E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯

সংবিধান বাঁচাও - রক্ষা করো স্বদেশ

সুপ্রতীপ রায়


মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবার সংসদে প্রবেশ করেছিলেন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এ দৃশ্য নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। এটা দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল মোদি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার সদস্যগণের দেশের সংবিধানের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য রয়েছে। ২০১৫ থেকে প্রতিটি সাধারণতন্ত্র দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা শুনেছি। কিন্তু কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

সংবিধান রক্ষার বিষয়টি কেন সামনে আসছে। কেন এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সংশয়? সংবিধান মানে কি কেবল একটি বই? নিষ্প্রাণ দলিল? সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন দেশ রক্ষার তাগিদেই রচনা করেছিলেন।মোদি রাজত্বে সেই সংবিধান বিপন্ন। আমাদের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। আজ ভারতের সাংবিধানিক নীতিগুলি আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে আমাদের সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে ধুলিসাৎ করার খেলায় মেতেছে বিজেপি।

আমাদের দেশের বর্তমান শাসকরা যাদের দ্বারা পরিচালিত হন সেই আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে ছিল শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়,ওরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। একথা আমরা জানি, স্বাধীন ভারতে যে সংবিধান চালু হয় এবং জাতীয় পতাকা গৃহীত হয় তা আরএসএস-র মনঃপূত ছিলনা। কারণ আরএসএস মনুসংহিতার বিধান অনুযায়ী সংবিধান রচনার পক্ষপাতী। তিন রঙা জাতীয় পতাকার বদলে গেরুয়া ঝান্ডার পক্ষে। একারণে জাতীয় কংগ্রেস যখন তেরঙ্গা ঝান্ডা উড্ডীনের কর্মসূচি নিয়েছিল তার বিরোধিতা করেছিল আরএসএস। আরএসএস স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করতে থাকে এবং গান্ধী হত্যা ছিল বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ।

১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর গোপনে বাবরি মসজিদের ভিতরে রামের একটি বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। একাজে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন অযোধ্যার সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরুদত্ত সিং ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে নায়ার। এই দুই আমলা পরবর্তীতে ভারতীয় জনসংঘে যোগ দেন। বলা বাহুল্য, জনসংঘ বিজেপি’র সাংগঠনিক পূর্বসূরি। আমাদের সংবিধানের প্রতিজ্ঞা ছিল সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার। এর বিপরীতে গিয়ে আরএসএস’র লক্ষ্য জঙ্গি হিন্দু রাষ্ট্র গড়া। ফলে আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ বিজেপি'র হাতে কখনই ভারতের সংবিধান সুরক্ষিত থাকতে পারে না।

আমাদের সংবিধান আসলে কী? দেশের জনগণকে পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে দেশের সংবিধান। রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ আইন সভা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন সবই গঠিত হয় সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধান এই অঙ্গগুলির ক্ষমতা ও দায়িত্বের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে এবং জনগণের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশের কাঠামো যুক্তরাষ্ট্রীয়। সংবিধানে বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা, এদের সীমানা নির্ধারণ, ক্ষমতা বণ্টন করা আছে। সংবিধান কখনই প্রাণহীন একটি দলিল নয়। কীভাবে এবং কাদের দ্বারা সাংবিধানিক নীতিসমূহ কার্যকর হচ্ছে তার উপরেই নির্ভর করে সংবিধানের আদর্শ আদৌ রক্ষিত হচ্ছে কিনা?

আমাদের বর্তমান সংবিধান ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি চালু হয়। মূল সংবিধানের ২২টি অংশ, ৩৯৫টি অনুচ্ছেদ এবং ৯টি তফশিল আছে।সংবিধান বিভিন্ন সময়ে সংশোধন হয়েছে।মোদি আসার পর নানা পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে কার্যত সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। এটি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সার্বভৌম সংবিধান সভায় পরিণত হয়। গণপরিষদের সদস্যগণ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সাধারণতন্ত্রের মূলভিত্তি বলে মনে করতেন। দেশকে এক রাখার তাগিদ এবং দীর্ঘসংগ্রামের ফলে যে স্বাধীনতা আমরা লাভ করেছি তাকে রক্ষা করার প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়েছে সংবিধানে।

প্রত্যেক সংবিধানেই তার নিজস্ব দর্শন থাকে। আমাদের সংবিধানের উদ্দেশ্য ও সংকল্প ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি সংবিধান সভায় গৃহীত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সংবিধান রচনার প্রতিটি পর্যায়ে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য সংকল্পে যে কথাগুলি বলা ছিল তার মধ্যে বলা ছিলঃ ভারতের সকল অধিবাসীকে বিধি ও সর্বসাধারণের নৈতিকতা সাপেক্ষে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ও সুযোগের সমানতা এবং আইনের সামনে সমানতা, চিন্তার, মতপ্রকাশের, বিশ্বাসের, ধর্মের, উপাসনার, বৃত্তির, মিলনের ও কর্মের স্বাধীনতার প্রত্যাভূতি দেওয়া হবে ও তা প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং সংখ্যালঘুদের, অনগ্রসর ও উপজাতি অঞ্চলগুলির এবং অবদমিত ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য পর্যাপ্ত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হবে। সংবিধান রচনার সময় যে সংকল্প ঘোষিত হয়েছিল এবং আদর্শ উচ্চারিত হয়েছিল তা সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে।

সংবিধানের প্রস্তাবনা বলতে কী বোঝায়? আমাদের সংবিধান আকারে বিশাল, এর দার্শনিক ভিত্তি আছে, মূল আদর্শ আছে,মূল কথা আছে। এগুলিকে সারসংক্ষেপ করে লেখাটিকেই প্রস্তাবনা বলে। সংবিধান রচনায় চারটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আছে - ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ, আইনগত দৃষ্টিকোণ, তাত্ত্বিক ধারণা, সমসাময়িক রাজনীতি। আমাদের দেশ বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্যময়। প্রস্তাবনায় এর প্রতিফলন আছে। প্রস্তাবনাকে বলা চলে ‘দার্শনিক মশাল’। যে ‘আলো দেখাচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে’। দার্শনিক মশালের আলোয় সংবিধানকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রস্তাবনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই মূল নীতিগুলি দেওয়া আছে।প্রস্তাবনা একবারই সংশোধন হয় ১৯৭৬ সালে।

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সভার উদ্বোধনী ভাষণে সংবিধান সভা কর্তৃক সংবিধান রচনার অসুবিধা ও বাধাবিঘ্নের উল্লেখ করেছিলেন। সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, সংবিধান সভা একটি স্বাধীন সংস্থা এবং এই সভা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের যথাযথ প্রয়োগ যাতে সম্ভব হয় তার চেষ্টা করবে। সমস্ত বাধা বিঘ্ন ও সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে এই সংবিধান সভা স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের জন্য এমন একটি সংবিধান রচনা করবে যাতে দেশের সকল ধর্ম, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ - এককথায় দেশের প্রতিটি অধিবাসীই যেন সন্তুষ্ট হ'তে পারেন। সকলেই যেন কাজ, ধর্মচর্চা, উপাসনা, চিন্তা, নিজ নিজ শিক্ষা ও শিল্প সংষ্কৃতির উন্নতি সাধন প্রভৃতি বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন।

কিন্তু ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বক্তব্যের কতটা স্বাধীন ভারতে রক্ষিত হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি প্রায় ন’বছর সরকার পরিচালনা করছে। এই সময়কালে সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলির উপর সুসমন্বিত বহুমুখী আক্রমণ চলছে। হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে ভারতরাষ্ট্র এক অভূতপূর্ব দমনমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের দরবারে চিহ্নিত হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির তাণ্ডবে ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র বিপন্ন। তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়েছে। দেশের শত্রু চিহ্নিত করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর শাসকগোষ্ঠীর মদতে ও সক্রিয় সহযোগিতায় আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে। আরএসএস বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ কায়েম করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। জাতব্যবস্থা ও পিতৃতন্ত্রের আগ্রাসন বেড়ে চলেছে। দলিতদের উপর সহিংস আক্রমণ চালাবার অধিকার বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অলিখিতভাবে দিয়েছে বললে কি ভুল বলা হবে? জাতীয়তাবাদের বিকৃতি ঘটিয়ে ‘হিন্দুত্ব’র ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরছে।

প্রস্তাবনাতে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে সেকুলার,ধর্ম হবে যার যার নিজের।অর্থাৎ ধর্ম যার যার নিজের,কিন্তু দেশ সবার। ৪২ তম সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। এটা ঠিক, প্রস্তাবনায় পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি সংবিধান চালুর প্রথম দিক থেকেই সংবিধানে যুক্ত ছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। এটা পরিষ্কার ছিল প্রস্তাবনার প্রথম সংশোধনের আগে থেকেই - ১৯৪৯ সালে। কারণ সংবিধানের ২৫, ২৬, ২৭, ২৮নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া আছে। সংবিধানে একথা খুব পরিষ্কার করে বলা আছে - প্রতিটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা যে কোনো সংখ্যালঘু মানুষ যেন সম্পূর্ণ নিরাপত্তাবোধ করেন।

‘‘ভারতের সাংবিধানিক আইনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের কার্যকর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬, ১৯, ২৫-২৮, ৪৪ প্রভৃতি অনুচ্ছেদে, এমনকী অসংশোধিত মূল প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার অর্থ অন্য সব কিছুর সঙ্গে বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতাও বোঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, সকলের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা - এই আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকারে সোচ্চার ছিল, প্রস্তাবনাটি মর্যাদা ও সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা এবং ভারতের সকল জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের নীতির মাধ্যমে এই অঙ্গীকার আরও শক্তপোক্ত হয়েছে।’’ (আমাদের সংবিধান-সুভাষ সি কাশ্যপ / পৃষ্ঠাঃ ৪৭)। আসলে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শ যুক্ত করে নানা ধর্মের দেশ ভারতের জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে।

