৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯
কেন্দ্রীয় বাজেটে অবহেলিত বিজ্ঞান গবেষণা
তপন মিশ্র
গত ৩ ফেব্রুয়ারি, চেন্নাইতে ২০০৯ সালের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘Gene Machine: The Race to Decipher the Secrets of the Ribosome’ সম্পর্কিত এক আলোচনাসভায় ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে বলেন যে, “Science wilted after Nehru - ” অর্থাৎ নেহরু-পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। সেদিন এই বইটির তামিল সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সূত্র ধরে তিনি আরও বলেন যে, ভারতের স্বাধীনতার আগে একটা সময় ছিল যখন বিশ্বমানের বিজ্ঞানীরা এদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। তাঁদের মধ্যে সি ভি রমন, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং হোমি ভাবার মতো বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেন। স্বাধীনতার পর এই ঐতিহ্য কিছু সময়ের জন্য অব্যাহত ছিল, কিন্তু তা বেশি দিন আর থাকেনি।
গত ১ ফ্রেব্রুয়ারি সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে। এই বাজেটে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি গবেষণা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে সরকার উদাসীন সে কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশের ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মোট বাজেটের মধ্যে, কেবল ১৬,৩৬১ কোটি টাকা (অর্থাৎ মাত্র ০.৩৬%) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই সরকার দেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণায় ২ শতাংশ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ৭,৯৩১ কোটি টাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের জন্য, ২,৬৮৩.৯ কোটি টাকা বায়ো-টেকনোলজি দপ্তরের জন্য এবং ৫,৭৪৬.৫ কোটি টাকা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি গবেষণার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। এই সংস্থাগুলি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করে।
শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণায় গোড়ায় গলদ
শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে গবেষণায় উৎসাহ বৃদ্ধি সম্ভব। এই সরকার যে শিক্ষানীতি নিয়ে বড়াই করে সেই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি-২০২০-তে বলা হয়েছে (ধারা ২৬.১) যে, শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপি’র ৬ শতাংশ ব্যয়বরাদ্দ করতে হবে। এই বছরের বাজেটে শিক্ষার ব্যয় বরাদ্দ হলো ১.১ লক্ষ কোটি টাকা, যা কেন্দ্রীয় বাজেটের মাত্র ২.৫ শতাংশ। এটা শেষ কথা নয়। শিক্ষার জন্য এই সামান্য পরিমাণ বরাদ্দের মধ্যে, একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অনলাইন শিক্ষার সুবিধার্থে ব্যয় করা হবে, ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি এবং এনজিও-র জন্য এই বরাদ্দ থাকবে।
সরকার পরিচালিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার নেই বললে চলে। সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে দেশগুলি উন্নতি চায় তাদের জিডিপি’র ২ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করাই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষিণ কোরিয়া জিডিপি’র ৪.৮ শতাংশ ব্যয় করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যথাক্রমে ৩.৪৫ শতাংশ এবং ২.৪ শতাংশ ব্যয় করে। কিন্তু ভারত বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশে বিশ্বের বৃহত্তম হওয়া সত্ত্বেও জিডিপি’র মাত্র ০.৭ শতাংশ (গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স ২০২২ অনুযায়ী) ব্যয় করে। তাই, বিগত সরকারগুলির মতো, এই সরকারও গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় বৃদ্ধি করেনি বরং হ্রাস করেছে। অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের বাইরে আরও দুটি বিভাগ রয়েছে - পারমাণবিক শক্তি বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি), যার বরাদ্দ ২৫,০৭৮ কোটি টাকা এবং মহাকাশ বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব স্পেস), যার বরাদ্দ ১২,৫৪৩ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ অর্থের ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় বিভাগগুলির বিজ্ঞানী ও কর্মচারীদের বেতনের জন্য। এর বাইরে বিজ্ঞান গবেষণা পরিচালনার জন্য খুব সামান্যই বেঁচে থাকে।
পারমাণবিক শক্তি বিভাগের বরাদ্দের এক বড়ো অংশ নতুন চুল্লি নির্মাণ এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর জন্য বরাদ্দ থাকে এবং সামান্য অংশ এর অধীনের প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণার জন্য ব্যয় করা হয়। মহাকাশ বিভাগে বরাদ্দ গত বছরে ছিল ১৩,৭০০ কোটি টাকা, এবছর বরাদ্দ কমিয়ে হয়েছে ১২,৫৪৩.৯ কোটি টাকা; অর্থাৎ প্রায় ৮.৫ শতাংশ হ্রাস। ফলে দেশের মহাকাশ গবেষণা যে ব্যাহত হবে তাতে সন্দেহ নেই।
সরকারের বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে অনীহার কারণে ০.৫ শতাংশেরও কম ভারতীয় ছাত্র পিএইচডি বা সমমানের শিক্ষাগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। গবেষণার প্রথম ধাপ হলো পিএইচডি-তে অংশগ্রহণ। অল ইন্ডিয়া সার্ভে অফ হায়ার এডুকেশন তাদের রিপোর্টে একথা জানাচ্ছে। বর্তমানে দেশে গবেষকের সংখ্যা (প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায়) চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইজরায়েল সহ অনেক ছোটো দেশের থেকেও অনেক পিছিয়ে।
এটা স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় সরকার বাজেটে প্রয়োজনীয় আর্থিক ব্যবস্থা না করেই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি (এনইপি-২০২০) বাস্তবায়নের কথা বলেছে। কেন্দ্রীয় জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত জাতীয় গবেষণা ফাউন্ডেশনে (এনআরএফ)’র জন্য এই বাজেট ২০২৩-৩৪ আগামী দশ বছরের জন্য ২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এনআরএফ-কে একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে যা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা এবং শিল্পের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে এবং এই সংযোগকে উন্নত করবে। ২০২২-২৩ সালে এই এনআরএফ-এর জন্য সংশোধিত বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ লক্ষ টাকা। এটা হাস্যকর একটি পদক্ষেপ।
বাজেট বক্তৃতায় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ গবেষণায় উৎকর্ষতার জন্য ৫টি কেন্দ্র 'Make Artificial Intelligence work for India' তৈরির কথা বলা হয়। কিন্তু এই কেন্দ্রগুলির জন্য বরাদ্দের কোনো উল্লেখই বাজেটে নেই। এর জন্য ৫ জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে ১০০টির মতো কেন্দ্র তৈরি হবে। কিন্তু ৫জি এখন রিলায়ান্সের হাতে।
কী করা উচিত ছিল
গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিকশিত করতে বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য অর্থিক বরাদ্দ জরুরি। কেন্দ্রীয় বাজেটে ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ব্যয়বহুল, বিশ্বমানের সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম সমন্বিত বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামোগুলিকে বেশ কয়েকটি ভাগ করে এক একটি পুল প্রতিষ্ঠার বিষয় বিবেচনা করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেন্দ্র (pool) তৈরি করা জরুরি ছিল। এই ধরনের পুল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা গবেষকরা ব্যবহার করতে পারতেন। এই ধারণা নতুন নয়। যেহেতু ব্যক্তি গবেষকদের পক্ষে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই গবেষণাকে উৎসাহিত করতে সরকারের এই পরিকল্পনা থাকা উচিত। সরকার সেপথে না হেঁটে বিভিন্ন চমক দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রয়াস দেশের বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষতি করবে। একটি ফ্যাসিস্ত সরকারের থেকে এর বেশি কিছু আশা করাই বৃথা।
দেশের হোলসেল প্রাইস ইনডেক্সের উপর ভীত্তি করে মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক হার কত হলো তা বিচার করা হয়। সেই হিসেবে দেখা যাবে যে, গত বছর ডিসেম্বরে যে জিনিস পাইকারি বাজার থেকে ১০০ টাকায় কিনেছি তার দাম এবছর ডিসেম্বরে ১০৪.৯৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক ১৬ জানুয়ারি ২০২৩-এর তথ্য দিয়ে বলেছে যে, পাইকারি মূল্য তালিকা অনুযায়ী ২০২১ ডিসেম্বর এবং ২০২২ ডিসেম্বরের বার্ষিক মুদ্রাস্ফিতির হার ৪.৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হারে মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনায় রেখে যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বাজেট দেখা হয় তাহলে বোঝা যাবে যে, অনেক ক্ষেত্রেই, বরাদ্দ কমেছে।