E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯

শিক্ষার “ভারতীয়করণ”

নন্দিনী মুখার্জি


বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্প্রতি ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে বেশ কয়েকটি নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন সিদ্ধ চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার জন্য সিদ্ধ দিবস উদযাপন, মকরসংক্রান্তি উদযাপন ইত্যাদি। তবে এই ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর কখনো মঞ্জুরি কমিশন, কখনো মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের (শিক্ষা দপ্তর) পক্ষ থেকে এইরকম নানাধরনের নির্দেশিকা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় ঐতিহ্যকে বহন করার নাম করে।

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং তার আলোকে নতুন করে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর উপর ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতির প্রভাবকে উল্লেখ করে বলা হয়েছে। “পৃথিবীর ঐতিহ্যের এই উত্তরাধিকারকে শুধুমাত্র উত্তরসূরিদের জন্য লালন করা বা সংরক্ষণ করা নয়, এই ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা এবং তাকে উন্নত করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুনভাবে ব্যবহার করতে হবে”। এই প্রসঙ্গে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, বা ভারতের প্রাচীন এবং ধ্রুপদি ভাষাগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলা - এই সমস্ত বিভিন্ন কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বাধীনোত্তর ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় ঐতিহ্য ও তার সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে এবং প্রত্যেক ভারতবাসীর প্রয়োজনকে অনুধাবন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য যে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, স্বাধীনতা লাভের পরে ৭৫ বছর সময় ধরে তা নেওয়া যায়নি। জনশিক্ষার প্রসারের যে নীতি স্বাধীনতার পরবর্তীতে সরকারের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল, তার কিছুটা সাফল্য সাক্ষরতার বৃদ্ধির হারে পরিলক্ষিত হলেও, এখনো পর্যন্ত সাক্ষরতার হারে, বিশেষ করে মহিলা সাক্ষরতার হারে সমগ্র পৃথিবীর গড় থেকে ভারত অনেকটাই পিছিয়ে। স্কুলছুটের সংখ্যাও এই দেশে অনেকটাই বেশি, ১৫ শতাংশের আশেপাশে। ভারতীয় সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল পরবর্তী দশ বছর, অর্থাৎ ১৯৬০ সালের মধ্যে ১৪ বছরের নিচে সমস্ত শিশুদের জন্য বিনাখরচে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সংবিধানের নির্দেশ এবং দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন, কোঠারি কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় থেকে চোদ্দ বছর পর্যন্ত বিনা খরচে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য সরকারের যে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন ছিল তাতে বহুলাংশেই ঘাটতি থেকে গেছে। বরং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অনুমোদন দেওয়ার পরিণামে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে পড়াশোনা করা গরিব ও প্রান্তিক পরিবারের ছেলে মেয়েদের পক্ষে সাধ্যাতীত। অথচ এই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে পরিকাঠামোর দিক দিয়ে পাল্লা দেওয়ার জন্য সরকারি যে অর্থানুকুল্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়োজন ছিল, সেখানে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে বিশাল ঘাটতি। ভারতীয় স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার বিপুল ঘাটতি প্রভাব ফেলেছে উচ্চশিক্ষার উপরেও, কারণ এক বিশাল সংখ্যায় ছেলেমেয়ে নিয়মিতভাবে উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়ায় উচ্চশিক্ষার দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না। সুতরাং, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে তার ঔপনিবেশিক ধারা থেকে মুক্ত করে অবশ্যই ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি, তার জনসাধারণের প্রয়োজনকে ভিত্তি করে এবং সার্বিকভাবে দেশের সামগ্রিক প্রগতিকে লক্ষ্য করেই পুনর্গঠন করা প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু প্রশ্ন হলো - যে ভারতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতিতে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে তার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে দেশের নীতি নির্ধারণকারীদের ধারণা কীরকম। ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যে ভারতীয় সংস্কৃতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে নিয়ে আসতে চায় সেটা একেবারেই একমুখী এক সংকীর্ণ ভাবধারার সংস্কৃতি। ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি শুধুমাত্র বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানের ফলে গড়ে উঠেছে তা নয়, বিভিন্ন ভাষা, উপভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি, পরম্পরা ইত্যাদি নানান অনুঘটকের প্রভাবে এই সংস্কৃতি বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। অথচ, এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির উপর গবেষণা বা এই বিভিন্নতাকে মর্যাদা দিয়ে যে সামগ্রিক শিক্ষা তাকে কোনোপ্রকার গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে একটা সংকীর্ণ ভাবধারাকে অনুসরণ করতে। একটা নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী কিছু সংখ্যক মানুষের আচরিত যে রীতিনীতি তা সমগ্র শিক্ষক এবং ছাত্রকুলের জন্য বাধ্যতামূলক করে তোলা হচ্ছে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী হলেও প্রত্যেক অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যেও ধর্মাচরণে বিভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে শিক্ষা জগতের নীতি নির্ধারকরা উদাসীন। অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র একটি ধর্মের বিষয়ে আলোচনা করা এবং সেই ধর্মকে অনুসরণ করে কিছু কাজকর্ম করতে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বাধ্য করা ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। আসলে দেশের সরকার এবং শিক্ষা জগতের নীতি নির্ধারকরা এই ধরনের নির্দেশিকার মধ্য দিয়ে দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়। দীর্ঘ সময় ধরে বহাল থাকা ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধার মনোভাবকে সরিয়ে শিক্ষাজগতের উপর চাপিয়ে দিতে চায় একমুখী চিন্তাভাবনা, অসহনশীল মনোভাব এবং পিছিয়ে পড়া সামাজিক রীতিনীতির প্রতি বিশ্বাস।