মোদি দ্বিতীয় দফায় দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছেন ঠিক। কিন্তু মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষের ভোটে জিতেছেন। এটাও ঠিক যাঁরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী, হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইছেন, তাঁরা সংখ্যাতে নগণ্য। বেশিরভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পক্ষে। এই কারণেই এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের হাতে প্রস্তাবনার কপি, ভারতীয় সংবিধানের বই ছিল। আমাদের দেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যে পরধর্মে ঘৃণাকে চিরকাল একটা পাপ বলে মনে করা হয়েছে। রামকৃষ্ণ বলেছেনঃ পরের ধর্মকে ভালো না বাসতে পারলে পাপ। বিবেকানন্দ, চৈতন্যদেব একই ধরনের কথা বলেছেন।

মোদি জমানায় ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন। এই সময় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা ছড়ানো তীব্র গতিতে বেড়েছে। গতবছরের শেষের দিকে ওয়াশিংটনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই সংস্থাটি বিশ্বের ১৯৮টি দেশের উপর সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়ঃ সামাজিক বিদ্বেষসূচক বা সোশ্যাল হস্টিলিটি ইনডেক্স-এ ভারত রয়েছে এক নম্বরে। রিপোর্ট বলেছে - কোভিডের সময় অতিমারীর নানান বিধি নিষেধের মধ্যেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যম এবং করোনা জিহাদ হ্যান্ডেলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে।

গত আট বছরে ভারত সরকার, বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি ধর্মান্তরীকরণ-গোহত্যা-ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিবাহ সংক্রান্ত প্রশ্নে মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত, আদিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। মোদি সরকার সমালোচনামূলক স্বরকে লাগাতারভাবে কণ্ঠরোধ করে চলেছে, বিশেষত তা যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থে হয়। যাঁরা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাঁদের উপর নজরদারি চলছে, হেনস্তা চলছে, দানবীয় আইনে আটক করা হয়েছে। গতবছর ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্ট বলছে - ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশের সংবিধান যখন ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করেছে,তখন তাকে পদদলিত করে বর্তমান ভারত সরকার বিভেদমূলক দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে। বিজেপি শাসনে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, আরএসএস হচ্ছে আগ্রাসী হিন্দুত্বের সংগঠন, যারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের বদলে হিন্দুত্বের সংবিধান চায়।

২০১৮ সালে জুবেইরকে একটা টুইটের জন্য গ্রেপ্তার করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল - তিনি নাকি হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়েছেন। বিজেপি’র মুখপাত্র ইসলাম ধর্মগুরু হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করলেও তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও সিদ্দিক কাপ্পান, তিস্তা শীতলবাদ, উমর খালিদ, ফাদার স্ট্যানস্বামীকে বিনা কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলের ভেতরে স্ট্যানস্বামীকে যথাযথ চিকিৎসা না করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।

উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ধুলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমোদনক্রমে বিলকিস বানোর গণধর্ষক ও খুনের আসামীদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

সিএএ এবং এনআরসি’র নাম করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। শরণার্থীদের সুরক্ষার নামে ধর্মীয় পরিচয়টিকেই একমাত্র বিচার্য বিষয় করা হয়েছে। ধর্মের পরিচয়টিকে সামনে এনে সংখ্যালঘুদের দেশহীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শাসকদল। গোমাংস রাখার মিথ্যা অজুহাতে মহম্মদ আখলাককে খুন, পেহলু খানের হত্যা, জামিয়ায় অমিত শাহ’র পুলিশ বাহিনীর তাণ্ডব ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের উপর আক্রমণ। গুজরাটে গণহত্যার কারবারিদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যখন থাকে তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্কবোধ স্বাভাবিক। সরকারি হিসেবেই জানা যায়, গুজরাট গণহত্যাতে ১,০৪৪ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, এরমধ্যে মুসলিমও ছিলেন। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। সদ্য সমাপ্ত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই গুজরাট গণহত্যার বৈধতা দিয়ে বলেছেন, ২০০২ সাল থেকে গুজরাটে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গোধরা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক চন্দ্র সিং রাউলজিকে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছিল। যিনি গুজরাট গণহত্যার সময় গণধর্ষণে যারা যুক্ত ছিল তাদের মুক্তির জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং এই অপরাধীরা মুক্তি পাওয়ায় বলেছিলেন, অপরাধীরা আসলে ‘‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’’। মুজফ্‌ফরনগর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের শাস্তি থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা করে আদিত্যনাথ সরকার। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ উত্তরপ্রদেশের মুজফ্‌ফরনগরের বিশেষ আদালতের বিচারপতি রাম সুধ সিং ২০১৩ সালে সংঘঠিত মুজফ্‌ফরনগর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য যোগী সরকারের আবেদনে সায় দেন। এই দাঙ্গা সংঘটিত হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এখন মোদি শাসনে চলছে হিন্দুত্বের অভিযান। যে সংবিধানকে মেনে চলার অঙ্গীকার নিয়ে মোদি শপথ নিয়েছিলেন সেই শপথ তিনি ভুলে গেছেন।

দেশ রক্ষা করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বাঁচাতে হবেই। এ দায় প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর।