৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯
‘‘মরণের হাত ধ’রে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?’’
জয়রাজ ভট্টাচার্য
পরপর কিছু আর্ট ওয়ার্ককে আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়। নয়া উদারবাদ আর উদার থাকতে পারছে না। উদারতা প্রত্যাখ্যান করে, ফ্যাসিবাদ কায়েম করাই যে নয়া উদারবাদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা তা রণবীর-দীপিকার ত্বকের মতোই ক্রমশ পরিষ্কার থেকে আরও পরিষ্কার, আরও পরিষ্কার থেকে আরও আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
ভারতে ফ্যাসিবাদের গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের কিছুদূর ইতালি আর জার্মানির ফ্যাসিবাদকে বোঝার চেষ্টা করতেই হয়, কারণ আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদের প্রবক্তারা ইয়োরোপের ক্লাসিক্যাল ফ্যাসিবাদ থেকে শিখেছে, এমনকী তার গাড্ডায় পড়ে আটকে যাওয়া থেকেও শিখেছে। পুঁজিবাদ নিজেকে গাড্ডা থেকে টেনে তুলতে ফ্যাসিবাদের বৃহত্তর গাড্ডায় গিয়ে পড়ে। আজকের নয়া ফ্যাসিস্টরা সেই ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। সেদিনও তাদের প্রধান বাধা ছিল কমিউনিস্টরা, আজও তাই। সেদিন তারা আটকে গিয়েছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে গঠিত বৃহৎ পিপলস ব্রিগেডের কাছে, আজও সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে তারা কমিউনিস্টদের প্রধান টার্গেট করেছে, এই আক্রমণ যুগপৎ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক।
ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করে। এই আধিপত্য (হেজেমনি) কায়েম করার সাংস্কৃতিক কৌশল সম্পর্কে দুইজন ইয়োরোপীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আমাদের সম্যক সচেতন করতে চেয়েছেন - গ্রামশি এবং ওয়াল্টার বেঞ্জামিন। গ্রামশি ইতালিতে মুসোলিনির উত্থানের সাক্ষী, নিপীড়নের শিকার এবং শহিদ, আর ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, হিটলারের জার্মানিতে।
আন্তোনিও গ্রামশি
গ্রামশি ইতালির শ্রমিক অধ্যুষিত তুরিন শহরের ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ছিলেন। তুরিনের সবচেয়ে বড়ো কারখানা ফিয়াট গাড়ির। সেখানের ট্রেড ইউনিয়নে বামপন্থীদের শক্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। এতোটাই শক্তিশালী ছিল সেই ইউনিয়ন, অনেক ইউনিয়ন লিডার ভাবছিলেন, ট্রেড ইউনিয়ন নিজেই ব্যবস্থা বদলে দিতে পারে, পার্টি সংগঠনের প্রয়োজন নেই! এই অংশকে লেনিনবাদের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেই গ্রামশি, বরদিগা, তোগলিয়াত্তিরা ১৯২০ সালে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেন। আর সেই সময়েই মুসোলিনি ক্রমশ নিজের ক্ষমতা করায়ত্ত করতে থাকে।
১৯২৬ সালে গ্রেপ্তার হন গ্রামশি। টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের তাঁবেদার আদালত নিদান দেয় - ‘‘উই নিড টু সিজ দিস ব্রেইন ফর অ্যাটলিস্ট টু ডেকেডস।’’ আমাদের এই বিপজ্জনক মস্তিষ্ককে দু’দশকের জন্য সিজ করতে হবে। কিন্তু সেটা পারেনি কয়েদখানা! গ্রামশি তাঁর সবচেয়ে পরিণত, সবচেয়ে কার্যকরী লেখাগুলো লিখেছেন কয়েদখানা থেকেই। সেই লেখা থেকেই আমরা আধিপত্য বিস্তারের কৌশল সম্পর্কিত গ্রামশির ধারণা জানতে পারি। গ্রামশি, তোগলিয়াত্তি, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এঁরা তিনজনেই আমাদের খেয়াল করতে বলছেন - ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র জোরজুলুম করেই নিজের বিস্তার ঘটায় না, জনগণের একটা ব্যাপক অংশের সে সমর্থন আদায় করে নেয়। এটা ঘটে কালচারাল অ্যাপারেটাসগুলোকে একচেটিয়া করে ফেলার মধ্য দিয়ে, আর এটা ঘটায় রাষ্ট্রের পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা। ইতালিতে আমরা দেখবো - মুসোলিনি যে ফ্যাসিস্ট ডকট্রিন লিখছে - তার বয়ান তৈরি করেছে জিওভান্নি জেনেত্তিলের মতো বুদ্ধিজীবী। ইতালির সবচেয়ে মান্য বুদ্ধিজীবী বেনেদিত্ত ক্রোচে হয়ে উঠছেন ফ্যাসিবাদের প্রধান প্রবক্তা। ফ্যাসিস্ট ডকট্রিনে সই করছেন নোবেল লরিয়েট বিখ্যাত নাট্যকার পিরেনদেল্লো!
