিয়েছে!
যে-কথা বলে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই। নাম নিয়ে একটা বিচিত্র সমস্যা মানুষের মনে আছেই - কখনো তা মনস্তাত্ত্বিক, কখনো ধর্মীয়, কখনো আবার রাজনৈতিক। তাই প্রাচীন মিশরীয়দের উপাস্যা দেবী ‘আইসিক্স’-এর নামে নিজের মেয়ের নাম রেখে এক দম্পতি, ইংল্যান্ডের বিমানবন্দরে বিপদে পড়েছিলেন বোর্ডিং কার্ড নেবার সময়ে। হিটলার নাম হবার জন্যে নিউজিল্যান্ডে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এক টুরিস্টকে। এবং আমার পরিচিত একটি মেয়ের নাম শবনম মুখার্জি হওয়ার কারণে স্কুলে ভরতির সময়ে তার বাবাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁর স্ত্রী মুসলিম কী-না! ...মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।