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন শাস্ত্র ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে জমকালো কিছু ধ্যানধারণা তৈরি করে এটা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা যে, মানবজীবনে আধুনিক বিজ্ঞান যা যা অবদান রেখেছে, তার সমস্তই আসলে অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের সম্ভারের মধ্য থেকেই। অর্থাৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ভারতের অবস্থান যেন এক জগৎগুরুর ভূমিকায়, যার প্রদর্শিত পথ ধরেই পৃথিবীর অগ্রগতি হয়েছে। আর্যভট্ট, বরাহমিহির, চরক কিংবা সুশ্রুত - এদের অবদানকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েই বলা যায় যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি কোনো নির্দিষ্ট দেশ, কাল, ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বরং উদার পরিবেশে পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্য দিয়েই জ্ঞানের প্রসার ঘটে। বর্তমান সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের এইরকম সংকীর্ণ মনোভাব বাস্তবে দেশের শিক্ষার অগ্রগতিতেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং ছাত্রছাত্রীদের মুক্ত চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সমস্ত ধরনের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারা এবং দেশ-বিদেশের জ্ঞান চর্চার বিশেষ ফলাফলগুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখাই একটি শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সরকারের নির্দেশিকাগুলি অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ এবং এর দ্বারা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পুরোপুরি অবহেলিত। আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বহু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়েও ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সাহিত্যিক এবং অন্যান্যরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অথচ, সেই অবদানগুলিকে কার্যত অস্বীকার করে বারবার প্রাচীন সময়ের জ্ঞানচর্চার উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে বিগত কয়েক শতাধিক বছরের দেশের অগ্রগতিকে ধূলিসাৎ করা হচ্ছে এবং ভারতীয় সমাজের সম্মিলিত জ্ঞান সম্ভার যা বহু বছরের চর্চায় গড়ে উঠেছে তাকেই পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি গুজরাট সরকার বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ভাগবত গীতার অন্তর্ভুক্তিকরণের কথা ঘোষণা করেছে। গীতা পড়ানো এবং ছাত্রদের গীতার বিভিন্ন শ্লোকের ব্যাখ্যার সাথে সাথে শ্লোকগুলি কণ্ঠস্থ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (খেয়াল রাখা দরকার যে, এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র গীতা বা অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রেই নেওয়া হচ্ছে। ভারতের অন্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলির বিষয়ে এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত কোনো সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই নেওয়া হয়নি বা এই বিষয়ে আলোচনাও হয়নি।) এই সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই গুজরাট সরকার প্রথম শ্রেণি থেকেই ইংরেজি ভাষাকে আবশ্যিক করা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অঙ্ক ও বিজ্ঞান বিষয়গুলি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা সরকারি স্কুলগুলিতে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদানের নীতির পরিপন্থী। অর্থাৎ একদিকে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নামে যেমন একটি বিশেষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ আবশ্যিক করা হচ্ছে, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক চিন্তার ধারাতেই সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিদেশি ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত এক অংশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং স্কুলছুটের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।

২০২২ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু বলেছিলেন যে, “আমাদের (অর্থাৎ বিজেপি সরকারকে) শিক্ষার গৈরিকিকরণের জন্য দায়ী করা হয়। গৈরিকিকরণে অসুবিধা কোথায়?” তিনি বলেন যে, “দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিকতা আমাদের নিজেদের মনে হীনম্মন্যতার জন্ম দিয়েছে।’’ এই বিষয়ে মেকলের নীতিকে দায়ী করে তিনি বলেন যে, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা এবং মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা দেশের শিক্ষাকে দুর্বল করে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ভারতীয়করণের নাম করে আসলে শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতি দেশের সব ছাত্রছাত্রীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। একই সাথে এর আড়ালে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, সম্পূর্ণভাবে আমেরিকা এবং আমেরিকার অনুকরণকারী দেশগুলির শিক্ষাব্যবস্থার আদলে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চলছে।

যেমন প্রথম বিষয় হলো, অনলাইন এডুকেশনের উপর বিশেষ গুরুত্ব। অতিমারীর সময়ে একথা প্রমাণিত যে, অনলাইন এডুকেশন বাস্তবে আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ। বরং অতিমারীর সময়ে দেশের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী অনলাইন এডুকেশনের সুযোগ নিতে পারেনি উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার দরুন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জ্যঁ দ্রেজে এই পরিস্থিতিকে আখ্যা দিয়েছেন “The myth of online education”। অথচ, শুধু জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, অল ইণ্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন সহ অন্যান্য শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সরকারি সংস্থাগুলি অনলাইন এডুকেশনের উপর ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব আরোপ করে যাচ্ছে। ফলে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারা ও সুযোগ না নিতে পারা এই দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল ফারাক তৈরি হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রয়োজনকে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে বার বার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং-এর মতো বিষয়গুলির উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা। এই বিষয়গুলি বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইগুলি ছাড়াও অন্যান্য বিষয় আছে, যেমন স্থাপত্যবিদ্যা, যন্ত্র প্রকৌশল বিদ্যার মতো প্রযুক্তি সম্পর্কিত পাঠক্রম, অথবা মহাকাশ বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞান পাঠক্রম, যাতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলা এবং উপযুক্ত মানব সম্পদ তৈরি করা সমগ্র দেশের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয়। এর জন্য প্রয়োজন মানব সম্পদ সম্পর্কিত এক সুসংহত পরিকল্পনা এবং তার উপর ভিত্তি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নতুন পাঠক্রম চালু করার জন্য অনুমোদন দেওয়া। সরকারি নীতি দেশের প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে একেবারেই উদাসীন এবং ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। এর প্রভাব কর্মসংস্থানের উপর পড়তে বাধ্য, যা বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছে।

তৃতীয়ত, শিক্ষার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণের দিকে ঝোঁক। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি যে সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল তাতে ক্রমান্বয়ে বর্ধিত ঘাটতি এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে তুলছে। আমাদের রাজ্য সহ বিভিন্ন রাজ্যে বহু সরকারি স্কুল বন্ধ বা প্রায় বন্ধের মুখে। স্কুল শিক্ষায় সরকারি উদ্যোগ ভয়ঙ্করভাবে হ্রাস পেয়েছে। গবেষণার জন্য অনুদান, বিশেষ করে রাজ্যের অধীনে থাকা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রায় বন্ধের মুখে। অথচ কিছু পশ্চাৎমুখী গবেষণার জন্য অনুদান দেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু, ২০২০ সালের শিক্ষানীতিতে আন্তর্জাতিকীকরণের নাম করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ভারতে ক্যাম্পাস তৈরির জন্য ছাড়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। এর উপর ভিত্তি করেই মাত্র কয়েকদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি খসড়া বিধি প্রস্তাব করেছে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতে ক্যাম্পাস তৈরির জন্য উৎসাহিত হতেই পারে, কারণ বর্তমানে এদের অধিকাংশই ছাত্রের অভাবে বিপন্ন বোধ করছে। কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শিক্ষার উৎকর্ষতা বজায় থাকবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশের সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পরিকাঠামো এবং অর্থের অভাব থাকা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই দেশের সেরা ছাত্ররা পাশ করে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতার পরিচয় রাখছে। সুতরাং, এই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিকাঠামো ও অর্থের জোগানের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিকমানে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টাই শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল। অথচ বেসরকারিকরণের দিকে বেশি ঝুঁকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্বকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

ভারতীয়করণের নাম করে বাস্তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক প্রাচীন এবং অগ্রগতির পরিপন্থী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে যা ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকেই অস্বীকার করে। আর এই তথাকথিত ভারতীয়করণের আড়ালে মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে আমাদের দেশের পক্ষে অনুপযুক্ত এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, যা এক বিরাট অংশের শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করবে। প্রতিটি শিশুর সংবিধান প্রদত্ত শিক্ষার অধিকারকেই বিপন্ন করে তুলতে চাইছে বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ও আমাদের রাজ্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি ও পদক্ষেপ।