E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ২৬ মাঘ, ১৪২৯

ত্রিপুরা থেকে

তন্ময় ভট্টাচার্য


সোনামুড়া শহরে সুবিশাল সমাবেশে বক্তা মানিক সরকার।

নির্বাচনী প্রচারে ত্রিপুরায় এসেছি গত ৩ ফেব্রুয়ারি। এখন পর্যন্ত সভা করেছি ঋষ্যমুখ, বিশালগড়, বাগবাসা, পানিসাগর, কমলাসাগর, বাগমা বিধানসভা কেন্দ্রে। বাকি আছে খোয়াই এবং আগরতলার একটি কেন্দ্র। ৬০ আসনের বিধানসভায় এটা কোনো সংখ্যাই না। কিন্তু পথ চলতে চলতে, কমরেড এবং সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতে যা বুঝেছি, উপলব্ধি করেছি তার কিছুটা দেশহিতৈষী’র পাঠকদের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য এই লেখার অবতারণা।

নৃপেন চক্রবর্তী, দশরথ দেব, মানিক সরকার দশ+পাঁচ+কুড়ি - এই মোট পঁয়ত্রিশ বছর রাজের বাম সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১৮ সালে ডবল ইঞ্জিনের সরকার, মানিক বদলে হীরা আনুন, কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে, বছরে পঞ্চাশ হাজার চাকরিসহ বহু অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফানুস উড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ ডজন ডজন মন্ত্রীকে প্রচারে এনে, কোটি কোটি টাকা নির্বাচনী প্রচারে খরচ করে বিজেপি সরকার গড়তে সমর্থ হয়। আর পাঁচ বছরের জন্য ত্রিপুরার মানুষের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুঃশাসনের রাজত্ব। ডবল ইঞ্জিনের সরকার রাজ্যের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ নয়, পশ্চাদমুখী করে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে রান্নার জন্য যে তেল ত্রিপুরার মানুষ ব্যবহার করে তার নাম ইঞ্জিন তেল। পাঁচ বছরে সেই তেলের দাম ৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। বেশিরভাগ মানুষের খাদ্য লক্ষ্মীভোগ চাল ধর্মের কারবারিদের হাতে এসে ৩৮ টাকা থেকে ৭০ টাকা কেজিতে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাদের দুধ ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামই ডবল ইঞ্জিনের হাতে পরে ডবল বা তারও বেশি হয়ে গেছে। বেড়েছে মদের দোকান। রাজ্যের যুব প্রজন্মকে নেশাগ্রস্ত করে রাখার আয়োজনে বিজেপি সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু নেশার ঘোর কাটিয়ে সেই প্রজন্ম আজ প্রশ্ন করছে, কোথায় গেল বছরে ৫০ হাজার চাকরি। গোটা রাজ্য খুঁজে কেউ একটা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়-আইআইটি-পলিটেকনিক-রাজ্য সরকারি অফিস দেখাতে পারবেন না যেখানে মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনে যত মানুষ কর্মরত ছিলেন তার চাইতে একজন বেশি আজ কাজ করছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু, অবসর যে শূন্যপদ তৈরি করেছে তা পূরণের কোনো উদ্যোগও এই সরকার নেয়নি। সবচাইতে বেশি প্রবঞ্চিত হয়েছেন সেই ১০,৩২৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা যাদের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল ২০১৮-র ভোটে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৫০ জন কাজের কথা বলতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বিজেপি’র গুন্ডাদের দ্বারা। কাজ নেই, হু হু করে বাড়ছে বেকারত্ব, আর ফুলে-ফেঁপে উঠছে বিজেপি’র বুথ, পৃষ্ঠা, মণ্ডল সভাপতিদের পকেট। গায়ের জোরে নির্বাচিত পঞ্চায়েত, এডিসি, পৌর প্রতিনিধি, বিধায়কদের অর্থলালসা দলের অভ্যন্তরেও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যার দরুন গতবারে নির্বাচিত অন্তত ১৫ জন বিধায়ক প্রকাশ্যে বিজেপি-কে পরাজিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন।

ত্রিপুরার জুমিয়াদের জীবন কেমন কাটছে? এই ছবিতে তার উত্তর।
বামফ্রন্ট প্রার্থীর কাছে জীবন যন্ত্রণার কথা তুলে ধরছেন ভোটাররা। দূরবর্তী জনপদ অম্পি থেকে তোলা।

২৫ জন সিপিআই(এম) নেতা কর্মী খুন হয়েছেন। উত্তর পূর্ব ভারতের সবচাইতে শান্তিপ্রিয় রাজ্যকে বারবার অশান্ত করে ভাঙা হয়েছে ৯০০-র বেশি পার্টি অফিস, প্রায় ১,৫০০ ‘দেশের কথা’ পত্রিকার বোর্ড। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভার পর সভায় মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে শুনেছি শিউরে ওঠার মতো অজস্র ঘটনার বর্ণনা, যা লিখতে গেলে একটা গোটা দিন কেটে যাবে। কিন্তু যন্ত্রণা যে প্রতিরোধী ইচ্ছার জন্ম দেয় তার প্রত্যয় দেখেছি সাধারণ মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্মের চোখেমুখে। নির্বাচিত বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী বাদল চৌধুরীকে তাঁর ঋষ্যমুখ বিধানসভা কেন্দ্রেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি গত পাঁচ বছর। তিনি যখন এতদিন না খোলা, কম্পিউটার-টিভি-এগারোটা আলমারি এমনকি ২৫০টা চেয়ার লুঠ করে নিয়ে যাওয়া বিজেপি গুন্ডাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পার্টি অফিসের সামনে ৪ ফেব্রুয়ারি পতাকা উত্তোলন করলেন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বন্যা দেখেছি নিজের চোখে। পাঁচ বছর মিটিং-মিছিল করতে না পারা কমলাসাগর বিধানসভা কেন্দ্রে মিটিং করতে গিয়ে জানলাম, মিটিংয়ে আসবেন না কিন্তু বক্তৃতা শুনবেন এমন ব্যবসায়ীদের দাবিতে তাদের খরচে বাজারের অনেকটা ভিতর পর্যন্ত মাইক বাঁধা হয়েছে। বাগমায় নরেশ জামাতিয়ার সভায় যোগ দিতে গিয়ে যত মানুষ দেখেছি শুধুমাত্র তাঁদের পরিবারের ভোট পেলেই জয় নিশ্চিত। সরকার বদলাচ্ছে এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হচ্ছে প্রত্যেক দিন। কিন্তু সঙ্গে থাকছে আশঙ্কা। ভোটের দিন পুলিশ, নির্বাচন কমিশন সঠিক দায়িত্ব পালন করবে তো! বুথ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে তো মানুষ! ছাপ্পা ভোট, ফলস ভোট দেওয়ার বিজেপি’র পরিকল্পনা পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্যে মসৃণ হবে না তো। আশঙ্কা যেখানেই প্রকাশিত হয়েছে সেখানেই মিলেছে উত্তর, প্রতিদিন একটু একটু করে মরার চাইতে এক বার লড়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে কমিউনিস্টরা পালায়নি, পালায় না। এই বিশ্বাস বাকি ক’টা দিনে বুথ পর্যন্ত পৌঁছে গেলে কমিউনিস্টদের হারিয়ে সরকারে আসা বিজেপি বুঝে যাবে কমিউনিস্টরা মরে না। ত্রিপুরার লড়াই গোটা দেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের পতাকাকে উড্ডীন রাখতে মরিয়া। যে ৯৬ ভাগ কৃষক ধানের অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন, যে মা সন্তানের মর্যাদাহানি দেখেছেন, যে ব্যবসায়ী বিজেপি’র চাপানো অন্যায় ট্যাক্সের শিকার হয়েছেন, যে যৌবন দুটো বলিষ্ঠ বাহু একটা উর্বর সতেজ মস্তিষ্ককে আলস্যের শিকার করে দিতে বাধ্য হয়েছেন, সে-তিনি-তাঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এই শক্তিকে পিছু হঠানো অসম্ভব।