এই সাংস্কৃতিক হেজেমনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে পালটা কাউন্টার হেজেমনি দিয়েই। আর সেখানেই মার্কসবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণির সুশৃঙ্খল নিজস্ব বুদ্ধিজীবী বাহিনীর প্রয়োজন। যেমন ইতালির নোবেল লরিয়েট নাট্যকার পিরেনদেল্লোর কাউন্টার হেজেমনি তৈরি করেন জার্মান মার্কসবাদী নাট্যকার নির্দেশক বের্টোল্ট ব্রেখট।
এই প্রতিস্পর্ধী সাংস্কৃতিক বয়ানকে স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাসিস্ট রেজিমেন্ট আটকাতে চায়। আটকানোর নানাবিধ তরিকা আছে - পেটোয়া ট্র্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে পালটা মিথ্যে বয়ান তৈরি করা, স্টেট মেশিনারির সরাসরি হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ সেন্সর এবং ব্যানিং, এক আসক্ত উন্মত্ত ক্যাডার বাহিনী তৈরি ( ব্রাউন শার্টস, ব্ল্যাক শার্টস, এস এস বাহিনী, বজরং দল, দুর্গা বাহিনী, এবিভিপি...) যারা শেষ পর্যন্ত বুক বার্নিং, অলিম্পিক গেমসে হুলিগানিজম করা, প্রতিবেশী দেশ খেলতে এলে ক্রিকেট মাঠের পিচ খুঁড়ে দেওয়া, ফিল্মের প্রিন্ট পুড়িয়ে দেওয়া, হলে গিয়ে ভাঙচুর চালানো, এইসব করে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত, সংস্কৃতির ঠিকেদারি নিয়ে পাড়ার পেঁচো মাস্তান বাহিনীর সর্দার হয়ে ওঠাই এইসব ভাড়াটে শিল্পী সাহিত্যিক ইতিহাসবিদদের কাজ।
এর উল্টোদিকে মেহনতি মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা বুদ্ধিজীবীরা সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের প্রতিরোধেই থাকে মেহনতের সমস্ত চিহ্ন। আর মেহনতের চিহ্ন বর্জন করাই প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির কাজ। তারা মেহনত আর সৃজনশীলতার মধ্যে ব্যারিকেড তৈরি করে। এইটেই সৃজনপ্রক্রিয়ার দার্শনিক ভিত্তির শাশ্বত দ্বন্দ্ব। শ্রম নিবিড় সৃজন, নাকি শ্রমবিমুখ সৃজন, যাকে বুদ্ধিজীবীরা মেধাবী, সফিস্টিকেটেড, বৌদ্ধিক এইসব গালভারী নাম দিতে ভালোবাসে। এইসব গালভারী নামের আড়াল খসে গেলে আদতে যে কঙ্কাল পড়ে থাকে তাকে বলে ডেকাডেন্স, অবক্ষয়ী সংস্কৃতি। তাই প্রগতিশীল মেহনতি আর্টিস্টদের দায়িত্ব দুটো - (১) ফ্যাসিস্ট ব্রিগেডের বিরুদ্ধে কালচারাল ফ্রন্টে রেজিস্টেন্স তৈরি করা। (২) সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রগতিশীল ধারা অব্যাহত রাখা।
পালমিরো তোগলিয়াত্তি
প্রথম দায়িত্ব সম্পর্কে লাইন নির্ধারণ করা দ্বিতীয় দায়িত্বের তুলনায় কিছুটা আপাতসহজ ঠেকে, কিন্তু দ্বিতীয় দায়িত্ব সম্পর্কে লাইন নির্ধারিত না হলে, প্রথম দায়িত্বের লাইন ভ্রান্ত হয়। কারণ ‘সংস্কৃতি’ বলতে কী বুঝব, তা ওই দ্বিতীয় দায়িত্বের বোঝাপড়াতেই নিহিত। আমরা অনেক সময়েই যা কিছু ‘বাজার চলতি’ তাকেই সংস্কৃতি ভেবে বসি। আমাদের এখানে ইদানিং যা কিছু ‘আনন্দবাজার চলতি’ তাকেও সংস্কৃতি ভাবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সংস্কৃতি কোনো স্থবির ধারণা নয়, বহমান কর্মকাণ্ড। যা কিছু প্রাচীন, তাই আমাদের ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতি ভাবলে, সেই নিরিখে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা সবই ঘনঘোর সংস্কৃতি হয়ে থেকে যাবে। তখন ব্যাদে সবই আছে মনে হবে, আর যা ব্যাদে নেই, তা অ্যান্টিন্যাশনাল মনে হবে। যেহেতু ব্রহ্মার চারটে মাথা, তাই চশমা পরা সম্ভব নয়, তাই চশমা পরার কারণেই কাউকে অ্যান্টি ন্যাশনাল দাগিয়ে গারদে চালান করা হবে। চশমা আমাদের সংস্কৃতি নয়। সম্ভবত জাঙিয়াও নয়, চাড্ডি হচ্ছে শাশ্বত ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক - এই মর্মে আইন পাস হয়ে গেলেও আশ্চর্য কিছু নয়!
ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সম্পর্ক বৈরিতার নয়, সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক। ঐতিহ্য আধুনিকতাকে হাত ধরে হাঁটতে শেখায়। আর এই সম্পর্কের সেতুবন্ধন ঘটে সংস্কৃতি দিয়ে। স্পেনের কবি হিমোনেথ লিখেছিলেন - ‘ডানার শিকড় হোক, শিকড়ের ডানা’, - এই অমোঘ লাইনটিই আমাদের সাংস্কৃতিক ‘লাইন’। আমাদের কর্মসূচি যেন শিকড়ে প্রোথিত হতে পারে, আর ডানায় হতে পারে উড্ডিন। এই আমাদের বোঝাপড়া।
জীবন চলমান, নড়াচড়া করাই প্রাণের লক্ষণ। নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু হয়ে ভাগাড়ে পড়ে থাকে মড়া। সেই মড়ার দিকে নজর দিয়ে বসে থাকা শেয়াল শকুনরাই একমাত্র স্থবিরতাকে সংস্কৃতি বলে চালাতে চায়। স্থিতাবস্থার পক্ষে থাকে এই মুমূর্ষু চলচ্ছক্তিহীন সংস্কৃতি। জীবনকেই এরা অস্বীকার করে, অস্বীকার করে নতুন সৃষ্টিকে। জীবনের সমস্ত সহজ আনন্দকে, মানবিক অনুভূতিকে কোতল করাই এই ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির অ্যাজেন্ডা । ১৯৩৩-এর মে মাসে ‘আন জার্মান’ দাগিয়ে দিয়ে সমস্ত বইপত্র পোড়ানোর ডাক দেওয়া হয়। এমনকী আইনস্টাইন, হেলেন কেলারও ‘আন জার্মান’! গোটা জার্মানি উন্মত্ত হয়ে ওঠে। দেশ ছেড়ে যেতে হয় ব্রেখটকে। সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আমরা আমাদের দেশে এই মুহূর্তে ঠিক এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতাই দেখতে পাচ্ছি। যা কিছু দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পারপাস সার্ভ করবে না, তাই অ্যান্টিন্যাশনাল দাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া এই সরকারের কর্মসূচি। পিটার ব্রুকের অবিস্মরণীয় থিয়েটার প্রোডাকশন মহাভারতে মহান অভিনেতা সিজল্যাকের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই। মল্লিকার মা ছিলেন ভারতের ধ্রুপদী নৃত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী মৃণালিনী সারাভাই। সারা পৃথিবী মল্লিকা সারাভাইকে চেনে আর্ট প্রাক্টিশনার হিসেবে। চেনে তাঁর দল দর্পণকে একডাকে সকলে। মল্লিকার অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে ভারত সরকার নির্দেশ দিয়েছিল সম্প্রতি, কারণ মল্লিকা গুজরাটে থাকেন এবং সেখানে মোদি অমিত শাহ’র সমস্ত অপকর্মের বিরুদ্ধে তিনি বরাবর সোচ্চার। মল্লিকার কণ্ঠ তথা নৃত্য বন্ধ করতে চেয়েছে সরকার ভয় পেয়েই। কিন্তু পারেনি। মানুষের সমর্থন রয়েছে মল্লিকার সাথেই। অনুষ্ঠান পণ্ড করতে পারেনি ঘাতক বাহিনী। এই বছর ভারত রঙ্গ মহোৎসবে তিতুমীর নাটককে আমন্ত্রণ জানিয়েও শেষ মুহূর্তে শো বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তিতুমীরের লড়াইকে এই নিও ফ্যাসিস্টরা ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হবে। তিতুমীরকে মেরে ফেলে ব্রিটিশরা ভেবেছিল তারা তিতুমীরের লড়াইকেই মেরে ফেলতে পেরেছে। যেমন চে গেভ্যারাকে মেরে ফেলে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ যখন ভেবেছিল তারা বিপ্লবকেই নিকেশ করেছে, তখন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পড়তে চে বলেন - চালাও গুলি, তোমরা শুধু একজন ব্যক্তি মানুষকেই মারতে পারবে, তার লড়াইকে নয়। তেমনই পল রোবসনের গান, মল্লিকা সারাভাইয়ের নাচ, সফদার হাসমির থিয়েটার, মান্টোর উপন্যাস কোনো কিছুই আটকে শাসক নিশ্চিত থাকতে পারে না। কারণ জনগণের জীবনের সাথে লেপ্টে থাকা আর্টকে আদতে আটকানো যায় না, যায়নি কখনও। মেরেধরে আটকানো গেলে, কবীরের গান ছয়শো বছর ধরে বেঁচে থাকতো না।