E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯

বর্তমান পুঁজিবাদের ধারা ও আদানি কর্মকাণ্ড

ঈশিতা মুখার্জি


আমাদের দেশে নয়া উদারীকরণ ১৯৯১ সালে ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই পুঁজির বাজারে যে পরিবর্তন আসবে এবং আর্থিক নিশ্চয়তা বিপন্ন হবে, সে কথা সেদিন থেকে বলা হচ্ছিল। সংকট এসেছে বারে বারে। সেই সংকটকে প্রায় অগ্রাহ্য করে দেশের সরকার এগিয়ে গেছে নয়া উদারীকরণের পথে। পুঁজির বাজারে আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই আর্থিক নীতি। ১৯৯১ সালের পর আমাদের চোখের সামনে এসেছে হর্ষদ মেহতা, কেতন পারেখ ইত্যাদির ঘটনা। কিন্তু সে সব থেকে ছাপিয়ে গেছে বর্তমানের আদানি কেলেঙ্কারি। তার কারণ নয়া উদারীকরণ ত্রিশ বছরব্যাপী যে পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে তা লুঠেরা পুঁজিবাদ বা ধান্দার ধনতন্ত্র। এখানে সম্পদ ক্রমাগত লুঠ হয়ে যাচ্ছে কোটিপতি করপোরেটের হাতে। সেই করপোরেটকে সযত্নে লালন পালন করে দেশের সরকার যা বিজেপি’র সরকার।তাই অতীতের সংকটগুলি সবটাই ঘটেছে দেশের অভ্যন্তরের পুঁজির গণ্ডিতে। কিন্তু বর্তমানে তা দেশের বাইরে ছাপিয়ে চলে গেছে। এই ঘটনার কথা প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক শর্ট সেলার বিনিয়োগকারী সংস্থা হিন্ডেনবার্গ। তাই এই সংকটের মতো কোনো সংকট স্বাধীন ভারতে ঘটেনি। আগের সংকটগুলিও জানা গেছে দেশের সংবাদপত্র থেকে। কিন্তু এবারে আমরা খবর পেলাম বিদেশি এই সংস্থা থেকে। নিঃসন্দেহে বিপদের মাত্রা অনেক বেশি।

আমরা খবর পেলাম বিদেশের বিনিয়োগকারী সংস্থা থেকে। এতদিন পুঁজির বাজারে যে কেলেঙ্কারির কথা আমরা জানতাম তা দেশের ভিতর থেকে জানতে পেরেছিলাম এমন সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে যারা বিনিয়োগকারী ছিল না। হিন্ডেনবার্গ সংস্থা কিন্তু কোনো উৎসাহী সাংবাদিক নয়; কোনো স্টিং অপারেশন নয়। এটিও এক বিনিয়োগকারী সংস্থা। এদের বলে শর্ট সেলার। তারা কারা? এরা অপেক্ষা করে যখন স্টক বাজার পড়তির দিকে। যখন দাম বেশি এরা ঋণ করে স্টক; তারপর বিক্রি করে এবং যখন দাম কমে যায় তখন সেই স্টক তারা বাজার থেকে কিনে নেয়। তাহলে যে পরিমাণ ঋণ করে সেই পরিমাণ ফেরত দিলে এদের লাভ হয়। অর্থাৎ এই ধরনের সংস্থা বসে থাকে কখন শেয়ারের দাম কমছে। সাধারণত শেয়ারের দাম বাড়লে মুনাফা হওয়ার কথা; কিন্তু এই শর্ট সেলার এমন এক ফাটকাবাজ যাদের মুনাফা বাড়ে দাম কমলে। ফাটকা পুঁজি এভাবেও মুনাফা করে। এমনই এক সংস্থা হলো হিন্ডেনবার্গ সংস্থা। একটি বিদেশি সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার সম্পর্কে এই অনুসন্ধান করেছে কারণ এইভাবে পুঁজির বাজারে ফাটকা পুঁজিতে বিনিয়োগ করা খুবই বিপজ্জনক; তাকে সব ধরনের শেয়ারের খোঁজ খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখতে হয়। তাই তারা গবেষণা চালায়। এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার সম্পর্কে আদানি অসত্য তথ্য দিয়ে দাম বাড়িয়ে রেখেছে । এদের উপর বিশ্বাস রাখলে তো ফাটকা পুঁজির বাজারে আতঙ্ক নামবে। সেই আতঙ্ক থেকেই বিশ্বের ফাটকা পুঁজির বাজারের এক প্রতিনিধি হিন্ডেনবার্গ আদানিকে চিহ্নিত করে অভিযোগ এনেছে। শর্ট সেলার এবং তার অনুসন্ধান অনেক সময়েই বিশ্বায়িত বিশ্ব পুঁজির কাছে চিন্তার বিষয়। অসাধু প্রচেষ্টা এই অনুসন্ধানে ধরা পড়ে যেতে পারে। হিন্ডেনবার্গ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এক শর্ট সেলার কোম্পানি। এরা করপোরেটের অসাধু উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের ওয়েবসাইটে তথ্য দিয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে তারা আদানি সহ আরও তিনটি গোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য ফাঁস করেছে। তারা এই তথ্য অনুসন্ধান করে বিশ্ব পুঁজির বাজারে সব শর্ট সেলারদের জানার স্বার্থে; তাদের নিজেদের বাঁচার স্বার্থে। এই ফাটকা বিনিয়োগকারীরা যেহেতু দাম বাড়লে শেয়ার ঋণ নেয় এবং সেই বেশি দামে বিক্রি করে দাম কমলে কিনে নিয়ে ঋণ শোধ করে শেয়ারের পরিমাণে; কেউ যদি জালিয়াতি করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে রাখে; তাহলে তো শর্ট সেলারের ক্ষতি। হিন্ডেনবার্গ নিজের এবং অন্যান্যদের ফাটকা পুঁজির বাজারের স্বার্থ দেখেই তাই রিপোর্ট ফাঁস করেছে। এখানেই দেশে অতীতের সংকটের চেয়ে এই সংকটের মাত্রা ভিন্ন। এবার আঙুল উঠেছে বিশ্ব পুঁজির বাজার থেকে। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে ভারতের পুঁজির বাজার নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন উঠেছে।

মোদি সরকার কিন্তু এই বিষয়ে নিশ্চুপ। অন্যান্য অনেক শক্তি একথাও বলল যে সবসময় তো করপোরেট মুনাফা করবে না; করপোরেটের ক্ষতি হয়েছে তো দেশের কি আসে যায়? কিন্তু দেশের ইতিহাস তো আদানির উত্থানের ইতিহাস এতদিনে জেনে গেছে। প্রচ্ছন্নভাবে মোদি এবং তাঁর পরিচালিত বিজেপি সরকার আদানি গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে তাকে করপোরেট সম্রাট করেছে। তাই দেশের সরকার যখন বেসরকারিকরণ করে; তখন আসলে তা হয় আদানিকরণ। প্রতিযোগিতা নয়; আসলে মোদি মালিকানা আর আদানি মালিকানা একত্রিত হয়ে গেছে এই দেশে। এখানেও সংকট। দেশের বহু সম্পদ তার মধ্যে রয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের শেয়ার, ভারতের জীবনবিমা নিগম, আরও অনেক কিছু সযত্নে তুলে দিয়েছে মোদি আদানির হাতে। এখনকার ফ্যাসিবাদী শক্তির আকার এইরকম। তারা এই পুঁজির আধিপত্যে লালিত পালিত হয়। তাই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের পর কী হলো? বিজেপি দল এবং সরকারের মনোভাবে বোঝা গেল আদানিই যেন ভারত; হিন্ডেনবার্গ সংস্থা যেন ভারত আক্রমণ করেছে। আদানি হিন্ডেনবার্গ সংস্থাকে যে ৪১৩ পাতার উত্তর দিয়েছে তাতেও ভারতের বিপক্ষে তারা সওয়াল করছে এমন কথা জানিয়েছে। ভারতের সাথে এই সংস্থার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বর্তমানে বিশ্ব পুঁজির বাজার শুধু ফাটকা, লুঠেরা নয়; তার চরিত্র তরল। যে কোনো গোষ্ঠী যে কোনো স্থানে বিনিয়োগ করে আবার তুলেও নেয় সেই বিনিয়োগ যে কোনো সময়। সব ধরনের পুঁজি পুঁজির এই বিশ্বায়িত বাজারে মুনাফার সন্ধানে আসে। এই মুনাফার সাথে দেশের মানুষের যোগাযোগ স্থাপন করে দিলো মোদি সরকার বেসরকারিকরণকে আদানিকরণে রূপান্তর করে। তাই হিন্ডেনবার্গ হল দেশবিরোধী। এটি শুধু অবাস্তব নয়; আদানিকে বাঁচানোর স্পষ্ট উদ্যোগ। এদিকে শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর ধস অব্যাহত। ব্লুমসবার্গের সূচকেও আদানির পতন লক্ষণীয়।বহু দেশে এইভাবে পতন ঘটলে তাকে দেশের পুঁজির বাজার থেকে সেই দেশের সরকার সরিয়ে দেয়। দেশ তাকে মনেও রাখে না। কিন্তু আমাদের বিপদ এই যে, দেশের সরকার এবং ফ্যাসিবাদী অতি দক্ষিণপন্থী দল এই সংস্থার সাথে আত্মস্থ; তারা এখনও তাদের হাতে দেশের সম্পদ তুলে দিতে চায়। সংসদে বিরোধী শক্তির তোলপাড়ের পর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নড়েচড়ে বসেছে। সেবি কোনো ভূমিকা নেয় নি তার কারণ, সেবির কর্তৃপক্ষের সাথে আদানির পারিবারিক যোগাযোগ। এরকম ধাঁচায় চলে আমাদের পুঁজিবাদ - পুরোপুরি কোথাও বাজারের নিয়ম নয়; বাজার চলে রাজনৈতিক আধিপত্যে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। হিন্ডেনবার্গের মতো সংস্থা সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করবে যে, শেয়ারের দাম পড়া উচিত এবং বিশ্বাসযোগ্যতা কমাবে। এতে তার স্বার্থ আছে। ফাটকা পুঁজির বাজারে এরকম ঘটে-এত কথা প্রকাশ্যে জানা যায় না; ফাটকাবাজদের মধ্যেই তা ঘোরাফেরা করে। এইবার দেখা গেল দেশ বিদেশ সব জায়গা থেকেই আদানির শেয়ারের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেল। একটি এফপিও বাজারে ছেড়ে তা বাজেট পেশের পরেই গুটিয়ে নিল আদানি। উদ্ধত করপোরেট সম্রাটকে ভয়ার্ত দেখাচ্ছে, নিরাপত্তাহীন মনে হচ্ছে। কেন? তার এই উত্থানের পিছনে কি ছিল ফাঁপা আওয়াজ? আসলে কি এই উত্থানের সাথে জালিয়াতি যুক্ত? এই প্রশ্নগুলিই সামনে এনেছে হিন্ডেনবার্গ সংস্থার রিপোর্ট। সংস্থা সম্পর্কে আমাদের কিছু না জানলেও চলবে। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এই সংস্থার রিপোর্টের ফলাফল। সেটিই যথেষ্ট পরিস্থিতি বোঝার জন্য।

দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সব ব্যাঙ্ক এবং সংস্থার কাছে আদানি গোষ্ঠীর সাথে তাদের আর্থিক বোঝাপড়ার খতিয়ান চেয়েছে। বিরোধীরা সংসদে, রাজপথে এক সুরে কথা বলছে। একা হয়ে গেছে এ রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের একাধিক প্রকল্পে ঢালাও অনুমতি দিয়েছে এই সরকার আদানি গোষ্ঠীকে। তাজপুর বন্দর থেকে দেউচা পাঁচামির মতো বিতর্কিত প্রকল্প রাজ্যবাসীর বিক্ষোভের মুখে দাঁড়িয়েও আদানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেই সিদ্ধান্তে দাঁড়িয়ে আছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। অধিকাংশ প্রকল্প নিয়েই আদালতে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। আদানি গোষ্ঠী কতটা নিরাপদ বর্তমানে বাজার জানান দিচ্ছে। রাজ্যবাসীর এখানেই প্রশ্নঃ যার উপর বিশ্ব পুঁজি, দেশের পুঁজি আস্থা হারাচ্ছে, তার উপর অতীতের বিতর্ক ভুলে গিয়ে কীভাবে আস্থা রাখছে রাজ্য সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে? কোনো শিল্প হয়নি এ রাজ্যে এই জমানায়। তাই কি আদানি, তার নির্বাচনী বন্ড এবং আর্থিক সমর্থনের সাহায্য নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবে তৃণমূল কংগ্রেস? যেভাবে মোদিকে গদিতে রাখতে সাহায্য করেছে আদানি, সেই একই পদ্ধতিতে আস্থা আছে তাহলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর। পুঁজির ফাটকা খেলার আধিপত্যে হারিয়ে যাবে কি রাজ্যবাসীর জনকল্যাণ? আমাদের কাছে এখন এটিই বড়ো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।