৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯
নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসকদলের যুক্ত থাকার নতুন নতুন চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে, কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই তার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি এক বিস্ফোরক দাবি করেছে, ২০১৪’র টেট থেকে ২০২১ পর্যন্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে যে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে তা গিয়েছে এক ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’র কাছে। নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইডি’র এমন বিস্ফোরক দাবির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে যে, বর্তমানে হাজতবাস করা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিই নিয়োগ দুর্নীতির মাথা নন। পার্থ চ্যাটার্জির চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি রয়েছে এই নিয়োগ দুর্নীতির পিরামিডের মাথায়। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষকে জেরা করে এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে ইডি। জানা গেছে, বিশাল অঙ্কের টাকার পাশাপাশি দামি দামি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সহ একাধিক মূল্যবান ‘উপহার’ কুন্তলের মাধ্যমে পেত প্রভাবশালী মহল। সেই উপহারের বিনিময়েই এই প্রতারক কুন্তলকে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক পদে বসিয়ে দেওয়া হয়।
ইডি’র তদন্তে যুব নেতা কুন্তল স্বীকার করেছে, ওই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ ব্যক্তিই টাকার বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাকে ‘সাহায্য’ করতেন। এখানে সাহায্য মানে যে অবৈধভাবে অযোগ্যদের নিয়োগ নিশ্চিত করা - তাও জানিয়েছে ইডি। প্রসঙ্গত, চাকরি দেবার নাম করে কুন্তল ঘোষ যে ১৯ কোটি টাকা এবং পরবর্তীতে টেট পাশ করিয়ে দেওয়া এবং নবম-দশমে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের নামে যে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলেছিলেন তার থেকে একটা বড়ো অংশের ভাগ পার্থ চ্যাটার্জি ছাড়াও অত্যন্ত প্রভাবশালীদের পাঠাতেন।
পার্থ চ্যাটার্জি থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য, মধ্য শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি, এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, নিয়োগ নজরদারি কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, এসএসসি’র তৎকালীন সচিব অশোক সাহা - সবাই কুন্তল ঘোষের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন। ইডি’র সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ বছরে ১০০টির মতো গাড়ি বিভিন্ন জনকে উপহার দিয়েছেন কুন্তল। এছাড়া তৃণমূলের এক যুব নেত্রীও কুন্তলের দেওয়া গাড়ি ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।
ইডি’র তরফে দাবি করা হয়েছে, দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে কুন্তল ঘোষ নিজে সাড়ে ৬ কোটি টাকা জমা করেছিল। যদিও অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়ার পরই একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সেই টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। সেই ব্যাঙ্কগুলির হদিশ পেয়েছে ইডি। শুধু একাধিক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাচারই নয়, নিয়োগ দুর্নীতির টাকা টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও খাটানো হয়েছে। এছাড়াও যুব নেতা একটি মিউজিক কোম্পানিও খুলেছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি জেরায় স্বীকার করেছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির নাকতলার বাড়িতে একাধিকবার গিয়েছেন। এছাড়া পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আর্পিতা মুখার্জির হরিদেবপুর ও নাকতলার বাড়িতেও যাতায়াত ছিল তার।
ইডি’র তদন্তে আরও যে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা হলো, ২০১৪ সালে ১৩০ জন টেট পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে গড়ে ৮ লক্ষ টাকা করে মোট ১০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে কুন্তল ঘোষ।
শুধু চাকরি পাইয়ে দেবার জন্যই নয়, মামলা করে সেই চাকরি বাঁচানোর জন্যও টাকা তুলেছিল কুন্তল ঘোষ। ২০১৪ সালে টেট নিয়ে যখন দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে, তখন আদালতে মামলা দায়ের করে চাকরি বহাল রাখার জন্য ১২০০ প্রার্থীর কাছ থেকে মাথা পিছু ২০ হাজার টাকা করে তোলা হয়েছিল। সেই টাকার পরিমাণ হলো ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা!
তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল ঘোষকে জেরা করে বেরিয়ে আসা এই সমস্ত চমকপ্রদ তথ্যের প্রমাণ সহ তালিকা আদালতে পেশ করে ইডি দাবি করেছে, ২০১৪’র টেটে প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক ছাড়াও গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের দুর্নীতিতে মোট ৩০ কোটি টাকা তুলেছিল কুন্তল ঘোষ। ধারাবাহিক জেরায় কুন্তল কবুল করে নিয়েছে, চাকরির নামে তোলা বিপুল টাকার এক বড়ো অংশ নির্দিষ্টভাবে প্রভাবশালী মহলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। একাধিক কিস্তিতে পার্থ চ্যাটার্জি ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জিকে এই টাকার অংশ দেওয়া হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, অর্পিতার বেলঘরিয়া ও হরিদেবপুরের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার অংশ কি কুন্তলের দেওয়া টাকাই?
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে ইডি জানিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেও কুন্তলের যোগাযোগ ছিল এবং ওই দুর্নীতিতে মানিক-কুন্তল জুটির বড়ো ভূমিকা ছিল। এই সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশে অগণিত মানুষ গর্জে উঠছেন।
ফের নগদ টাকার স্তূপ উদ্ধার
এবারে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে নয়, কয়লা পাচার কাণ্ডের তদন্তে ইডি বিপুল টাকা উদ্ধার করেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে এক নির্মাণকারী সংস্থার অফিসে ঝটিকা তল্লাশি চালিয়ে নগদ ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছে। টাকার পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে ইডি।
বালিগঞ্জের ঠিকানায় এই নির্মাণকারী সংস্থার দক্ষিণ কলকাতায় একাধিক ঠিকানায় অফিস রয়েছে।
প্রসঙ্গত, কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার টাকা বিভিন্ন সংস্থায় ঢুকেছিল। সেই সূত্রেই তদন্তে ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছে একাধিক সংস্থার নাম। ইডি’র দাবি এদিন নগদ টাকা উদ্ধারের জন্য তল্লাশি ছিল না। এই সংস্থায় ঢুকেছিল কয়লা পাচারের টাকা। সেখান থেকে আবার টাকা একাধিক সংস্থায় পাচার হয়েছে। সেই সূত্রেই তল্লাশি চালাতে গিয়ে উদ্ধার হয়েছে এই নগদ টাকার স্তূপ।
এদিকে তদন্তকারী সংস্থার একটি নির্দিষ্ট সূত্রে জানা গেছে ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’ - এই সংস্থায় আগেই বেশ কিছু সন্দেহজনক লেনদেনের হদিশ মিলেছিল। উল্লেখ্য এই ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে এই সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরস থেকে অভিষেক ব্যানার্জি পদত্যাগ করেন।
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদ ও মালদহে পতাকা ইন্ডাস্ট্রিস প্রাইভেট লিমিটেডের বিভিন্ন অফিসে আয়কর হানা দেয়। এর আগে ২২ জানুয়ারি মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য, বর্তমান বিধায়ক জাকির হোসেনের বাড়ি, অফিস, চালকল, গুদামেও হানা দিয়ে, উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। তৃণমূলী জমানায় এরাজ্যে যে দুর্নীতি ব্যাপকমাত্রায় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে এগুলিই তার উল্লেখযোগ্য নজির।