৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯
সন্ত্রাসের আবহকে উপেক্ষা করে লালঝান্ডার স্রোত ত্রিপুরাজুড়ে
বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে পরাস্ত করার ডাক বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের
হারাধন দেবনাথ
আখাওড়া-আগরতলা চেকপোস্টের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বৃন্দা কারাত।
‘বিজেপি সিঙ্গেল ডিজিটে আটকে যাবে’ - রাজধানী আগরতলায় কান পাতলেই এই কথা শোনা যায়। আপনি একজন রিকশা চালক বা টমটম চালককে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে ‘না দাদা বিজেপি আর ফিরছে না’। কী করে বুঝলেন? পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে এক রিকশা চালক বললেন - ‘বিজেপি এমন কী করেছে যে জিতবে? একমাত্র উড়ালপুল দেখিয়ে বললেন - বামফ্রন্ট সরকার এটি করেছে। এই সরকারটা থাকলে আরও হতো। বিজেপি সরকার কিছুই করেনি।’
বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষক-কর্মচারী, শ্রমজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ বঞ্চিত। এই সময়ে অভিযোগের তালিকা যখন দীর্ঘ তখন বামফ্রন্ট সব অংশের মানুষকে ছুঁয়ে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। বেকারদের কর্মসংস্থান, কর্মচারীদের বঞ্চনার অবসান, চাকরিচ্যুত ১০,৩২৩ শিক্ষকের সমস্যার সমাধানের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইস্তাহারে। আড়াই লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বামফ্রন্টের ইস্তাহারে। এবারের নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৪৬টি আসনে এবং কংগ্রেস ১৩ টি আসনে সমঝোতার ভিত্তিতে লড়ছে। একটি কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কংগ্রেস ২০ দফা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে। বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে যে কোনো মূল্যে বিজেপি’কে পরাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছে ত্রিপুরাবাসীর কাছে।
বামফ্রন্টের ইস্তাহারে বলা হয়েছে, রেগা-সহ সরকারি প্রকল্পে বছরে ২০০ দিন কাজের ব্যবস্থা হবে। অনিয়মিত ও চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের নিয়ম মেনে নিয়মিতকরণ, কর্মচারীদের বছরে দু’বার ডিএ প্রদান করা হবে। ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিদ্যুৎ ব্যয় বহন করবে সরকার। কৃষির জন্য বিনামূল্যে সেচের জল সরবরাহ করা হবে। উপজাতি, তপশিলি জাতি, ওবিসি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু কল্যাণে একাধিক ব্যবস্থা, ড্রাগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে ইস্তাহারে।
বামফ্রন্ট কমিটির আহ্বায়ক নারায়ণ কর বলেছেন, ২০১৮-তে দেওয়া নিজেদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে বিজেপি প্রহসন ও মিথ্যায় প্রতিপন্ন করেছে। তাদের ২৯৯টি প্রতিশ্রুতির মিশন ডকুমেন্ট ছিল ভোটের জুমলা। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, ইস্তাহারে যা বলেছি তা করে দেখাব।
প্রচারে বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সাথে বলছেন, বামফ্রন্টের ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হলে রাজনৈতিক সন্ত্রাসে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের পাশে সরকার সাহায্যের হাত নিয়ে দাঁড়াবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সংগতি রেখে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে। চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বাসস্থান, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নির্মাণ শ্রমিক পরিবারের গৃহ নির্মাণ, চিকিৎসা ও ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়ার জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা হবে। পরিবহণ শ্রমিকদের উপর জুলুম বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিবহণ শ্রমিকদের চিকিৎসা পরিষেবায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা ও মিড ডে মিল সহ স্কিম ওয়ার্কারদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে এবং কাজের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।
বামফ্রন্টের ইস্তাহারে বলা হয়েছে, সরকারি শূন্যপদ পূরণে এবং নতুন নিয়োগে ধারাবাহিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাঁচ বছরে সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের শিল্প-বাণিজ্য ও ব্যবসায়ে ২.৫ লক্ষ/সর্বাধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্লক ও নগরে বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিপণনে সাহায্য করা হবে। স্বাবলম্বন কর্মসূচিতে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হবে। রেগা-সহ কৃষি, উদ্যান, গ্রামোন্নয়ন, পূর্ত, বন, মৎস্য এবং অন্যান্য উন্নয়ন দপ্তর মিলে বছরে ২০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। শহরাঞ্চলে টুয়েপ প্রকল্পে শ্রমদিবস বৃদ্ধি করা হবে।
জোলাই বাড়িতে নির্বাচনী সমাবেশে বক্তা মীনাক্ষী মুখার্জি।
কৃষির জন্য বিনামূল্যে সেচের জল সরবরাহ করা হবে। সেচের এলাকা সম্প্রসারণ করা হবে এবং বর্তমানে অচল সেচ প্রকল্পগুলি সব ঋতুতে চালু রাখার ব্যবস্থা করা হবে। মৎস্য চাষ উন্নয়নে বিশেষভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে। সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ ভরতুকিতে কৃষি বীজাগার এবং সমবায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে। সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হবে। কৃষকদের উৎপাদিত ধান ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত সহায়ক মূল্যের উপর রাজ্য সরকার অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দেবে। রাবার, চা, আনারস সহ বিভিন্ন ফল ও ফুল উৎপাদক চাষিদের ‘‘অভাবী বিক্রয়’’ থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হাতে দেওয়া হবে না। বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং অধ্যাপক স্বল্পতা দূর করা হবে। বর্তমান পলিটেকনিক কলেজসমূহ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী কোথাও কোথাও পলিটেকনিক কলেজকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে উন্নীত করা হবে। নতুনভাবে ব্লক এলাকায় আইটিআই এবং মহকুমায় পলিটেকনিক কলেজ স্থাপন করা হবে। বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদী মানসিকতা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে উঠতে সাহায্যকল্পে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সামাজিক ভাতা প্রাপকদের সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হবে। অন্যায়ভাবে যাদের ভাতা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তাদের ভাতা পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কায়িক শ্রমে যুক্ত সমস্ত পেশায় কর্মরত ৬০ বছর ঊর্ধ্বের ব্যক্তিদের সামাজিক ভাতার আওতায় আনা হবে। ৬০ বছর ঊর্ধ্বের জুমিয়া-গরিব কৃষক-খেতমজুরদের যাদের বাৎসরিক আয় সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকার কম তাদের জন্য নতুন ভাতা প্রকল্প চালু করা হবে।
শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বার্থে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি তুলে ধরা হয়েছে বামফ্রন্টের ইস্তাহারে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ছাঁটাই করে দেওয়া ১০,৩২৩ শিক্ষকদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। প্রয়াত ছাঁটাইকৃত শিক্ষক পরিবারগুলিকে সাহায্য করা হবে। অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করে দেওয়া সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হবে। পুরনো পেনশন প্রথা পুনরায় বহাল করা হবে এবং বছরে দু’বার মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হবে। মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির সাথে সাযুজ্য রেখে এসএসএ শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে। অবসরকালীন সময়ে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অনিয়মিত ও চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের নিয়ম মেনে নিয়মিত করা হবে। বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মচারীদের নিয়ম-পদ্ধতি মেনে নিয়মিতভাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হবে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হবে। বহির্রাজ্যে কর্মরত টিএসআর-দের অবিলম্বে ফিরিয়ে আনা হবে। পুলিশ, টিএসআর, হোমগার্ড এবং এসপিও-দের রেশনমানি ও পোশাক ভাতা বৃদ্ধি করা হবে। বিভিন্ন সরকারি কর্ম প্রকল্পে কর্মরতদের ছাঁটাই করা হবে না।
উপজাতি জনগণের আর্থিক-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে আটটি ন্যূনতম কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেছেন নেতৃবৃন্দ। এরমধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংশোধন করে ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদের স্বয়ং শাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সাত দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা হবে তপশিলি জাতি, ওবিসি, সংখ্যালঘুদের কল্যাণে।
বিনামূল্যে সর্বত্র পানীয় জল সরবরাহ করা হবে বলে ইস্তাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে ন্যূনতম কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, মাসে পঞ্চাশ ইউনিটের কম যে সকল পরিবার বিদ্যুৎ ভোগ করেন সরকার সেই সকল পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যয় বহন করবে।
এছাড়াও আইনসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ, ড্রাগের বিপদ মোকাবিলায় কঠোর ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, শিল্প, যোগাযোগ পরিকাঠামো উন্নয়নসহ বহুবিধ বিষয় নির্বাচনী ইস্তাহারে করার কথা জানিয়েছে বামফ্রন্ট।
এক নজরে -
● সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবেন।
● দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সংগতি রেখে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে।
● সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ ভরতুকিতে কৃষি বীজাগার এবং সমবায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে।
● আধুনিকভাবে উন্নত জুম চাষের জন্য প্রকৃত জুমচাষিদের সাহায্য করা হবে।
● সরকারি শূন্যপদ পূরণে এবং নতুন নিয়োগে ধারাবাহিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
● রাজ্যে কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হবে না।
● ছাঁটাই করে দেওয়া ১০,৩২৩ শিক্ষকের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে।
● পুরনো পেনশন প্রথা পুনরায় বহাল করা হবে এবং বছরে দু’বার মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হবে।
● অনিয়মিত ও চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের নিয়ম মেনে নিয়মিত করা হবে।
● পুলিশ, টিএসআর, হোমগার্ড এবং এসপিও-দের রেশনমানি ও পোশাক ভাতা বৃদ্ধি করা হবে। বিভিন্ন সরকারি কর্ম প্রকল্পে কর্মরতদের ছাঁটাই করা হবে না।
● সংবিধান সংশোধন করে ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদের স্বয়ং শাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
● বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে।
● মাসে পঞ্চাশ ইউনিটের কম যে সকল পরিবার বিদ্যুৎ ভোগ করেন সরকার সেই সকল পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যয় বহন করবে।
● দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ জনমুখী প্রশাসন নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ।